সংখ্যায় সংখ্যায় জেনে নিই অর্থনীতির শক্তি, দুর্বলতা আর নানা শঙ্কার কথা
প্রকাশ: ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
বাংলাদেশের অর্থনীতি এক অস্থির মোড়ে দাঁড়িয়ে। প্রবৃদ্ধি এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্নে নেমেছে, দারিদ্র্য বেড়েছে দ্বিগুণ হারে, আর খেলাপি ঋণ ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে। তবে অন্যদিকে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ে কিছুটা আশার আলো দেখা যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতি কমলেও বাস্তব ক্রয়ক্ষমতা ফিরছে না, আর রাজস্ব প্রবৃদ্ধি হলেও টেকসই ভিত্তি তৈরি হয়নি। সংখ্যায় সংখ্যায় দেখা যাচ্ছে—দেশের অর্থনীতির সামনে চ্যালেঞ্জ যেমন গভীর, তেমনি সম্ভাবনাও স্পষ্ট। তাহলে আসুন সংখ্যায় সংখ্যায় জেনে নিই অর্থনীতির শক্তি, দুর্বলতা আর নানা শঙ্কার কথা
২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে এসেছে ৩ দশমিক ৯৭ শতাংশে, যা গত এক দশকের মধ্যে অন্যতম সর্বনিম্ন। কঠোর মুদ্রানীতি, আমদানি সংকোচন ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এ প্রবৃদ্ধিকে চাপে ফেলেছে।এর তুলনায় এর আগে কম প্রবৃদ্ধি ছিল ২০১৯-২০ অর্থবছরে, ৩ দশমিক ৫১ শতাংশ। কোভিড মহামারির কারণে প্রবৃদ্ধি এতটা কম হয়েছিল। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান স্থবির থাকায় এই প্রবৃদ্ধি অর্থনীতির সম্ভাবনার তুলনায় অনেক নিচে। বিশেষ করে নির্মাণ খাতের প্রবৃদ্ধি কমে আসা ও মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি হ্রাস এর বড় কারণ। ফলে অর্থনীতি এখন স্থিতিশীল হলেও প্রবৃদ্ধি পুনরুদ্ধারে আরও সময় লাগবে।
বিনিয়োগ স্থবির, মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি ২০-২৫% কমেছে।
নির্মাণ খাতের প্রবৃদ্ধি হঠাৎ কমে গেছে।• রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ব্যবসার পরিবেশ খারাপ করেছে।
কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে না।
দারিদ্র্য হ্রাস থমকে গেছে।
বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমছে।
স্থিতিশীলতা ফিরলেও বড় ধরনের সংস্কার ছাড়া প্রবৃদ্ধি ৬-৭ শতাংশে ফেরানো কঠিন হবে।
চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে সাড়ে ৫ শতাংশ। এই লক্ষ্য অর্জন নিয়েও সন্দেহ রয়েছে।
পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) সমীক্ষা অনুযায়ী দেশে বর্তমানে দারিদ্র্য ২৮ শতাংশ। ২০২২ সালে এ হার ছিল ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ। চরম দারিদ্র্যও বেড়ে হয়েছে ৯ দশমিক ৪ শতাংশ, যা প্রায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি।
উচ্চ মূল্যস্ফীতি, প্রকৃত মজুরি হ্রাস, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও মহামারি-পরবর্তী ধাক্কা—সবকিছুই একত্রে দারিদ্র্য বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে। পরিবারগুলোর মাসিক ব্যয়ের অর্ধেকের বেশি এখন শুধু খাদ্যেই চলে যাচ্ছে। দরিদ্র পরিবারের ১০ শতাংশের বেশি খরচ তাদের আয়ের চেয়ে বেশি, ফলে তারা ঋণের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে।
• মূল্যস্ফীতি মানুষের আয় খেয়ে ফেলছে।
• প্রকৃত মজুরি কমেছে।
• কর্মসংস্থান সংকট ও রাজনৈতিক অস্থিরতা প্রভাব ফেলেছে।
