Advertisement

'ভুলের জন্য ক্ষমা' চেয়ে দলের একাংশের দাবি- 'আজ থেকে আমরাই মূল জাতীয় পার্টি'

বিবিসি বাংলা

প্রকাশ: ৯ আগস্ট, ২০২৫

শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর জাতীয় পার্টির কার্যালয়ে হামলা ও ভাঙচুর করা হয়
শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর জাতীয় পার্টির কার্যালয়ে হামলা ও ভাঙচুর করা হয়

দলীয় চেয়ারম্যান জিএম কাদেরসহ চেয়ারম্যানপন্থিদের বাদ দিয়ে কাউন্সিলের মাধ্যমে নতুন কমিটি গঠন করেছে জাতীয় পার্টির একটি অংশ। শনিবার দলীয় কাউন্সিলের মাধ্যমে এই কমিটি গঠন করে 'জাতীয় পার্টি অতীত ভুলের জন্য' দেশের মানুষের কাছে ক্ষমা প্রার্থনাও করেছে তারা।

শনিবার ঢাকায় অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে আনিসুল ইসলাম মাহমুদকে এই অংশের চেয়ারম্যান, এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদারকে মহাসচিব, কাজী ফিরোজ রশিদকে সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান এবং মো. মুজিবুল হক চুন্নুকে করা হয়েছে নির্বাহী চেয়ারম্যান।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নির্বাচনে অংশ নেওয়াকে 'রাজনৈতিক ভুল' আখ্যা দিয়ে দলটি এই সম্মেলনে 'দেশবাসীর কাছে ক্ষমা' চায়।

এসময় নতুন গঠিত কমিটির নির্বাহী চেয়ারম্যান মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, "যদি নৈতিকভাবে ভুল-ভ্রান্তি হয়ে থাকে, সেই জন্য আজকের দিনে এই কাউন্সিলে দাঁড়িয়ে জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে দেশবাসীর কাছে আমরা নিঃশর্ত ক্ষমা চাই।"

জাতীয় পার্টির এই অংশের কাউন্সিলে ছিলেন না দলীয় চেয়ারম্যান জিএম কাদের কিংবা নতুন মহাসচিব শামীম হায়দার পাটোয়ারি।

নতুন কমিটি গঠনের পর এই অংশের নির্বাহী চেয়ারম্যান মুজিবুল হক চুন্নু বিবিসি বাংলাকে বলেন, "আজ থেকে আমরাই মূল জাতীয় পার্টি, লাঙ্গলও আমাদের। জিএম কাদের ও শামীম পাটোয়ারির জাতীয় পার্টির আর কোনো অস্তিত্ব নাই"।

বাংলাদেশের জাতীয় পার্টির রাজনীতির ইতিহাসে জাতীয় পার্টির বেশ কয়েক দফায় ভেঙে নতুন নতুন দল গঠন হয়েছে।

তেমনই একটি অংশ সাবেক মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি- জেপি'র নেতা আজকের ছিলেন শনিবারের এই সম্মেলনে।

তারা সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে আগামীতে নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন বলেও ইঙ্গিত দিয়েছেন এই অংশের নেতারা।

নতুন কাউন্সিল ও কমিটি গঠন নিয়ে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও নতুন মহাসচিব শামীম হায়দার পাটোয়ারীর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তবে তারা কেউ ফোন ধরেননি।

তবে বিকেলে ঢাকায় একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে জিএম কাদের অংশের মহাসচিব শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেছেন, "ইতিহাস বলে, মূল স্রোতের বাইরে গিয়ে যারা জাতীয় পার্টিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে চেয়েছেন, তারাই নিশ্চিহ্ন হয়েছেন।"

প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিভিন্ন সময়ে নেতৃত্ব নিয়ে বিভক্তি দেখা দিয়েছে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের প্রতিষ্ঠিত দল জাতীয় পার্টিতে। নেতৃত্বের দ্বন্দ্বে দলটি ভাঙনের মুখে পড়ে বিগত শেখ হাসিনা সরকারের আমলেও।

জাতীয় পার্টির নির্বাচনি প্রতীক

ছবির উৎস, JATIYA PARTY

জাতীয় পার্টির নির্বাচনি প্রতীক

ছবির উৎস, JATIYA PARTY

একাংশের কাউন্সিলে নতুন নেতৃত্ব

বিবিসি বাংলার সর্বশেষ খবর ও বিশ্লেষণ এখন সরাসরি আপনার ফোনে।

ফলো করুন, নোটিফিকেশন অন রাখুন

বিবিসি বাংলার সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ বিবিসি বাংলার হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল

গত ২৮শে জুন ঢাকার চীন-মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে জাতীয় সম্মেলন দিন ঠিক করেছিলেন জিএম কাদেরর নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি।

কিন্তু ওই দিন সেখানে প্রধান উপদেষ্টার একটি অনুষ্ঠান থাকায় জিএম কাদের সেই সম্মেলন স্থগিত করে দেন।

কিন্তু জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও রুহুল আমিন হাওলাদার কাকরাইলে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সম্মেলন করার সিদ্ধান্ত নিয়ে জেলা পর্যায়ে নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন।

এছাড়া বিভিন্ন সময়ে জাতীয় পার্টি থেকে বের হয়ে যেসব দল গঠিত হয়েছে, তাদের শীর্ষ নেতাদেরও এক মঞ্চে এনে ঐক্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন তারা।

এমন পরিস্থিতির মধ্যেই গত সাতই জুলাই চেয়ারম্যান জিএম কাদের দলটির সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুসহ দলের ১০ নেতাকে অব্যাহতি দেন।

অব্যাহতিপ্রাপ্ত ওই নেতারা আদালতের দ্বারস্থ হন। পরে গত ৩১শে জুলাই জি এম কাদের ও যুগ্ম দপ্তর সম্পাদক মাহমুদ আলমের সাংগঠনিক কার্যক্রমের ওপর অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা দেন আদালত।

এরপরই আজ (শনিবার) ঢাকায় জাতীয় সম্মেলনের ঘোষণা দেন আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার ও মুজিবুল হক চুন্নুর অংশ।

বিভিন্ন সময় দল থেকে বহিষ্কৃত নেতা-কর্মীদের উদ্যোগে আয়োজিত দলটির এই জাতীয় কাউন্সিলে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন দলের সাবেক সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ আর মহাসচিব নির্বাচিত হন রুহুল আমিন হাওলাদার।

এ ছাড়া কাজী ফিরোজ রশিদকে সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান এবং মুজিবুল হক চুন্নুকে নির্বাহী চেয়ারম্যান নির্বাচিত করা হয়।

কাউন্সিল উপলক্ষে গঠিত নির্বাচন কমিশনের আহ্বায়ক জহিরুল ইসলাম জহির তাদের নাম ঘোষণা করেন।

জাতীয় কাউন্সিলে উপস্থিত কাউন্সিলরদের সমর্থনে নির্বাচিত হন তারা। এসময় আগামী ১৫ দিনের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণার করার কথাও জানানো হয় এই সম্মেলনে।

গত কয়েকটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করেই নির্বাচন করেছিলো জাতীয় পার্টি

ছবির উৎস, DESHAKALYAN CHOWDHURY

গত কয়েকটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করেই নির্বাচন করেছিলো জাতীয় পার্টি

ছবির উৎস, DESHAKALYAN CHOWDHURY

রাজনীতিতে ফিরতে ক্ষমা প্রার্থনা

গত বছর অগাস্টে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর সেনাপ্রধান যে সব রাজনৈতিক দলের নেতাদের তার বৈঠকে ডেকেছিলেন সেখানে জাতীয় পার্টিও ছিল।

কিন্তু এরপর প্রধান উপদেষ্টা যখন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে আলোচনা শুরু করেন তখন সেই আলোচনায় আর ডাক পায়নি দলটি।

শেখ হাসিনাবিরোধী আন্দোলনকারীরা জাতীয় পার্টিকে 'স্বৈরাচারের দোসর' অভিহিত করে প্রচার শুরু করে এবং দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ঘোষণা দিয়ে হামলার চেষ্টাও হয়েছে।

এ নিয়ে দলটির মধ্যে এক ধরনের টানাপোড়েনও তৈরি হয়।

যে কারণে শনিবার আনিসুল ইসলাম মাহমুদের নেতৃত্বে নতুন এই অংশের সম্মেলনে বিগত আওয়ামী লীগ শাসনামলে অংশ নেওয়া বিভিন্ন নির্বাচনের প্রসঙ্গও টানেন নতুন কমিটির নির্বাহী চেয়ারম্যান মুজিবুল হক চুন্নু।

তিনি বলেন, "রাজনীতি করতে গিয়ে হয়তো সঠিক সিদ্ধান্ত সব সময় নেওয়া যায় না। আমরা বিগত অনেকগুলো নির্বাচন করেছি, অনেক সময় অনেকে আমাদের বিভিন্নভাবে কটূক্তি করেন, বিভিন্ন দলের সহযোগী বা স্বৈরসহযোগী হিসেবে আমাদেরকে আখ্যায়িত করেন।"

মি. চুন্নু বলেন, "একটি কথাই বলব, আমরা দলীয়ভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে কোনো বেআইনি কাজ করিনি। যদি নৈতিকভাবে ভুল-ভ্রান্তি হয়ে থাকে, সেই জন্য আজকের দিনে এই কাউন্সিলে দাঁড়িয়ে জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে দেশবাসীর কাছে আমরা নিঃশর্ত ক্ষমা চাই।"

"আমরা সকল রাজনৈতিক দলের কাছে অনুরোধ করবো- জাতীয় পার্টি একটি শান্তিপূর্ণভাবে রাজনীতি করার দল, জাতীয় পার্টি একটি আধুনিক গণতন্ত্রমনা মর্ডান ডেমোক্রেটিক পার্টি, সেই দলকে নিয়ে দেশের মানুষের কাছে এগিয়ে যেতে চাই", যোগ করেন তিনি।

জাতীয় পার্টি কি এই ক্ষমা প্রার্থনার মাধ্যমে বর্তমান সরকার কিংবা রাজনৈতিক অঙ্গনে আবার ফিরতে চায় সেই প্রশ্নও সামনে আসছে।

জবাবে মুজিবুল হক চুন্নু বিবিসি বাংলাকে বলেন, "পাঁচই অগাস্টের পর যে নতুন একটা প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে। যেহেতু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় নির্বাচন নিয়ে অনেক প্রশ্ন ছিল। ভোটাররা ভোট দিতে পারে নাই, সেই নির্বাচনে আমাদের যাওয়া নৈতিকভাবে সঠিক ছিল না"।

"কাজ করতে গিয়ে অনেক ভুল ত্রটি হয়। সার্বিকভাবে আমাদেরও ভুলত্রুটি আছে। সেই ভুলত্রুটির জন্য আমরা জাতির কাছে ক্ষমা চেয়েছি," বলছিলেন মি. চুন্নু।

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের

উদ্দেশ্য কী?

শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত মে মাসে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারি করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।

বিগত শেখ হাসিনা সরকারের সময়ে আওয়ামী লীগের সাথে ঐক্য ধরে রেখে তিনটি জাতীয় নির্বাচনে বিরোধী দল হয়েছিল জাতীয় পার্টি।

গণঅভ্যুত্থানের পর আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়ায় জাতীয় পার্টির এই অংশ মনে করছে দেশে বিএনপির কাছাকাছি শক্তির একটি রাজনৈতিক দল প্রয়োজন।

মুজিবুল হক চুন্নু বিবিসি বাংলাকে বলেন, "বাংলাদেশে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ, বড় দুইটি রাজনৈতিক দল। আওয়ামী লীগ নানান কারণে তারা যে অবস্থায় রয়েছে, তাদের পক্ষে এখন ঘুরে দাঁড়ানো অনেক সময়ের ব্যাপার। তাই বিএনপির সাথে প্যারালাল আরেকটা দল রাজনৈতিক দল হওয়া উচিত। সেই চিন্তা থেকে আমরা ঐক্যবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করছি।"

তিনি জানান, অতীতে বিভিন্ন সময় জাতীয় পার্টি ভেঙে যে নতুন দল হয়েছে তাদের কোনো কোনো অংশকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করছে তারা।

মি. চুন্নু বিবিসি বাংলাকে বলেন, "যারা বিভিন্ন সময়ে চলে গিয়েছিলেন, নিষ্ক্রিয় বা অনেকে জাতীয় পার্টি ভেঙেছেন। একটা পর্যায়ে উনারা ও আমরা মিলে একীভূত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। একটা পর্যায়ে গিয়ে একীভূত হয়ে যেতে পারি।"

দলের নতুন কমিটির পর জিএম কাদের ও শামীম হায়দার পাটোয়ারী অংশের অস্তিত্ব নেই বলেও মনে করে জাতীয় পার্টির নতুন অংশ।

এই অংশের নির্বাহী চেয়ারম্যান মি. চুন্নু বলেন, "আগের কমিটির আর অস্তিত্ব নাই। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী আজকের পর থেকে জাতীয় পার্টির লাঙ্গল অংশের চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ আর রুহুল আমিন হাওলাদার মহাসচিব।"

তবে, সকালে ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে জিএম কাদের অংশের মহাসচিব শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেছেন, "চেয়ারম্যান জিএম কাদের এর নেতৃত্বে তৃণমূল নেতা-কর্মীরা ঐক্যবদ্ধ আছে, জিএম কাদের এর নেতৃত্বেই জাতীয় পার্টি বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।"

Lading . . .