Advertisement

গুম কমিশনের প্রতিবেদনে নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র

কালবেলা

প্রকাশ: ১ জুলাই, ২০২৫

গুম কমিশনের প্রতিবদনের প্রচ্ছদ। ছবি : সংগৃহীত
গুম কমিশনের প্রতিবদনের প্রচ্ছদ। ছবি : সংগৃহীত

শেখ হাসিনা সরকারের আমলে রাজনীতিবিদসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ গুমের শিকার হন। তাদের বিভিন্নভাবে নির্যাতন করা হয়। সেই নির্যাতন কতটা ভয়াবহ ছিল- এক প্রতিবেদনে তা তুলে ধরেছে গুম কমিশন। পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় একটি গোয়েন্দা সংস্থা ও নিরাপত্তা বাহিনীর বিশেষায়িত একটি ইউনিটের সহযোগিতায় এই নির্যাতন চালানো হতো বলে জানানো হয়েছে প্রতিবেদনে।

১। সর্বব্যাপী অস্বস্তি

প্রতিবেদনে বলা হয়, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের সম্মিলিত প্রভাবে ভুক্তভোগীরা দীর্ঘ সময় ধরে চরম অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গিয়েছেন। তাদের প্রায়ই প্রহরীদের অর্ধেক পরিমাণ খাবার দেওয়া হতো। হাতকড়া পরিয়ে ও চোখ বেঁধে একাকী সেলে রাখা হতো। নিজের ভাগ্য কী হবে সে অনিশ্চয়তার সঙ্গে এই কঠোর অবস্থার সম্মিলন তৈরি করত এক ধরনের নিরবচ্ছিন্ন মানসিক চাপ।

প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়, গুমের এই প্রক্রিয়া ভয় ও অপমানের একটি সংস্কৃতির সাথে একত্রে কাজ করত, যেখানে শরীরের স্বাভাবিক কাজ করাও পরিণত হতো আরেক ধরনের নিপীড়নের অভিজ্ঞতায়।

১-ক। থাকার স্থানের ভয়াবহ ও অমানবিক অবস্থা

এতে একাধিক ভুক্তভোগীর তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছে গুম কমিশন। নাম প্রকাশ না করা ৪৬ বছর বয়সী এক ব্যক্তির বরাত দিয়ে জানানো হয়, ২০১৫ সালে তাকে তুলে নেওয়া হয়। তখন থেকে ৩৯১ দিন তাকে গুম রাখা হয়।

সেই ভুক্তভোগীর ভাষায়, “…ঘুমাতে নিলে, একজন আইসা বলতেছে, ‘এই ঘুমাতেছেন কেন?’ মানে ঘুমাতে দিত না। ... জিজ্ঞাসাবাদ শেষে যাওয়ার পরে বালিশ সরিয়ে ফেলতো। একদম শীতের মধ্যে কম্বল-বালিশ সব সরাই ফেলছে। ... আর এমনি শাস্তি দিতো। চেয়ার ছাড়া [খালি পায়ের ওপর ভর দিয়ে] বসায় রাখতো। ... আবার দেখা গেছে, হ্যান্ডকাপ পরায় বিছানার পাশ আটকে দিয়ে রাখতো। তা আমার এই হাতে মশা হইলে আমি তো মারতে পারতাম না। মশা কামড়াইতো। ... তো কষ্ট পাইতাম আর কি। এরকম শাস্তি দিছে আর কি।…”

১-খ। গোপনীয়তাহীন, অস্বাস্থ্যকর ও অপমানজনক সেল জীবন

গুম কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, গোপনীয়তাহীন, অস্বাস্থ্যকর ও অপমানজনক সেল জীবন ছিল গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের জন্য। পুরুষ ভুক্তভোগীদের জন্য সেলের ভেতরে গোপনীয়তার অভাব ছিল বিশেষভাবে নির্মম। সেলগুলো ছিল ক্ষুদ্র ও সংকীর্ণ। সেলে টয়লেট ব্যবহারের জন্য নিচু বিল্ট-ইন প্যান বসানো ছিল। তবে, মাঝে কোনো দেয়াল না থাকায়, ভুক্তভোগীরা যখন শুয়ে থাকতেন, তখন তাদের শরীর প্রায়ই ওই প্যানের উপরেই পড়ে থাকত। যার ফলে তারা ময়লা, প্রস্রাব ও মলের অস্বাস্থ্যকর অবস্থার মধ্যে থাকতে বাধ্য হতেন।