• পরিবারগুলোর ৫৫ শতাংশ আয় খাদ্যে খরচ হচ্ছে।
• দরিদ্র পরিবার ঋণ নিয়ে চলছে।
সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি না বাড়ালে দরিদ্রের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
আগস্ট মাসে দেশের ছিল ৮ দশমিক ২৯ শতাংশ। মূল্যস্ফীতির এ হার গত ৩৭ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। ২০২২ সালের জুলাই মাসে ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছিল। এরপর আর কখনো ৮ শতাংশের নিচে মূল্যস্ফীতি নামেনি।
বিবিএসের হিসাব অনুসারে, গত আগস্ট মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৭ দশমিক ৬০ শতাংশ। আর খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয় ৮ দশমিক ৬০ শতাংশ। খাদ্য খাতে আগের মাসের চেয়ে মূল্যস্ফীতি কিছুটা বেড়েছে। কমেছে খাদ্যবহির্ভূত খাতের মূল্যস্ফীতি।
তবে ১২ মাসের গড় মূল্যস্ফীতি এখনো প্রায় ১০ শতাংশের কাছাকাছি (৯ দশমিক ৭৭ শতাংশ)। আর ২০২৫ সালের জুলাই মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ৫৫ শতাংশে, যা জুনের তুলনায় সামান্য বেশি। এর মধ্যে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি ছিল ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ আর খাদ্যবহির্ভূত খাতে ৯ দশমিক ৩৮ শতাংশ।
আগস্টে জাতীয় মজুরি হার সূচক বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২৯.৭০ (ভিত্তি বছর ২০২১-২২ = ১০০)। সামগ্রিক মজুরি বৃদ্ধির হার ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ। খাতভিত্তিক বৃদ্ধি হচ্ছে—কৃষি খাতে ৮ দশমিক ২৮ শতাংশ, শিল্পে ৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ এবং সেবা খাতে ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ।
• খাদ্যদ্রব্যের দামে স্থিতি, গ্রামে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমেছে।
• রেস্টুরেন্ট, হোটেল, পোশাক ও জুতায় সবচেয়ে বেশি দাম বেড়েছে (৯-১৭ শতাংশ)।
• স্বাস্থ্য (৩-৪ শতাংশ) ও পরিবহন (৬-৭ শতাংশ) খাতে তুলনামূলক কম দাম বেড়েছে।
• বৈশ্বিক জ্বালানি-কাঁচামালের খরচ ও আমদানিনির্ভরতা প্রভাব ফেলছে।
• গড় মূল্যস্ফীতি (১২ মাসে) এখনো প্রায় ১০ শতাংশ।
• মজুরি ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ বাড়লেও মূল্যস্ফীতি তার চেয়ে বেশি, ফলে ক্রয়ক্ষমতা কমছে।
• কৃষি, শিল্প ও সেবায় মজুরি বাড়লেও জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়নি।
• শহরে খাদ্য বেশি দামি, গ্রামে অখাদ্য দ্রব্যে চাপ বেশি।
• রেস্টুরেন্ট, পোশাক, হোটেল ব্যবহারকারীদের ব্যয় বেড়েছে সবচেয়ে বেশি।
• খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের দাম বাড়লে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি দ্রুত কমবে না।
• মজুরি বাড়লেও মূল্যস্ফীতির সঙ্গে তাল মেলানো কঠিন হবে।
• সামনের মাসগুলোতে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও ক্রয়ক্ষমতা ফিরতে সময় লাগবে।
• বাংলাদেশ ব্যাংকের লক্ষ্য সাড়ে ৬ শতাংশে নামানো, কিন্তু তা অর্জন করা কঠিন।
