প্রকাশ: ৯ জুন, ২০২৫
কক্সবাজারে কোরবানির পশুর হাটে বেচাকেনা জমে উঠছে। হাটে চাহিদা বেশি ছোট ও মাঝারি আকারের গরুর। ১০ থেকে ২৮ মণ ওজনের অনেক ষাঁড় বিক্রির জন্য হাটে নিয়ে আসা হলেও এসবের ক্রেতা মিলছে কম।
জেলার ৪টি পৌরসভা ও ৯টি উপজেলায় পশুর হাট রয়েছে ৯৪টি। এসব হাটে গতকাল মঙ্গলবার অন্তত ২০ হাজার কোরবানির পশু বিক্রি হয়েছে বলে ইজারাদার সূত্রে জানা গেছে। হাট–সংশ্লিষ্টদের দাবি, আজ বুধবার থেকে বিক্রি আরও বাড়বে।
গতকাল মঙ্গলবার বিকেল ৪টায় কক্সবাজার শহরের কস্তুরাঘাট এলাকার অস্থায়ী পশুর হাটে গিয়ে দেখা যায়, ক্রেতা-বিক্রেতায় সরগরম হয়ে উঠেছে বাজার। হাটে বিক্রির জন্য আনা হয়েছে ৫ শতাধিক পশু। এর মধ্য বেশি বিক্রি হচ্ছে ৩ থেকে ৮ মণ ওজনের গরু। এসব গরু ১ থেকে ২ লাখ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। হাটে বড় আকারের অনেক ষাঁড় দেখা যায়। এসব ষাঁড় ঘিরে দর্শনার্থীদের ভিড় বেশি। তবে দরদামেই সীমাবদ্ধ থাকছেন ক্রেতারা।
শহরের সমিতিপাড়ার ‘মায়ের দোয়া’ খামারের মালিক নুরুল ইসলাম হাটে আনেন ১০ থেকে ২৮ মণ ওজনের ১০টি গরু। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ২৮ মণ ওজনের ষাঁড় ‘কালা বাহাদুর’। এটি ঘিরে দেখা গেছে উৎসুক মানুষের ভিড়। খামারি নুরুল ইসলাম (৫৩) বলেন, সন্ধ্যা পর্যন্ত কালা বাহাদুরের দাম উঠেছে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা। এই দামে বিক্রি সম্ভব নয়। তবে তাঁর আশা, আগামী কয়েক দিনে ষাঁড়টির ন্যায্য দাম পাবেন।
হাটে বড় গরুর তেমন ক্রেতা নেই। কোরবানির জন্য লোকজন মাঝারি আকারের গরু কিনছেন বেশি। বড় গরু বেচাবিক্রি না হলে কয়েক হাজার খামারি আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবেনখলিলুর রহমান, স্বত্বাধিকারী, কে আর এগ্রো ফার্ম
একই হাটে বিক্রির জন্য ২৮টি গরু নিয়ে আসেন কক্সবাজার পৌরসভার বিজিবি ক্যাম্প এলাকার কে আর এগ্রো ফার্মের স্বত্বাধিকারী খলিলুর রহমান। গতকাল বিকেল ৪টা পর্যন্ত বিক্রি করেন দুটি গরু। ৫ মণ ওজনের একটি গরু দেড় লাখ টাকা এবং সোয়া চার মণ ওজনের আরেকটি গরু ১ লাখ ৩০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন। খলিলুর রহমান (৫৫) বলেন, হাটে বড় গরুর তেমন ক্রেতা নেই। কোরবানির জন্য লোকজন মাঝারি আকারের গরু কিনছেন বেশি। বড় গরু বিক্রি না হলে কয়েক হাজার খামারি আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবেন। হাটের ইজারাদার রাশেদুল হক বলেন, মঙ্গলবার বেলা ৩টা থেকে ৫টা পর্যন্ত দুই ঘণ্টায় ১২০টি গরু বিক্রি হয়েছে। আজ বুধবার থেকে প্রতিদিন বিক্রি হাজার ছাড়িয়ে যাবে।
কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কের রামুর মিঠাছড়ির হাঁড়িরমাথা এলাকার পাঁচ কিলোমিটারজুড়ে কোরবানির পশু বিক্রির হাট বসেছে। গতকাল মঙ্গলবার এক দিনে এই হাটে বিক্রি হয়েছে ৪ হাজারের বেশি গরু-মহিষ। হাটে আনা হয় ২০ হাজারের বেশি পশু। ইজারাদার আবুল হোসেন বলেন, মাঝারি আকারের গরু বেশি বিক্রি হচ্ছে। বড় পশুর ক্রেতা একেবারেই কম। জেলার উখিয়া, টেকনাফ, রামু, কক্সবাজার সদর ও ঈদগাঁও উপজেলার অন্তত ১৫টি হাট ঘুরেও দেখা যায় একই চিত্র।
হাঁড়িরমাথা হাটে কথা হয় কক্সবাজার শহরের টেকপাড়ার বাসিন্দা মমতাজুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘৮ মণ ওজনের একটি গরু কিনতে চাইলাম, দাম হাঁকা হচ্ছে ৫ লাখ টাকা। ৪ লাখ টাকায় গরুটি বিক্রি করতে বিক্রেতা রাজি নন। ৪ লাখ টাকা হলে গরুটির প্রতি কেজি মাংসের দাম পড়ে ১ হাজার টাকার বেশি। অথচ খুচরা বাজারে প্রতি কেজি মাংস বিক্রি হচ্ছে ৭৫০ টাকায়।’