এতে আরও বলা হয়, আরও ভয়াবহ ছিল, এসব সেলে স্থাপন করা সিসিটিভি ক্যামেরা, যা প্রতিটি কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করত। ফলে ভুক্তভোগীদের সবচেয়ে ব্যক্তিগত মুহূর্তেও, যেমন প্রাকৃতিক কাজের জন্য টয়লেট প্যান ব্যবহারের সময়ও, চরম অপমান ও লজ্জার মধ্যে থাকতে হতো।

১-গ। নারীদের জন্য বিশেষ শাস্তি

প্রতিবেদনে বলা হয়, নারীদের জন্য ছিল বিশেষ শাস্তি। ২০১৮ সালে গুম হওয়া ২৫ বছর বয়সী এক তরুণীর বরাত দিয়ে এতে বলা হয়, “অনেকটা ক্রুসিফাইড হওয়ার মতো করে হাত দুই দিকে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখছে। ওরা আমাদের ওড়না নিয়ে নিছিল; আমার গায়ে ওড়না ছিল না। আর যেহেতু জানালার দিকে মুখ করা ছিল, অহরহ পুরুষ মানুষ যে কতগুলা আসছে দেখার জন্য এটা বলার বাহিরে। মানে তারা একটা মজা পাচ্ছে। বলাবলি করতেছিল যে, ‘এমন পর্দাই করছে, এখন সব পর্দা ছুটে গেসে। … আমার পিরিয়ড হওয়ার ডেট ছিল অনেক লেটে। কিন্তু যেই টর্চার করে তাতে আমি এত পরিমাণ অসুস্থ হয়ে যাই যে, সাথে সাথে আমার পিরিয়ড আরম্ভ হয়ে যায়। তারপর উনাদেরকে বলি যে, ‘আমার তো প্যাড লাগবে’- এটা নিয়ে অনেক হাসাহাসি করে ওরা।”

২। নির্মম প্রহারের অভিজ্ঞতা

গুম কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রহার ছিল নির্যাতনের সবচেয়ে সাধারণ ও সর্বব্যাপী রূপ। প্রায় প্রতিটি স্থানে এবং প্রায় প্রতিটি ভুক্তভোগীর ক্ষেত্রেই এটি ঘটেছে; এমনকি তাদের ক্ষেত্রেও, যাদের ওপর অন্য কোনো ধরনের নির্যাতন প্রয়োগ করা হয়নি।

২০২৩ সালে গুম হওয়া ৪৭ বয়সী এক ব্যক্তির অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করা হয়েছে প্রতিবেদনে। ভুক্তভোগীর ভাষায় “…চোখে কখনো গামছা দিয়া, কখনো ওই যে জম টুপি, এগুলা দিয়ে বাঁধা থাকতো। হাত কখনো সামনে, কখনো পিছনে। আর যখন বেশি মারবে, তখন এই হাত পিছনে দিয়ে রাখতো আর আমার এই কনুইগুলো, দুই হাঁটু এগুলোতে খুব জোরে জোরে মারতো মোটা লাঠি দিয়ে। ... তো আমি মনে করতাম যে, আমার হাড়গুলো বুঝি ভেঙে যাবে, কিন্তু পরবর্তীতে দেখলাম যে ফুলে অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গেছে, কিন্তু হাড় ভাঙছে এরকম বুঝি নাই। ... এক পর্যায়ে আমাকে বলল যে, “তোর হাড় থেকে মাংস আলাদা করে ফেলবো।...”

