এবার বেরিয়ে আসছে হাসানাত আব্দুল্লাহর শ্যালকের থলের বিড়াল
প্রকাশ: ২৬ আগস্ট, ২০২৫

বরিশাল নগরীর আওয়ামী লীগ নেতা কাজী মফিজুল ইসলাম কামালের বিরুদ্ধে বেরিয়ে আসছে নানা অভিযোগ। নগরীর ঐতিহ্যবাহী ‘বিউটি কমপ্লেক্স’ দখলের অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। যার বর্তমান মূল্য প্রায় ৪০ কোটি টাকা। এই কমপ্লেক্সটি ৭ বছরের বেশি সময় তিনি দখল করে রেখেছেন। শেখ হাসিনার ফুপাতো ভাই আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর শ্যালক তিনি। জুলাই বিপ্লবে জনতার বিজয় লাভের মাত্র ৩ দিন আগে ভারতে পালিয়ে যান সাবেক মন্ত্রী হাসানাত আব্দুল্লাহ।
এদিকে ক্ষমতাধর ভগ্নীপতির প্রভাবে জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক পদ বাগিয়ে নেন এই কামাল। এছাড়া শুধু বিউটি কমপ্লেক্স দখল নয়, এর বর্তমান মালিক আশিক চৌধুরী ও তার স্ত্রী আমেনা বেগম সুমীকে হেনস্তা করতে বিভিন্ন লোক দিয়ে ৩৩টি মিথ্যা মামলা করানোর অভিযোগও উঠেছে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী এই নেতার বিরুদ্ধে। এসব মামলার মধ্যে ১১টিতে খালাস পেয়েছে আশিক-সুমী দম্পতি। এখনো বাকি ২২ মামলার ঘানি টানতে হচ্ছে এই দম্পতিকে। যদিও যুগান্তরের কাছে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন কাজী কামাল।
সূত্র জানায়, বরিশাল শহরের একসময়কার ঐতিহ্যবাহী বিউটি সিনেমাসহ বেশকিছু স্থাপনা নিয়ে গড়ে ওঠা বিউটি কমপ্লেক্সের আয়তন প্রায় ৫৪ শতাংশ। এর মধ্যে ১৫ শতাংশে কমপ্লেক্সের মালিক জুলফিকার উদ্দিন চৌধুরী ওরফে জুলু চৌধুরীর বসতবাড়ি। বাকি প্রায় ৩৯ শতাংশ দখলের অভিযোগ উঠেছে কাজী কামাল ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে। নগরীর প্রাণকেন্দ্রে থাকা এই সম্পদের বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ৪০ কোটি টাকা।
জুলু চৌধুরীর ছেলে আশিক চৌধুরী বলেন, ‘আমি সপরিবারে যুক্তরাষ্ট্রে থাকাবস্থায় ২০১৮ সালে বাবাকে ভুল বুঝিয়ে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে অপ্রত্যাহারযোগ্য একটি পাওয়ার অব অ্যাটর্নি করে নেন কাজী কামাল। পাওয়ার অব অ্যাটর্নি অনুযায়ী ওই ৩৯ শতাংশ জমিতে ৫তলা মার্কেট কমপ্লেক্স করার কথা। কমপ্লেক্সের নিচতলার ৫০ ভাগের মালিকানা থাকবে আমাদের। বাকি অংশের মালিকানা কাজী কামালসহ তার অনুগত ৩-৪ জনের। এছাড়া মৌখিক আলোচনা অনুযায়ী ভবনের অর্ধেক মালিকানাও আমাদের থাকবে বলে বলা হয়। কিন্তু দলিল করার সময় প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে কেবল নিচতলার ৫০ ভাগের মালিকানা আমাদের নামে দেওয়া হয়। এর বাইরে এই পাওয়ার দলিলে ভবনের বাকি সমুদয় অংশ কাজী কামাল নিজের নামে লিখে নেন। বিষয়টি জানতে পেরে বাবা প্রতিবাদ করলেও প্রভাবশালী আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর শ্যালক এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর আত্মীয় হওয়ায় হুমকির মুখে বাধ্য হয়ে একপর্যায়ে তিনি থেমে যান।
পাওয়ার অব অ্যাটর্নি সম্পন্ন হওয়ার পর নিজের নামে নগর ভবন থেকে প্ল্যান পাশ করান কাজী কামাল। এরপর কাজ শুরু করে ৩টি ছাদ দেন। পাশ হওয়া প্ল্যানে জনসাধারণের চলাচলের জন্য বহু পুরোনো একটি রাস্তার উল্লেখ থাকলেও নির্মাণকালে তা দখল করা হয়। বিষয়টি জানতে পেরে ২০২০ সালে নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেয় সিটি করপোরেশন। পরে অবৈধ অংশ ভেঙে দেওয়া হয়। বন্ধ হয়ে যায় নির্মাণকাজ।
তিনি জানান, পুরো বিষয়টি অনিশ্চিত হয়ে পড়লে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি বাতিলে কাজী কামালকে পরপর ৩টি উকিল নোটিশ দেন বাবা। উত্তর না দেওয়ায় ২০২১ সালে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি বাতিলের মামলা করা হয় আদালতে। এর ফলে মূল্যবান সম্পত্তির ভবিষ্যৎ এভাবে অনিশ্চিত হয়ে পড়ায় ২০২২ সালের ১৫ মার্চ বাবা পুরো জমি আমার নামে দলিল করে দেন। দলিল অনুযায়ী আমার নামে রেকর্ড ও নামজারি সম্পন্ন এবং খাজনাও পরিশোধ করি। বৈধভাবে জমির মালিক হওয়ার পর সম্পত্তি বুঝে নিতে গেলে শুরু হয় আমার পরিবারের ওপর নানামুখী অত্যাচার-নির্যাতন। যার নেতৃত্ব দেন কাজী কামাল।’
প্রায় ৭ বছর চলা নানা নির্যাতন-দুর্ভোগের বর্ণনা দিয়ে আশিক যুগান্তরকে বলেন, ‘আমার নামে জমির মালিকানা আসার পর ২০২২ সালে প্রথমে বরিশালের যুগ্ম জেলা জজ আদালতে মালিকানা দলিল বাতিলের একটি মামলা করেন কাজী কামাল। আদালত স্থীতাবস্থার নির্দেশ দিলে জেলা ও দায়রা জজ বিশেষ আদালতে আপিল করি। আদালত আমার পক্ষে রায় দিয়ে স্থিতাবস্থা উঠিয়ে দেন। এ রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করেন তিনি। রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ১০ জুলাই রুল জারির পাশাপাশি ৩ মাসের স্থিতাবস্থা জারি করেন উচ্চ আদালত। উচ্চ আদালত স্থিতাবস্থা জারি করলেও ২৩ আগস্ট দুপুরে কাজী কামালের লোকজন জোর করে কমপ্লেক্সে এসে দখলের চেষ্টা চালান। স্ত্রী সুমী বাধা দিতে গেলে সন্ত্রাসীরা তাকে লাঞ্ছিত করার পাশাপাশি ধর্ষণ ও হত্যার হুমকি দেয়। এ ঘটনায় কোতোয়ালি মডেল থানায় লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়েছে।
তিনি জানান, যতবার বৈধ মালিকানা বুঝে নিতে গেছি, ততবার স্ত্রী ও আমার বিরুদ্ধে একের পর এক মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে। অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্যি, এখন পর্যন্ত আমাদের বিরুদ্ধে ৩৩টি মামলা দিয়েছে। রড-সিমেন্ট চুরি থেকে শুরু করে মারধরসহ এমন কোনো হাস্যকর অভিযোগ নেই যা নিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়নি। এই ৩৩ মামলার মধ্যে ১১টিতে বেকসুর খালাস পেয়েছি। বাকি ২১টি মামলায় আদালতের বারান্দায় ঘুরতে হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘শুধু ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের সময়ে নয়, গণ-অভ্যুত্থানের পর গত এক বছরেও ন্যায়বিচার পাচ্ছি না। পৈতৃক সম্পত্তি পড়ে থাকলেও আমাদের অভাব-অনটনের মধ্যে দিন কাটাতে হচ্ছে। জমির মালিকানা কিংবা পাওয়ার অব অ্যাটর্নি বাতিলের মামলা তো চলমান। আদালত যে রায় দেবেন, সেটাই মেনে নেব। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন-কেন এভাবে ৩৩টি মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা করা হলো? প্রশাসনই বা কেন তাদের ইশারায় চলছে? তাহলে ফ্যাসিস্ট সরকার পতনের পরও আমাদের জানমালের নিরাপত্তা কোথায়?’
এদিকে এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে কাজী কামাল বলেন, ‘পাওয়ার অব অ্যাটর্নি সম্পন্নের সময় আশিকের বাবা জুলফিকার উদ্দিন চৌধুরীকে প্রায় ৪ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া পাওয়ার অব অ্যাটর্নি বহাল থাকাবস্থায় তো তিনি ছেলের নামে জমি দলিল করে দিতে পারেন না। তিনতলা ভবন নির্মাণেও প্রায় ৬ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। এই ১০ কোটি টাকা ওনারা পরিশোধ করে দিক। আমরা নিজেরাই সেখান থেকে চলে আসব। সবচেয়ে বড় কথা, জুলু চৌধুরী এখনো জীবিত ও সুস্থ। তিনি কেন প্রকাশ্যে আসছেন না। প্রয়োজনে তিনিসহ নগরীর গণ্যমান্য ব্যক্তিরা বসুক। সেখানে যা সিদ্ধান্ত হবে মেনে নেব। এই শহরে আওয়ামী লীগের কোনো ক্ষমতা দেখিয়েছি, তা কেউ বলতে পারবে না।’
তিনি দাবি করেন, ভগ্নীপতি কিংবা সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কোনো ক্ষমতা দেখিয়েও চলিনি। আমি একজন ব্যবসায়ী, ডেভেলপার ব্যবসা হিসাবে জুলু চৌধুরীর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে কাজ করেছিলাম। এখন তারা সময়ের পরিবর্তন বুঝে আমার বিনিয়োগের ১০ কোটি টাকা আত্মসাতের ষড়যন্ত্র করছে। আদালত পাওয়ার অব অ্যাটর্নি বাতিল না করা পর্যন্ত ওই জমির মালিকানা যেমন আমাদের, তেমনই এই পাওয়ার বহাল থাকা পর্যন্ত আশিক চৌধুরীর মালিকানার দলিলও বৈধ নয়। বিষয়টি আমরা আদালতেই বুঝব।
আশিক ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে ৩৩টি ফৌজদারি মামলার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এসব মামলার কোনোটির বাদী আমি নই। যারা মামলা করেছে, তাদের জিজ্ঞেস করুন। আমি হাসানাত আব্দুল্লাহর আত্মীয়, এটা যেমন ঠিক, তেমনই আলোচ্য আশিক চৌধুরীও আওয়ামী লীগের একজন বড় সুবিধাভোগী। তার সব প্রমাণ আমার কাছে রয়েছে।