Advertisement

হাটে শুধু গরু-ছাগল থাকে না, থাকে আরও কত শত গল্প

প্রথম আলো

প্রকাশ: ১৪ জুন, ২০২৫

বিক্রির জন্য সারি ধরে সাজিয়ে রাখা হয়েছে কোরবানির গরু। মৌলভীবাজার সদর উপজেলার দীঘিরপার বাজারেছবি: প্রথম আলো
বিক্রির জন্য সারি ধরে সাজিয়ে রাখা হয়েছে কোরবানির গরু। মৌলভীবাজার সদর উপজেলার দীঘিরপার বাজারেছবি: প্রথম আলো

মৌলভীবাজার সদর উপজেলার আমতৈল ইউনিয়নের চেনা হাট দীঘিরপার বাজারে এখন ভিন্ন এক পরিবেশ তৈরি হয়েছে। হাটটির বয়স শত বছর পেরিয়ে গেছে। কোনো উৎসব-উপলক্ষ ছাড়াই গরু বেচাকেনার জন্য এই হাটের আলাদা পরিচিতি আছে। পবিত্র ঈদুল আজহার মতো উৎসবকে সামনে রেখে সেই পরিচিতি যেন আরও অনেকটা বেড়ে গেছে।

মঙ্গলবার অনেকটা শেষ বিকেলের দিকে দীঘিরপার বাজারে পৌঁছালে তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। সাপ্তাহিক হাটবার সেদিন। তত সময়ে বাজার মানুষে মানুষে সয়লাব হয়ে গেছে। অনেক ধরনের মানুষের ভিড়। বাজারের ভেতর দিয়ে দুই দিকে গ্রামীণ সড়ক গেছে। বাজারের মধ্যে সড়ক কিছুটা ভাঙাচোরা, গর্ত; তাতে বেশ পানি জমে আছে। সড়কগুলোয় পা ফেলার উপায় নেই। ছোট-বড় গাড়িতে তৈরি হয়েছে জট। সাধারণ মানুষ নিজেরাই এগিয়ে এসে জট খোলার চেষ্টা করছেন, গাড়িকে পথ করে দিচ্ছেন। সড়কে স্বাভাবিক গতিতে গাড়ি চলার ব্যবস্থা করছেন।

হাটের বাইরে সড়কের দুই পাশে দাঁড়িয়ে আছে পিকআপ ভ্যান, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, প্রাইভেট কারসহ বিভিন্ন ধরনের যানবাহন। বাজারের ভেতরে গলিগুলোয় আনাজ-তরকারি, আম-কাঁঠালসহ কিছু মৌসুমি ফল, মাছ-শুটকি ও অন্যান্য পণ্য নিয়ে বসেছেন অনেকে। তাঁরা সব হাটবারে এভাবেই পণ্য সাজিয়ে বসেন। মৌলভীবাজার জেলা শহর থেকে পশ্চিমে এই হাটের দূরত্ব খুব বেশি নয়, চার থেকে পাঁচ কিলোমিটার। এই অঞ্চলের মানুষ প্রতিদিনই সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি, স্কুল-কলেজে আসা-যাওয়াসহ নিয়মিত শহরে আসা-যাওয়া করেন। তবু দীঘিরপার বাজার তার পুরোনো গ্রামীণ রীতিনীতি, নিয়মেই চলছে।

মিষ্টি আলু, তরকারির আলু ও মিষ্টি কুমড়া নিয়ে হাটের এক পাশে বসে ছিলেন স্থানীয় বারোহাল গ্রামের সবর উল্লাহ (৬৫)। তিনি জানালেন, দীঘিরপার বাজার আজকালের নয়। অনেক পুরোনো। তা ১০০ বছরের বেশি হবে। আগে শণ-বাঁশের কিছু দোকান ছিল। এখন সব পাকা হয়ে গেছে। দোকানের পরিসর বেড়েছে।

স্থানীয় কয়েকজন বলেন, প্রতিদিনই কমবেশি বাজার বসে। তবে বেশি জমে হাটবারে। সপ্তাহে শনি ও মঙ্গলবার সাপ্তাহিক হাট বসে। আশপাশের কৃষিজীবী মানুষ তাদের উৎপাদিত বিভিন্ন রকম পণ্য নিয়ে হাটে আসেন। এই হাটে গরু কেনাবেচার আলাদা পরিচিতি আছে। চারপাশের বিভিন্ন গ্রামের মানুষ তাদের গৃহপালিত গবাদিপশু নিয়ে হাটে ভিড় করেন। শুধু স্থানীয় নয়, দূরদূরান্তের অনেক মানুষ আসেন গবাদিপশু কিনতে। কোরবানির ঈদের সময়টিতে হাটটি আর তার গতানুগতিক চেহারায় থাকে না। ঈদের কয়েক দিন আগে থেকেই প্রতিদিন গরু-ছাগলের হাট বসে। স্থানীয় কৃষক, স্থানীয় পাইকারসহ দূরের পাইকারেরাও এই হাটে গরু-ছাগল নিয়ে আসেন।