জুন ২০২৫ শেষে দেশে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৫.৩ ট্রিলিয়ন বা ৫ লাখ ৩০ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা মোট ঋণের ২৭.০৯%। অর্থাৎ ব্যাংক খাতের বিতরণ করা মোট ঋণের চার ভাগের এক ভাগের বেশিই ইতিমধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে। মার্চে এ অঙ্ক ছিল ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা (হার ২৪ দশমিক ১৩ শতাংশ)। এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩ লাখ ১৯ হাজার ৩৭ কোটি টাকা (জুন ২০২৪-জুন ২০২৫)।
২০২৪ সালের শেষে খেলাপি ও দুর্দশাগ্রস্ত ঋণ মিলে দাঁড়ায় ৭.৫৬ ট্রিলিয়ন টাকা (৭ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা), মোট ঋণের ৪৪ শতাংশ—প্রায় জাতীয় বাজেটের সমান।
ঋণ বাড়ার কারণ হচ্ছে অনিয়মিত ঋণ প্রদান, দুর্বল তদারকি, ধীর পুনরুদ্ধার, ঋণ নবায়নের পর আদায় না হওয়া এবং আন্তর্জাতিক মানে খেলাপি সংজ্ঞা কঠোর হওয়া। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে নামে-বেনামে নেওয়া ঋণ এখন খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে।
রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর বিশেষ করে এস আলম গ্রুপ নিয়ন্ত্রিত ব্যাংকগুলোর প্রকৃত চিত্র স্পষ্ট হয়েছে। ইসলামী ব্যাংকসহ ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, গ্লোবাল ইসলামী, ইউনিয়ন, সোশ্যাল ইসলামী ও এক্সিম ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে। এই পাঁচ ব্যাংককে একীভূত করার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
• রাজনৈতিক প্রভাবশালী গোষ্ঠীকে অস্বাভাবিক ঋণ দেওয়া।
• বাংলাদেশ ব্যাংকের দুর্বল তদারকি ও ধীর ঋণ পুনরুদ্ধার।
• আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে ঋণ শ্রেণিকরণ কঠোর হওয়া।
• এস আলম গ্রুপ-নিয়ন্ত্রিত ব্যাংকের প্রকৃত চিত্র উন্মোচিত হওয়া।
• ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতা ও আমানতকারীদের আস্থা কমছে।
• নতুন ঋণ বিতরণ ও বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
• অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানে ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।
• খেলাপি ঋণ আরও বাড়তে পারে।
• পাঁচ ব্যাংক একীভূত করার উদ্যোগে আংশিক স্থিতি আসতে পারে।
• দ্রুত সংস্কার না হলে আর্থিক খাত বড় ধরনের সংকটে পড়বে।
সদ্য বিদায়ী আগস্ট মাসে দেশে ২৪২ কোটি ২০ লাখ ডলারের প্রবাসী আয় এসেছে। গত বছরের আগস্টে এই আয় ছিল ২২২ কোটি ৪১ লাখ ডলার। ফলে বছরে প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ৯%। যদিও চলতি বছরের জুলাইয়ে প্রবাসী আয় ছিল ২৪৭ কোটি ৭৮ লাখ ডলার, অর্থাৎ মাসওয়ারি হিসাবে আগস্টে আয় কিছুটা কমেছে।
প্রবাসী আয় বাড়ার কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে: অর্থ পাচার ও হুন্ডি কমে আসা এবং ব্যাংকিং চ্যানেলে ডলারের বিনিময় হার স্থিতিশীল থাকা। বৈধ পথে আয় পাঠানো বাড়াতে সরকারি প্রণোদনাও ভূমিকা রেখেছে।
প্রবাসী আয়ের এই প্রবাহে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়ে ৩১ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। ৪ সেপ্টেম্বর দিন শেষে মোট রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৩১.১৮ বিলিয়ন ডলার। আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি (বিপিএম-৬) অনুযায়ী রিজার্ভ ছিল ২৬.১৯ বিলিয়ন ডলার।
তবে জুলাই ও আগস্ট মাসে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) আমদানি বিল পরিশোধ করা হয়েছে। ফলে রিজার্ভ এখন কমে দাঁড়িয়েছে ৩০ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলারে।