২-ক-১। স্থায়ী আঘাতের চিহ্নসমূহ

নির্যাতনের ফলে স্থায়ী আঘাতের চিহ্নগুলো ফুটে উঠতো। ২৩ বছর বয়সী এক যুবককে ২০১৭ সালে অপহরণ করা হয়। এরপর থেকে টানা ৭২ দিন চলে নির্মম নির্যাতন। টর্চারের কারণে তার নাভির দুই পাশে আঘাতের চিহ্ন সৃষ্টি হয়।

ভুক্তভোগীর কথায় “…আমার পা বেঁধে উপর দিকে করে ঝুলাইছে। মাথা নিচের দিক, পা উপর দিক দিয়ে। আমার শরীরে কোনো পোশাক রাখে নাই তখন, একেবারে উইদাউট ড্রেস। তারপরে এলোপাতাড়ি আমাকে দুজনে একসঙ্গে পিটাতে থাকে। খুব সম্ভব বেতের লাঠি দিয়ে। পরবর্তীতে আমাকে অসংখ্যবার টর্চার করেছে এবং মারতে মারতে আমার এমন হয়েছে, চোখের কাপড় খুলে গেছে। নাকে-মুখে চড়ানো, থাপড়ানো। ... শুধু পিছে মারছে। ওই সময়ে চামড়া ছিঁড়ে, মানে চামড়া ফেটে রক্ত ঝরে গেছে। ...”

২-ক-২। স্থায়ী আঘাতের চিহ্নসমূহ

২৫৩ দিন যাবত গুম থাকা ৪৬ বছর বয়সী এক ব্যক্তির বরাতে বলা হয়, টানা প্রায় ২৪ ঘণ্টা ধরে নির্যাতন করা হয়েছিল তাকে। নির্যাতনকারীরা পালাক্রমে চার ঘণ্টার শিফটে তাকে মারধর করত। তার শরীরজুড়ে এখনো স্থায়ী আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। এই নির্যাতনের ঘটনা একজন সহবন্দি নিশ্চিত করেছেন, যিনি সেই সময় তার কষ্ট স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছিলেন।

২-খ। ছাদের সাথে ঝুলিয়ে নির্যাতন

বন্দিদের উপর যে নির্মম শারিরীক নির্যাতন চালানো হতো, তার মধ্যে একটি ছিল ছাদের সাথে ঝুলিয়ে নির্যাতন। গুম হওয়া ৪৭ বছর বয়সী এক ব্যক্তি বলেন, “… বলতেছে, ‘এভাবে হবে না। এরে লটকা। টানাইতে হবে।’ তো একজন এএসআই লোক হবে, ও আমাকে দুই হাতে রশি লাগায়া ওই যে ফ্যানের হুক থাকে ছাদের মধ্যে, এটার মধ্যে ওর রশি দিয়ে এরকম ঝুলাইলো। শুধু পায়ের বুড়ো আঙ্গুলটা লাগানো থাকে মেঝেতে আর পুরা শরীরটা ঝুলানো। ... হাত এখনও উঠাতে পারি না, আমার দুইটা জোড়ার মধ্যে সমস্যা হয়ে গেছে। ...”

২-গ। উল্টো করে ঝুলিয়ে নির্যাতন

ভুক্তভোগীর হাত ও পা বেঁধে শরীরকে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা হতো। এই ধরনের নির্যাতন সামরিক বাহিনীর চেয়ে পুলিশের মধ্যে বেশি প্রচলিত ছিল। ২০১৯ সালে ৪২ দিন গুম হওয়া এক যুবকের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরা হয় প্রতিবেদনে। তিনি বলেন, “… হাত সম্ভবত গামছা বা কাপড় দিয়া বানছে আর কি। বাইনদা, আমার এই হাঁটুর ভিতরে দিয়া হাত ঢুকাইয়া এই দুই হাঁটুর মাঝখান দিয়া লাঠি ঢুকাইয়া একটা উঁচু কোন স্ট্যান্ডের মধ্যে রাখছে। যেটার কারণে আমার পাগুলো উপরে ছিল। আর মাথা নিচু হয়ে গেছে। ... পায়ের তালুর মধ্যে এবার বাড়ি শুরু করছে। চিকন একটা লাঠি হবে সম্ভবত। ... আবার ওই প্রথম থেকে একই প্রশ্ন, “নামগুলা বলো, তোমার সাথে কে কে আছে। ...”

