তেজি ট্রাম্পের কন্ঠে কেন নিস্তেজর স্বর বাজলো?
প্রকাশ: ১৬ জুলাই, ২০২৫

“শিয়া সংখ্যা গরিষ্ঠ ইরান দেশটি ১৯৭৯ সালে ইসলামী বিপ্লবের মধ্য দিয়ে একটি ইসলামিক প্রজাতন্ত্রে রূপান্তরিত হয়। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যের ক্যান্সার হিসেবে পরিচিত ইসরাইল বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে ১৯৪৮ সালে ১৪ মে প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমান বিশ্বের সমগ্র ইহূদিদের প্রায় ৪৪ % ইসরাইলে বসবাস করে। ১৯৪৮ সাল থেকে শুরু করে বর্তমান সময়ে এই ইসরাইল মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জন্য মাথাব্যথার কারণ।”
“ইসরাইলের এই বাড়াবাড়ির পেছনে সব সময় ইন্ধন যুগিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সাম্প্রতিক সময়ে ইসরায়েল যেভাবে গায়ের জোরে ইরানে আক্রমণ করে যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিয়েছিল সেটি বিশ্ববাসী স্বচক্ষে দেখে বিস্মিত হয়েছে । ইসরাইল একশতভাগ নিশ্চিত হয়েই যুদ্ধ বাধিয়ে ছিল। ইসরাইলের শতভাগ আত্মবিশ্বাসের পেছনে ছিল যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের সম্পূর্ণ সহযোগিতা করবে।”
১২ দিনের যুদ্ধের দামামা ইরান- ইসরাইল যেভাবে বাঁজিয়েছে তাতে করে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কা বেশিরভাগ মানুষ করেই ফেলেছিল।তাছাড়া শুরুতে ডোনাল্ড ট্রাম্প হুমকি-ধমকি দিয়ে বিশ্বকে এক ধরনের গোলকধাঁধায় ফেলে দিয়েছিলেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প হয়তো ভেবেই নিয়েছিলেন, তার হুমকিতে ইরান নমনীয় হবে। কিন্তু হয়েছে সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র।
“কিন্তু হঠাৎ করে ডোনাল্ড ট্রাম্পের কণ্ঠ নরম হওয়া এবং যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দেওয়ার পেছনে আসলে কী কারণ ছিল? তবে আমার কাছে সাধারণ যুক্তিতে যেটা স্পষ্ট হয়েছে, তা আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করছি।"
প্রথমতঃ ২০০৩ সালের ২০ মার্চ ইরাকের বিরুদ্ধে মার্কিন প্রশাসন ইরাক ১৯৯০ সালের স্বাক্ষরিত পারমাণবিক, রাসায়নিক ও জৈবিক অস্ত্রসহ বিধ্বংসী অস্ত্রের বিস্তার রোধ করা চুক্তি অমান্য করে গণবিধ্বংসী অস্ত্র তৈরি করেছে—এই অভিযোগে ইরাক আক্রমণ করে মার্কিন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ। উল্লেখ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই অভিযোগ পরবর্তীতে ডাহা মিথ্যা প্রমাণিত হয়।”
তাছাড়া, “ইরাকের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ আনা হয় যে সাদ্দাম হোসেন আল-কায়েদাকে সহযোগিতা করছেন। মজার ব্যাপার হলো পরবর্তীতে এর পক্ষেও কোনো জোরালো সত্যতা পাওয়া যায় নি।”
“মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে বাধানো এই যুদ্ধে মৃত্যুর সংখ্যা আনুমানিক হয়েছিল ১,৫০,০০০ থেকে ১০ লক্ষেরও অধিক। এ যুদ্ধে প্রায় ব্যয় হয়েছিল ৮৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের চেয়েও বেশি। স্মরণ রাখা দরকার, এই সময়ে মার্কিন অর্থনীতির মোট ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ৩ থেকে ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের মধ্যে। এত বিশাল পরিমাণ ব্যয় মার্কিন অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।”
উল্লেখ্য, “যে ইরাক যুদ্ধে প্রায় ৪,৫০০ জন মার্কিন সেনা নিহত হয়েছিল এবং যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ব্যয় ১.৭৯ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়।ইরানের সাথে যুদ্ধবিরতির জন্য ইরাক যুদ্ধের অভিজ্ঞতা ও ট্রাম্প প্রশাসনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে বলে ধারণা করা যায়।”