• হুন্ডি ও অবৈধ পথে অর্থ পাঠানো কমেছে।
• সরকারি প্রণোদনা ও বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠানোকে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে।
• ব্যাংকিং চ্যানেলে ডলারের বিনিময় হার স্থিতিশীল ছিল।
• বিদেশি দেনা পরিশোধ ও লেনদেনের ভারসাম্য উন্নত হয়েছে।
• রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর আমদানিনির্ভর খরচ কমেছে, বিদেশি ব্যাংকের আস্থা ফিরতে শুরু করেছে।
• বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আবার ৩১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে।
• ডলার বাজারে চাপ কমেছে, স্থিতি ফিরেছে।
• আমদানি খরচ মেটাতে রিজার্ভ ব্যবহারে স্বস্তি আসছে।
• সামগ্রিক অর্থনীতিতে ইতিবাচক সংকেত যাচ্ছে, বৈদেশিক আস্থা বাড়ছে।
• হুন্ডি নিয়ন্ত্রণ ও প্রণোদনা অব্যাহত থাকলে প্রবাসী আয় আরও বাড়তে পারে।
• তবে মাসওয়ারি ওঠানামা থাকবে (মার্চের মতো বড় অঙ্ক আবার দ্রুত না–ও আসতে পারে)।
• রিজার্ভ স্থিতিশীল থাকলে মুদ্রাবাজার আরও স্বস্তি পাবে।
• দীর্ঘ মেয়াদে টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য শ্রমবাজারে বৈচিত্র্যকরণ ও প্রবাসী আয়ের খরচ কমানো জরুরি।
• এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে শুল্ক সুবিধা হারিয়ে রিজার্ভে চাপ বাড়বে।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ তিন বছর পর প্রথমবারের মতো সামগ্রিক লেনদেন ভারসাম্যে (বিওপি) উদ্বৃত্ত হয়েছে, যার পরিমাণ ৩ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার (৩৪০ কোটি ডলার)।
এটি সম্ভব হয়েছে রেমিট্যান্স প্রবাহ ও রপ্তানি আয়ের শক্তিশালী অবস্থানের কারণে। একই সময়ে বাণিজ্যঘাটতি ৯ দশমিক ১ শতাংশ কমেছে। চলতি হিসাব, আর্থিক হিসাব এবং সামগ্রিক ভারসাম্য—সবকিছু এবার ইতিবাচক।
• রেমিট্যান্স বেড়েছে।
• রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি।
• আমদানি তুলনামূলক কম।
• মুদ্রাবাজার স্থিতিশীল হচ্ছে।
• বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ সহজ হচ্ছে।
এ ধারাবাহিকতা না থাকলে আবার ঘাটতিতে পড়ার ঝুঁকি আছে।
•কিছু শক্তি: রেমিট্যান্স, রপ্তানি, রাজস্ব প্রবৃদ্ধি
•বেশি দুর্বলতা: প্রবৃদ্ধি কমা, দারিদ্র্য বৃদ্ধি, খেলাপি ঋণ
•সামনে শঙ্কা: এলডিসি সুবিধা হারানো, ঋণের চাপ, বিনিয়োগ স্থবিরতা
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের জুলাই মাসে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ৫২ শতাংশ। এর আগের মাস জুনে প্রবৃদ্ধি ছিল সামান্য কম, ৬ দশমিক ৪৯ শতাংশ। এ হার বিনিয়োগ চাহিদা কম থাকার ইঙ্গিত দিচ্ছে। ব্যবসায়ীরা নতুন বিনিয়োগে সাহসী হচ্ছেন না; ফলে ঋণ বিতরণ ধীরগতিতেই রয়েছে।
তবে সরকারি খাতে নিট ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৪ দশমিক ৫১ শতাংশ। বাজেটঘাটতি পূরণ, ভর্তুকি ও বিভিন্ন প্রকল্পে ব্যয় সামলাতে সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে বেশি। এর ফলে সরকারি খাতের ওপর ব্যাংকনির্ভরতা বেড়েছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত করপোরেশন ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ প্রবৃদ্ধি বরং ঋণাত্মক (-২ দশমিক ৩৯ শতাংশ)। অর্থাৎ এ খাতের সংস্থাগুলো আগের ঋণ শোধ করেছে বা নতুন ঋণ গ্রহণ কমিয়েছে।