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এবার জেলায় কোরবানির পশুর চাহিদা রয়েছে ১ লাখ ৬২ হাজার ৭৭টি। ৮ হাজার ৭৮৪ খামারির কাছে পশু আছে ১ লাখ ৬৯ হাজার ৮৭৬টি। এর মধ্যে ১০ মণের বেশি ওজনের ষাঁড় আছে ৫৯ হাজার ২৯১টি। ৬ থেকে ৯ মণ ওজনের গরু আছে ২২ হাজার ৫৫৮টি। এবার জেলায় পশুর সংকট হবে না বলে দাবি প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার। খামারিদের দাবি, জেলার স্থায়ী বাসিন্দাদের বাইরে আশ্রয়শিবিরে থাকা প্রায় ১৪ লাখ রোহিঙ্গার জন্যও ৫ থেকে ৬ হাজার কোরবানির পশুর চাহিদা রয়েছে।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এবার জেলায় কোরবানির পশুর চাহিদা রয়েছে ১ লাখ ৬২ হাজার ৭৭টি। ৮ হাজার ৭৮৪ খামারির কাছে পশু আছে ১ লাখ ৬৯ হাজার ৮৭৬টি। এর মধ্যে ১০ মণ বেশি ওজনের ষাঁড় আছে ৫৯ হাজার ২৯১টি। ৬ থেকে ৯ মণ ওজনের গরু আছে ২২ হাজার ৫৫৮টি। এবার জেলায় পশুর সংকট হবে না বলে দাবি প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার। খামারিদের দাবি, জেলার স্থায়ী বাসিন্দাদের বাইরে আশ্রয়শিবিরে থাকা প্রায় ১৪ লাখ রোহিঙ্গার জন্যও ৫ থেকে ৬ হাজার কোরবানির পশুর চাহিদা রয়েছে।
কক্সবাজার খামার মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম বলেন, বাজারে দেশি গরুর চেয়ে চোরাই গরুর দাম কম। ক্রেতারা সস্তা দেখে গরু কিনছেন। তাতে ন্যায্যমূল্য না পেয়ে স্থানীয় খামারিরা হতাশ। বিশেষ করে ১০ থেকে ২৮ মণ ওজনের বড় গরুর ক্রেতা নেই বললে চলে।
জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন বলেন, পশুর হাটে জাল নোটের ব্যবহার, চাঁদাবাজি বন্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎপর রয়েছে। চোরাই পশু, রোগাক্রান্ত পশু যাতে বিক্রি না হয়, সে বিষয়টি নজরদারিতে রাখা হয়েছে।
থেমে নেই চোরাচালান
কক্সবাজারের খামারিদের অভিযোগ, কোরবানির পশুর হাটকে কেন্দ্র করে সীমান্ত দিয়ে মিয়ানমার থেকে প্রতিদিনই চোরাইপথে গরু-মহিষ আসছে। এসব পশু অনেক কম দামে বিক্রি হয়। যার কারণে তাঁরা তাঁদের পশুর ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না।
রামুর খুনিয়াপালং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, চোরাইপথে আসা পশুর কারণে স্থানীয় খামারিরা খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তাঁর ইউনিয়নের অন্তত ২০০ খামারি বিপাকে পড়েছেন।
টেকনাফের বাজারে বিক্রির জন্য ৩২টি গরু আনেন স্থানীয় ‘নুর এগ্রো খামার’-এর স্বত্বাধিকারী আবদুল করিম। গতকাল বিকেল ৪টা পর্যন্ত মাঝারি আকারের ১০টি গরু বিক্রি করেছেন বলে জানান তিনি। আবদুল করিম বলেন, ‘আমার ১৫ মণ ওজনের ২টি গরু রয়েছে, দাম হাঁকিয়েছি ১৬ লাখ টাকা। তবে ১১ লাখ ৪০ হাজার টাকা দাম উঠেছে। বড় গরুর ক্রেতা খুবই কম।’
জেলার ৯৪ হাট-বাজারের মধ্যে টেকনাফে কোরবানির পশুর দাম সবচেয়ে বেশি। চার বছর আগে কক্সবাজার শহর, চকরিয়া এবং চট্টগ্রামের লোহাগাড়া, আনোয়ারা ও সাতকানিয়ার ব্যবসায়ীরা টেকনাফ থেকে কয়েক হাজার গরু কিনে নিয়ে যেতেন। তখন শাহপরীর দ্বীপ করিডর দিয়ে প্রতি মাসে মিয়ানমার থেকে আমদানি হতো ৪০ হাজারের বেশি গরু-মহিষ। ২০০৩ সালের ২৫ মে থেকে করিডর চালু করা হয়। খামারিদের লাভের কথা বিবেচনা করে ২০২১ সালের ৪ জুলাই করিডর দিয়ে মিয়ানমারের পশু আমদানি বন্ধ করে জেলা চোরাচালান নিরোধী টাস্কফোর্স কমিটি। দক্ষিণ চট্টগ্রামে এটি ছাড়া পশু আমদানির দ্বিতীয় কোনো করিডর নেই।
টেকনাফ স্থলবন্দরের শুল্ক বিভাগের দেওয়া তথ্য মতে, বন্ধের আগের ১৮ বছরে শাহপরীর দ্বীপের করিডর দিয়ে পশু আমদানি হয়েছিল প্রায় ৯ লাখ। এর বিপরীতে সরকার রাজস্ব পেয়েছিল ৩৬ কোটি ৮০ লাখ ৬৯ হাজার ৪০০ টাকা।