দ্বিতীয়তঃ তালেবানরা ওসামা বিন লাদেন এবং আল-কায়েদা সদস্যদের আশ্রয় দিয়েছিল—এই অভিযোগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২০০১ সালে আফগানিস্তানে যুদ্ধ চালায়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগের তথ্য অনুযায়ী ২০০১ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানে মার্কিন আনুমানিক ব্যয় হয়েছিল ৭৭৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। দীর্ঘ ১৭ বছর চলা এ যুদ্ধে প্রায় ২,৩০০ মার্কিন সেনা নিহত হয়েছিল এবং ২০,৫৬০ জন সেনা আহত হয়েছিল ।
“যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই বিপুল ব্যয়ভার এবং সামরিক বাহিনীর লোকজনের প্রাণহানি থেকে শিক্ষা নিয়েই হয়তো ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানের সাথে যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব করেছে।”
তৃতীয়তঃ ইরানের নিয়ন্ত্রণে থাকা হরমুজ প্রণালী একটি গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক পথ—এই পথ দিয়ে প্রতিদিন বিশ্বের মোট তেলের প্রায় ২০ শতাংশ পরিবাহিত হয়। ইরান যদি সত্যিই হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেয় তাহলে পাশ্চাত্য দেশসহ সারা বিশ্বের তেল ও গ্যাস সরবরাহে মারাত্মকভাবে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। যুক্তরাষ্ট্রের কারণে যদি বিশ্বে বিভিন্ন দেশ জ্বালানি সংকট, অর্থনৈতিক মন্দা, গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি প্রভৃতি সমস্যার সম্মুখীন হয় তাহলে অনেক দেশই যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতা করে ইরানের পক্ষে অবস্থান নিতে পারে—এই গভীর চিন্তা থেকেই ট্রাম্প সরাসরি যুদ্ধ না জড়ানোর পরিকল্পনা করতে পারেন।
চতুর্থতঃ ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ইরানের মিত্র দেশগুলো যেভাবে ইরানের পক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়েছে সেটিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অশনি সংকেত। বিশেষ করে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন সরাসরি ইরানের পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছেন। তাছাড়া আর এক মুসলিম দেশ তু্রস্ক ও শক্তভাবে অবস্থান নেয় ইরানের পক্ষে। উল্লেখযোগ্য যে রাশিয়া, “চীন এবং উত্তর কোরিয়া—এই তিনটি দেশই পরমাণু শক্তিধর দেশ।”
পঞ্চমত: ২০২৫ সালের নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দেন যে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে অমূল্য পরিবর্তন আনবেন। শুধু তাই নয় ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের প্রতিশ্রুতিও তিনি দেন কেননা এই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রতিনিয়ত শত শত কোটি ডলার সহায়তা প্রদান করতে হচ্ছে।
“সুতরাং এ থেকে বোঝা যায়—যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অবস্থা এবং ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে ট্রাম্প নিজেই উদ্যোগ নিতে প্রস্তুত সেখানে নতুন করে কোনো দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে নিজের অবস্থান দুর্বল করার কথা তিনি ভাববেন না এই প্রতিশ্রুতি থেকেও ট্রাম্প যুদ্ধ বিরতি প্রস্তাব করেন বলে ধারণা।”