• উচ্চ সুদ, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও অনিশ্চিত চাহিদায় বেসরকারি বিনিয়োগ কমেছে।
• রাজস্ব আদায় বাড়েনি, বাজেটঘাটতি মেটাতে সরকারি খাত ব্যাংকঋণের ওপর বেশি নির্ভর করেছে।
• পুনর্গঠন ও ব্যয়সংকোচনের কারণে নতুন সরকারি ঋণ সীমিত হয়েছে।
• বিনিয়োগ না বাড়ায় কর্মসংস্থান ও উৎপাদন সীমিত হচ্ছে।
• সরকারি ঋণ বাড়ায় বেসরকারি খাতে ঋণ আরও সংকুচিত হতে পারে।
• সরকারি ঋণনির্ভরতা আর্থিক স্থিতিশীলতায় চাপ দিচ্ছে।
• রাজস্ব না বাড়লে সরকারি ব্যাংকঋণ আরও বাড়বে।
• এতে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে বিনিয়োগ ও হতে পারে।
• সুদ নিয়ন্ত্রণ ও রাজস্ব না বাড়লে ঋণপ্রবাহের ভারসাম্যহীনতা তীব্র হবে।
• বাজেট ও কর সংস্কার জোরদার হলে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়তে পারে।
আগস্টে মাসে রপ্তানি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২ দশমিক ৯৩ শতাংশ কম। এর মধ্যে তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে ৩১৭ কোটি ডলার, যা আগের বছরের আগস্টের তুলনায় ৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ কম।
চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে তৈরি পোশাক রপ্তানি আগের বছরের তুলনায় ২৪ দশমিক ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। কিন্তু আগস্টে আবার কমে গেল। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) মোট রপ্তানি হয়েছে ৮৬৯ কোটি ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১০ দশমিক ৬১ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে তৈরি পোশাক রপ্তানি ৭১৩ কোটি ডলার, প্রবৃদ্ধি ৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ।
অন্য পণ্যের মধ্যে আগস্টে চামড়া ও চামড়াজাত, প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য, চামড়াবিহীন জুতা ও আসবাবের রপ্তানি কমেছে। তবে হোম টেক্সটাইল, পাট ও পাটজাত, হিমায়িত খাদ্য, প্লাস্টিক ও প্রকৌশল পণ্যের রপ্তানি বেড়েছে।
রপ্তানিকারকেরা বলছেন, নিয়ে কয়েক মাস দর-কষাকষি চলায় ক্রয়াদেশ কম এসেছিল। তাই আগস্টে রপ্তানি কমে গেছে। তবে শুল্কহার চূড়ান্ত হওয়ায় ক্রেতারা এখন নতুন ক্রয়াদেশ দিতে আলোচনা শুরু করেছে।
• যুক্তরাষ্ট্রে পাল্টা শুল্ক নিয়ে অনিশ্চয়তায় ক্রয়াদেশ বিলম্বিত হয়েছে।
• মৌসুমি ধারা অনুযায়ী জুলাই-সেপ্টেম্বরে পোশাক রপ্তানি কম থাকে।
• জুনে পতনের পর জুলাইয়ে প্রবৃদ্ধি এলেও তা টেকেনি; আগস্টে অর্ডার ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
• চামড়া, কৃষিপণ্যসহ কিছু খাতে সাময়িক মন্দা।
• আগস্টে সার্বিক রপ্তানি প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক হয়েছে।
• তৈরি পোশাক খাতের ওপর নির্ভরশীলতা আবারও স্পষ্ট হয়েছে।
• হোম টেক্সটাইল, পাটজাত ও প্রকৌশল পণ্যে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি, যা কিছুটা ভারসাম্য এনেছে।
• রপ্তানিকারকেরা অর্ডার অনিশ্চয়তায় উৎপাদন পরিকল্পনা কমাচ্ছে।
• যুক্তরাষ্ট্রে শুল্কহার চূড়ান্ত হওয়ায় ক্রেতারা নতুন অর্ডার দেবে, ফলে সেপ্টেম্বরে প্রবৃদ্ধি বাড়তে পারে।
• তৈরি পোশাকের বাইরে চামড়া, কৃষিপণ্য ও হোম টেক্সটাইল খাতে সম্ভাবনা আছে।