ঈদের দিন কাছাকাছি চলে এসেছে। প্রচুর মানুষ ভিড় করেছেন এই হাটে। হুটহাট চিৎকার দিয়ে কেউ গরু নিয়ে হাটে ঢুকছেন, কেউ গরু-ছাগল কিনে বাড়ি ফিরছেন। অনেকেই ক্রেতার কাছে গরু-ছাগলের দাম জানতে চাইছেন। শুরুতে দু–একজনকে দাম বললেও পরে বারবার জিজ্ঞাসায় বিরক্ত হয়ে ওঠছেন ক্রেতা।

এই ভিড়ে সবাই যে ক্রেতা, সে রকম হয়তো নয়। অনেকে শুধু দেখতে এসেছেন। এ রকম বেশকিছু লোকজনকে দেখা গেছে। কেউ এসেছেন বাজার যাচাই করতে। বাজেটের কাছাকাছি পেয়ে গেলে কিনে ফেলবেন। নয়তো আরও যেহেতু সময় হাতে আছে, তাই আরও একটু দেখেশুনে কিনতে চান। তবে দুপুর থেকেই পাইকার ও স্থানীয় বিক্রেতারা তাদের গরু-ছাগল নিয়ে হাটে চলে এসেছেন। সারি সারি খুঁটিতে গরু বেঁধে রাখা হয়েছে। ছোট, বড়, মাঝারি প্রচুর গরু উঠেছে। তবে ছোট ও মাঝারি আকারের স্থানীয় গরুর সংখ্যাই বেশি মনে হয়েছে। ক্রেতারা ঘুরছেন, দরদাম করছেন। কোথাও জটলা করে একে অন্যের সঙ্গে সলাপরামর্শ করছেন। অনেকে গরু-ছাগল কেনার ক্ষেত্রে চেনা-অচেনা কারও সহযোগিতা নিচ্ছেন।

ক্রেতা-বিক্রেতা ও সহায়তাকারী নিয়ে একটা বৃত্ত তৈরি হয়েছে বাজারে। একাধিক বিক্রেতা জানান, গত কয় দিন এত বৃষ্টি ছিল, অনেকে গরু নিয়ে এসে ফেরত গেছেন। বৃষ্টিতে ভিজে গরুর ঠান্ডা লাগতে শুরু করে। বৃষ্টি কমেছে, এখন অবস্থা ভালো। অনেকেই গরু নিয়ে এসেছেন। প্রচুর গরু আছে হাটে। ক্রেতাও আছেন। লোকজন দরদাম করছেন, কেউ কিনেও নিচ্ছেন। তবে লোকজনের ভিড়, দরদামের যে অবস্থা, তাতে কেনাকাটা পুরোদমে জমেনি। আশপাশে আরও মৌসুমি হাট বসেছে, সেদিকেও যাচ্ছেন ক্রেতা। তাঁরা যাচাই-বাছাই করে পছন্দের কোরবানির পশু কিনতে চাইছেন।

এক পাশে ছাগলের হাট। বেশির ভাগ বিক্রেতাই হাতের মুঠোয় দু–তিনটি ছাগলের রশি ধরে আছেন। তাঁদের মধ্যে স্থানীয় বিক্রেতাই বেশি, যাঁরা কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে নিজেরা কিছু ছাগল লালন-পালন করেন।

শাহবন্দর গ্রামের ফয়সল ফরিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘মানুষের মধ্যে ছোট গরুর চাহিদা বেশি। গত বছরের তুলনায় মনে হচ্ছে ছোট গরুর দামও বেশি চাওয়া হচ্ছে।’

সাপ্তাহিক হাটটি এখন আর নির্ধারিত দুই দিনের হাটে আটকে নেই। ঈদের দিন পর্যন্ত প্রতিদিন গরু-ছাগলের হাট বসবে। কোরবানিকে কেন্দ্র করে আরও অনেক পণ্য নিয়ে এসেছেন ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতারা, এসবের চাহিদাও ক্রেতাদের কাছে সমান। সাধারণ হাটে হয়তো এগুলো নিয়ে আলাদা দোকান খুব একটা থাকে না। কেউ বসেছেন মাংসের গরম মসলা নিয়ে; কারও কাছে জিরা, মরিচ-হলুদ, কারও কাছে আবার সবধরনের মসলার গুঁড়া। বাতাসে গরম মসলার ঘ্রাণ ভাসছে।

গরু-ছাগল বাঁধার রশি নিয়ে বসেছেন নারীসহ কয়েকজন বিক্রেতা। অনেকে বসেছেন বাঁশ-বেতের টুকরি ও চাটাই নিয়ে। কেউ বসেছেন প্লাস্টিকের পর্দা নিয়ে। মাংস কাটার জন্য এগুলোর প্রয়োজন। অন্ধকারে মোমবাতি জ্বালিয়ে লোহার তৈরি বিভিন্ন আকারের দাসহ মাংস কাটার সরঞ্জাম নিয়ে বসেছেন কয়েকজন। অনেকেই যার যার চাহিদামতো কিনে নিচ্ছেন। সময় তখন রাতের দিকে গড়িয়ে চলছে। তবে মানুষের ভিড়ের কমতি নেই।

Lading . . .