২-ঘ। নখ উপড়ে ফেলা

প্রতিবেদনে বলা হয়, নির্যাতনের একটি পদ্ধতি হিসেবে প্রায়ই নখ উপড়ে ফেলা হতো। ৫৬ দিন গুম থাকা এক ব্যক্তি বলেন, “… তো আলেপ উদ্দিন- পরে নাম জানতে পারছি, তখন জানতাম না- সে লাঠি নিয়ে খুব টর্চার করল। ... একদিন আমাকে বেশি টর্চার করল। টর্চার করে বলল যে, তাকে টাঙ্গায় রাখো, ঝুলায় রাখো। তো সেলে গ্রিল আছে না? রডগুলা যে আছে ... [ওগুলার সাথে] আমাকে এমনে ঝুলায় রাখলো।... হাতকড়ার সাথে বাইন্ধা রাখলো। ... তো এইভাবে অনেক ঘণ্ট রাখার পরে আমি আর পারছি না। ওইদিন পরে যখন টর্চার করলো, আঙুলের নখটা উঠে গেছিল পুরা। ...”

২-ঙ। নখের নিচে সূচ ঢুকিয়ে নির্যাতন

নখের নিচে সুচ ঢুকানো ছিল একটি সাধারণ ও নিয়মিত নির্যাতনের কৌশল। ২৭ বছরের এক যুবকের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরা হয় প্রতিবেদনে। তার ভাষায়, “… গ্রিলের মধ্যে হ্যান্ডকাফ দিয়ে আমাকে দাঁড় করিয়ে রাখত। আমি যাতে বসতে না পারি। দাঁড় করিয়ে রাখত। পা এমন ফুলে গেছে আমার। আমার হাতে দাগ পড়ছে। এই যে দাগগুলো... ওয়াশরুমে যেতে চাইলে, ওয়াশরুমে যেতে দিত না। এই অত্যাচার শুরু হয়ে গেল। … এর মধ্যে একদিন এনে আঙুলটাকে এভাবে প্লাস দিয়ে ধরছে। ধরার পরে টেবিলের উপরে হাত রেখে, প্লাস ধরে, আরেকজন সুচ ঢুকাইছে। এই যে সুইয়ের দাগ। কয়, “তুই আব্দুল মুমিন না?” “স্যার, আমি আব্দুল মুমিন না, আমার নাম হলো হাবিব।…”

২-চ। বাঁশ দিয়ে নির্যাতন (বাঁশ ডলা)

৩৯ দিন গুম থাকা আরেক যুবকের ভাষায়, “… শোয়ানোর পরে আমার এই দুহাতের উপর দিয়া আর ঘাড়ের নিচে দিয়া একটা বাঁশ দিছে। তার পরবর্তীতে পায়ের নিচে, রানের নিচে দিয়ে একটা দিল, আবার রানের উপরে দিয়েও একটা দিছে। দেওয়ার পরে এরা ওইভাবে আমাকে কিছুক্ষণ রাখলো যে, “বড় স্যার আসতেছে না।” পরে কিছুক্ষণ পরে সে আসছে। আসার পরে হঠাৎ করেই বললো, “এই উঠো।” বলার সাথে সাথে আমি মনে করলাম যে, আমি আর দুনিয়ার মধ্যে নাই। মানে এ রকমের যন্ত্রণা আমার এই দুই হাতের বাহুতে শুরু হইছে, আর দুই পায়ের মধ্যে শুরু হইছে। আমার মনে হইতেছে কেউ আমার এই দুই হাতের আর পায়ের গোস্তগুলো ছিঁড়া ফেলতেছে।...”

৩। বৈদ্যুতিক শক

গুম কমিশনের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, নির্যাতনের দ্বিতীয় সর্বাধিক প্রচলিত পদ্ধতি ছিল বৈদ্যুতিক শক দেওয়া। সম্ভবত যন্ত্রপাতি সহজলভ্য হওয়ার কারণেই এর ব্যবহার এত ব্যাপক ছিল। এটি প্রায় সব স্থানেই ব্যবহৃত হতো, এমনকি অপহরণকারী যানবাহনেও, যেখানে এটি সহজে বহনযোগ্যভাবে ব্যবহৃত হতো।

৪৬ দিন গুম থাকা এক ব্যক্তির ভাষায়, “… পায়ে দুইটা ক্লিপ লাগায় দিল ... ফার্স্ট সেবার শক খাওয়ার অভিজ্ঞতা। মনে হচ্ছে যখন শক দেয়, টোটাল শরীরটা আমার ফুটবলের মত গোল হয়ে যায়। এরকম আট দশবার মেবি আমাকে শক দিছে। শকটা হয়তো তিন-চার সেকেন্ড সর্বোচ্চ থাকে। তাৎক্ষণিক শরীরটা গোল হয়ে যায়, সমস্ত রগগুলো চেপে ধরে। তো ওই প্রশ্নগুলো করে আর শক দেয়, প্রশ্নগুলো করে আর শক দেয়। ... খুবই বেপরোয়াভাবে চার-পাঁচ জন পিটানি শুরু করল, দুই হাত ধরে ওই হুকের উপর লাগায় দিয়ে। মনে হচ্ছে হয়তো কিছুতে সুইচ টিপছে, অটোমেটিক আমার শরীরটা উপরে উঠে যাচ্ছে। ... এই মুহূর্তে আমার কাপড় খুলে, আবার ওই একই ক্লিপ লাগায় দেয় আমার গোপন দুইটা অঙ্গে। এবং ওই জিজ্ঞাসাবাদ সেম চলতে থাকে। যখনই সুইচ দেয়, আমার মনে হয়েছে যে, আমার সে অঙ্গগুলো পুড়ে যাচ্ছে ... এবং মাঝে মাঝে আমি গোস্ত পুড়লে যেরকম একটা গন্ধ লাগে, সেই গন্ধটা পাইতাম আর কি। ...”

৪। ওয়াটারবোর্ডিং

২০১৭ সালে গুম হওয়া এক যুবকের ভাষায় “… মুখের উপরে গামছা দিয়া উপরে দিয়া পানি মারা শুরু করে দিছে। ... পানি দিতেছে, জগ ভরতি ... আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাইতেছে। ... তারপর ওরা ওই গামছা সরাইয়া বলে, “বল কি করছিস?” “স্যার, কি কমু? আপনি আমারে বলেন, আমার কি জানতে চান? আপনি আমারে কেন ধইরা আনছেন?” তখন বলতেছে, “না, ওরে হইতো না। আবার গামছা দে, আবার গামছা দে, আবার পানি দে।”এইভাবে তিন-চারবার পানি দেওয়ার পরে বলছে, “ওরে নিয়া রাইখা আয়।...”

৫। নির্যাতনের জন্য ব্যবহৃত ঘূর্ণায়মান যন্ত্র ও চেয়ার

প্রতিবেদনে বলা হয়, নির্যাতনের জন্য ব্যবহৃত হতো ঘূর্ণায়মান যন্ত্রপাতি। যে সম্পর্কে একাধিক বিবরণ পেয়েছে গুম কমিশন। সাক্ষ্য বিশ্লেষণ করে দুটি ভিন্ন ধরনের যন্ত্রের অস্তিত্ব তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনটিতে।

৫-ক। ঘূর্ণায়মান চেয়ারের মাধ্যমে নির্যাতন

২৮ বছর বয়সী এক যুবকের নির্যাতনের কথা উল্লেখ করে বলেন, “… একটা মেশিনে উঠাইছিল। উঠাই এইখানে [মাথায়] বাঁধছে, এইখানে [হাতে] বাঁধছে, পায়ে বাঁধছে, মানে হাঁটুর মিডলে, এইখানে আবার পায়ের নিচেও বাঁধছে। এরকম সোজা দাঁড়ানো। ওই মেশিনটায় উঠায় চালানোর পরে মনে হইছে যে, আমার হাড় সম্পূর্ণ যেন আলাদা হয়ে যাচ্ছে। ... কেন বলতে পারবো না, ওটার সেটিং এরকম যে, মেশিনটাই একটা আজাব। ... ওরা বলছে যে, “তুমি পিঠ একেবারে লাগাইয়া রাখো। এখানে উঠলে কিন্তু সব পায়খানা করে দেয়।” মানে এমন কঠিন অবস্থা ওইখানে। ... মেশিনটা ঘোরানো যায়। কখনো কখনো উল্টা করানো যায়। আবার এরকম ফ্ল্যাট শোয়ানো যায়। ... এরপর ওইখানে থাকা অবস্থায় হাঁটুর উপর বাড়ি দিছে। যেমন জিজ্ঞেস করছে, “তুমি সরকারের বিরুদ্ধে কি কি ষড়যন্ত্র করতেছো? ...”

৬। যৌনভিত্তিক নির্যাতন

যদিও যৌনভিত্তিক নির্যাতনের ঘটনা ছিল, ভুক্তভোগীরা এসব অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে অনিচ্ছুক হওয়ায় সেগুলো নথিভুক্ত করা কঠিন হয়েছে। তা সত্ত্বেও, একাধিক বিশ্বাসযোগ্য ঘটনার সাক্ষ্য পেয়েছে গুম কমিশন, যেখানে নির্যাতনের নির্দিষ্ট লক্ষ্য ছিল ভুক্তভোগীদের যৌনাঙ্গ।

২০১৮ সালে গুম হয়ে ২০৮ দিন থাকা এক ব্যক্তির ভাষায়, “… এক পর্যায়ে তারা আমার মানে অন্ডকোষে জোরে চাপ দেয়, আমার শক্তি শেষ হয়ে যায়।...”

৬-ক। প্রস্রাবের সময় বৈদ্যুতিক শক

৪৫ দিন গুম থাকা আরেক তরুণ বলেন, “… একটা যে কঠিন শাস্তি দিছে, সে শাস্তিটা হইলো একটা অন্যরকম। আমার তো চোখ বাঁধা, আমার কিন্তু চোখ বাঁধা। আমারে ধইরা নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে ওইদিন, পিটনা দেওয়ার পরে আবার জিজ্ঞাসাবাদ করতেছে। তখন আমি বুঝি যে, আজকে আমার জীবন শেষ। জিজ্ঞাসাবাদ করার পরে কইতেছে, “এখানে প্রস্রাব কর। এখন এখানে প্রস্রাব কর।” প্রস্রাব করার সাথে সাথে আমি অনুমান করছি যে, আমি মনে হয় পাঁচ ফিট উপরে উঠছি, একটা ফাল দিয়া, ইলেকট্রিক শক সবচেয়ে বড় কোন স্থানে।...”

৬-খ। যৌনাঙ্গে বৈদ্যুতিক শক

২০১৪ সালে গুম এক ব্যক্তি বলেন, “… তখন ওরা কিল-থাপ্পড় মারে। প্যান্ট খুলে ফেলে। প্যান্ট খুলার পর, আমার একটা বিচির সঙ্গে ক্লিপ লাগায়। গাড়ির মধ্যে উঠে দরজা বন্ধ করে দিছে। প্রায় ছয়-সাতজন হবে, চোখ বাঁধা অবস্থায় যা বুঝলাম। কথা বলতেছে, তারপর গাড়ি ছেড়ে দিল, ছেড়ে দিতে দিতে আমার প্যান্ট অলরেডি খোলা শেষ। খুলে, ক্লিপ দিয়ে কারেন্ট শক দেওয়া শুরু হয়ে গেছে। গাড়ির মধ্যে খুব চেঁচাচ্ছি ... দুই পা সামনের সিটে লাফানোর কারণে আমার প্রায় এক ফুট করে দুই পায়ে ছিলে যায়। কিন্তু ওইটার ব্যথা কিছু মনে হয়নি। কারেন্ট শকের ব্যথা এতটা ভয়ঙ্কর। ... প্রায় ১৫ থেকে ২০ মিনিট কারেন্ট শক দিল। এই ২০ মিনিটে গাড়ি চলতেছিল ... এরকম করতে করতে যখন থামলো, মনে হইলো যে দুনিয়া দুনিয়া নাই। কারেন্ট শক বন্ধ করার পরে তিন মিনিট ধরে আমি চেঁচাইছি। লাস্টে বাধ্য হয়ে ওরা মুখ চেপে ধরে। ওই কারেন্ট শকের কষ্টে। ...”

ভুক্তভোগীর ওপর দীর্ঘ মেয়াদী প্রভাব

গুম কমিশেনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মুক্তির পরও নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিরা দীর্ঘমেয়াদি মানসিক ট্রমার স্পষ্ট লক্ষণ বহন করেন। তাদের চলমান চিকিৎসা ও মনোস্বাস্থ্য সহায়তার প্রয়োজন হয় এবং অনেকের শিক্ষা ও কর্মজীবন ব্যাহত হয়।

প্রতিবদনে বলা হয়, এর সঙ্গে যুক্ত হয় নিরাপত্তা বাহিনীর দায়ের করা ভুয়া মামলাগুলোর আইনি লড়াইয়ের ব্যয়; প্রতিটি মামলার জন্য একজন ভুক্তভোগীর গড়ে প্রায় ৭ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। অনেকের পারিবারিক জীবন, যেমন বিয়ে ও সন্তান-সম্পর্কিত বিষয়, মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরিবারগুলো এই চাপ সহ্য করতে পারে না, ফলে ভুক্তভোগীরা এক অনিশ্চয়তা ও প্রান্তিকতার জীবনে আটকে পড়েন।

প্রায় দুই বছর গুম থাকা এক যুবকের পিতার ভাষ্যমতে “… ছেলেটা এতিম, মায় মারা গেছে। লেখাপড়া করত, সব শেষ। … [গুম থেকে ফেরার পর] ও বসে থাকতো, হঠাৎ রেগে যাইতো। কেউ কথা জিগাইলেই থাপড় দিত। … এখন ও খালি একা একা হাসে, কিছু কইলে ফেনায়, ঠিকমতো কথা কয় না। আগের মতো না। ডাক্তার দেখাইলাম, ওষুধ দেয়, খায় না। কয় শরীর কাঁপে, ঘুমে ধরে। ওষুধ ফালায় দেয়। ডাক্তার কয়, নিয়মমতো ওষুধ খাওয়াইতে হইবো।

এই হইলো ঘটনা। আমার ছেলে পাইলাম, এইটাই বড় কথা। সবাই কয়, ‘যা হইছে হইছে, এখন খাইয়া-পইরা বাঁচ।’ কিন্তু আমি জানি কত কথা হজম কইরা এই পর্যন্ত আইছি। এখন আমি আর উকিলের কাছেও যাই না, কারণ টাকা-পয়সার অভাব। ...”

গুম কমিশন জানায়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীদের আটকের কোনো আনুষ্ঠানিক রেকর্ড থাকত না। এর ফলে নিরাপত্তা বাহিনীগুলো দায়মুক্তভাবে নির্যাতন চালাতে পারত। পরবর্তীতে জনসমক্ষে হাজির করার আগে নির্যাতনের চিহ্ন লুকাতে কিছু ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীদের ওষুধ বা মলম দেওয়া হতো, যাতে ক্ষতচিহ্ন সহজে নজরে না আসে। অনেক ক্ষেত্রে নির্যাতনের চিহ্ন মুছে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেই তাদের মুক্তি দেওয়া হতো।

Lading . . .