ষষ্ঠতঃ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চিন্তার বাইরে ছিল— “ ইরান এভাবে চোখে চোখ রেখে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে। যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলার জবাবে ইরান মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থিত মার্কিন সামরিক ঘাঁটিগুলোর ওপর পূর্বেই ঘোষণা দিয়ে যেভাবে হামলা চালায়—এটি ৯০% মানুষই বিশ্বাস করতে পারেনি । কিন্তু সব রকম শঙ্কা উপেক্ষা করে ইরান এই দুঃসাহসিক কাজ করেই ফেলেছে। মধ্যপ্রাচ্য হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কাতেই ডোনাল্ড ট্রাম্প যুদ্ধের প্রস্তাব দিতে বাধ্য হন এটাই আমার অনুমান।”
সপ্তমতঃ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট একতরফাভাবে যুদ্ধের ঘোষণা দিতে পারেন না বা একা যুদ্ধে জড়াতে পারেন না যদি না যুক্তরাষ্ট্রের ওপর সরাসরি হামলা হয়। তাই যুদ্ধে জড়ানোর জন্য কংগ্রেসের অনুমতি নিতে হয়। তবে ব্যতিক্রম হলো—যদি কোনো দেশ অন্যায়ভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে আক্রমণ করে সে ক্ষেত্রে কংগ্রেসের অনুমোদন না পেলেও প্রেসিডেন্ট স্ব-উদ্যোগে যুদ্ধ শুরু করতে পারেন।
“কংগ্রেসের অনুমোদন ছাড়াই ট্রাম্প যেভাবে ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালিয়েছিলেন তা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন। শুধু বিরোধী দল নয় নিজ দল রিপাবলিকান পার্টির ভেতরেও ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমালোচনা হয়। মার্কিন জনগণের ক্ষোভের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও ব্যাপক চাপ ও প্রতিবাদের মুখে পড়েই ট্রাম্প যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হন—এমনটাই ধারণা করা হয়।”
অষ্টমতঃ আপনি ভালো করে লক্ষ্য করলেই দেখবেন, যখন ইসরায়েলের আক্রমণের পর ইরান পাল্টা আক্রমণ করে ইসরায়েলের অবস্থা নাস্তানাবুদ করে দিচ্ছিল, তখন ডোনাল্ড ট্রাম্পের মিত্র দেশগুলো সরাসরি ট্রাম্পকে যুদ্ধে জড়ানোর জন্য সমর্থন দিচ্ছিল না। বিশেষ করে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কেয়ার স্টারমার এবং ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ ডোনাল্ড ট্রাম্পকে যুদ্ধে না জড়ানোর ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন। মিত্রদের এমন আচরণই ট্রাম্পকে যুদ্ধবিরতিতে যেতে পরোক্ষভাবে ভূমিকা পালন করেছে বলে আমার ধারণা।
নবমত: দেশ প্রেম একটি দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী ও গুরুত্বপূর্ণ সার্বভৌমত্ব। কোন দেশকে অন্য দেশের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে পারে সেই দেশের জনগণের অগাধ দেশপ্রেম। এই ধরনের প্রচন্ড দেশপ্রেম দেখিয়েছিল ভিয়েতনামিরা আমেরিকার বিরুদ্ধে, আফগানিস্তানের জনগণ দেখিয়েছিল রাশিয়ার বিরুদ্ধে, আপনি লক্ষ্য করলে দেখবেন আমেরিকার পেটের মধ্যে থেকেও কিউবা জাতি টিকে আছে শুধুমাত্র তাদের দেশের জনগণের অসাধারণ একতাবদ্ধ দেশ প্রেমের কারণেই। ধর্মীয়ভাবে ইরানের সিংহভাগই শিয়া মুসলিম যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৯০%।
“বাকি অংশ সুন্নী মুসলিম এবং অন্যান্য সম্প্রদায় মিলে ১০% রয়েছে। আপনি গভীরভাবে লক্ষ্য করলে দেখতে পাবেন এবারের ইরান-ইসরাইল যুদ্ধে ইরানের সমস্ত জনগণ জাতিগত বিদ্বেষ ভুলে এক ইরানের সার্বভৌমত্বের পক্ষে স্লোগান তুলে। ইরানের এই জাতিগত বন্ধনের শক্তিমত্তা দেখে ট্রাম্প প্রশাসনের একচেটিয়া যুদ্ধ বাঁধানোর পরিকল্পনা থেকে বিরত থাকে বলে ধারণা ।”
তালুকদার সানাউল্লাহ
সাবেক শিক্ষার্থী:- ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
আরও পড়ুন