• রপ্তানি ধরে রাখতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, ক্রেতা আস্থা এবং বাজার বৈচিত্র্য বাড়াতে হবে।
• এলডিসি সুবিধা হারালে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ঝুঁকিতে পড়বে।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে মোট আমদানি ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৬৮ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় মাত্র ২ দশমিক ৪ শতাংশ বেশি।
মূলধনি যন্ত্রপাতি ও মধ্যবর্তী পণ্যের আমদানি কমেছে, যা বিনিয়োগ স্থবিরতার ইঙ্গিত দেয়। ভোগ্যপণ্য আমদানিও প্রায় স্থিতিশীল। তবে পেট্রোলিয়াম ও শিল্প কাঁচামালের আমদানি বেড়েছে।
• পেট্রোলিয়াম আমদানি বেড়েছে।
• কিন্তু মূলধনি যন্ত্রপাতি ও মধ্যবর্তী পণ্য কমেছে।
• শিল্পে বিনিয়োগ কমছে।
• উৎপাদনশীলতা সীমিত হচ্ছে।
আমদানি না বাড়লে প্রবৃদ্ধি দীর্ঘ মেয়াদে চাপে পড়বে।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে রাজস্ব আদায় গত বছরের তুলনায় ২৪ শতাংশ বেড়েছে। তবে মাসিক লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ২৮ দশমিক ৫ বিলিয়ন টাকা (২,৮৫০ কোটি টাকা) ঘাটতি রয়ে গেছে।
সরাসরি কর এখনো মোট রাজস্বের মাত্র ২৩ শতাংশ, বাকি নির্ভর করছে ভ্যাট ও শুল্কের ওপর। ফলে করকাঠামো এখনো অত্যন্ত পরোক্ষভিত্তিক। এ কারণে রাজস্ব আয় টেকসইভাবে বাড়ানো কঠিন হয়ে পড়ছে।
• বিলম্বিত বিল জমা হওয়ায় ‘লো বেস ইফেক্ট’।
• ভ্যাট ও শুল্কের অবদান বেশি।
• মাসিক লক্ষ্যমাত্রায় ঘাটতি রয়ে গেছে।
• সরাসরি কর কম থাকায় কাঠামো দুর্বল।
কর সংস্কার ছাড়া এ প্রবৃদ্ধি টেকসই নয়।
নতুন অর্থবছরের প্রথম মাসে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র শূন্য দশমিক ৬৯ শতাংশ, যা গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য এডিপি খরচ ধরা হয়েছে আরও বাস্তবসম্মত পর্যায়ে, তবু বাস্তবায়নের ধীরগতি উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। বিশেষ করে অবকাঠামো ও স্বাস্থ্য খাতের ব্যয় কমে যাওয়ায় প্রবৃদ্ধি চাপের মুখে পড়তে পারে।
• অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যয় নিয়ন্ত্রণ।
• প্রকল্প অনুমোদন ও টেন্ডারে ধীরগতি।
• অবকাঠামো প্রকল্প পিছিয়ে যাচ্ছে।
• প্রবৃদ্ধি বাড়াতে সরকারের অবদান কমছে।
বাস্তবায়ন ধীর থাকলে কর্মসংস্থানে সংকট তীব্র হবে।
২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ দাঁড়িয়েছে ১০৪ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে সরকারি খাতের অংশ ৮১ শতাংশ। শুধু ২০২৪-২৫ অর্থবছরেই বিদেশি ঋণ পরিশোধ হয়েছে রেকর্ড ৪ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার—প্রায় ২১ শতাংশ বেশি। ঋণের সুদ ও কিস্তি বেড়ে যাওয়ায় বৈদেশিক ঋণের চাপ বাড়ছে। একই সময়ে নতুন ঋণ প্রতিশ্রুতিও কমে গেছে।
• বড় অবকাঠামো প্রকল্পে ধারনির্ভরতা।
• বৈদেশিক ঋণের সুদ ও কিস্তি বেড়েছে।
• বছরে ৪.১ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে হচ্ছে।
• রাজস্বের ওপর চাপ বাড়ছে।
ঋণ ব্যবস্থাপনা শক্ত না হলে খেলাপি হওয়ার ঝুঁকি বাড়তে পারে।
সূত্র: বাংলাদেশ মাসিক সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, জুন–জুলাই ২০২৫: পিআরআই; বাংলাদেশ ব্যাংক; বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো।