Advertisement

পিরোজপুরে ভাসমান সবজি চাষে সাফল্য

যুগান্তর

প্রকাশ: ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

পিরোজপুরে পানির ওপর ধাপ তৈরি করে ভাসমান পদ্ধতিতে চাষ করা বিভিন্ন জাতের সবজি। ছবি: যুগান্তর
পিরোজপুরে পানির ওপর ধাপ তৈরি করে ভাসমান পদ্ধতিতে চাষ করা বিভিন্ন জাতের সবজি। ছবি: যুগান্তর

পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার অধিকাংশ যায়গায় নিম্নভূমি। সারা বছরই থাকে জলমগ্ন। উপজেলার নাজিরপুরের প্রত্যন্ত এলাকা দেউলবাড়ী-দোবড়া, কলার-দোয়ানিয়া ও মালিখালী ইউনিয়নের অধিকাংশই বিলাঞ্চল। এখানকার বাসিন্দারা বছরের প্রায় ৬ মাসই থাকেন পানিবন্দি। এক মৌসুমের ফসলে যা আসে তাতে সারা বছর অভাব-অনটনের মধ্যে থাকতে হয়। তবে তাদের বিকল্প আয়ের পথ খুলে দিয়েছে এ ভাসমান সবজি চাষ।

তবে, আধুনিক যুগে এ পেশা লাভজনক হওয়ায় সহস্রাধিক কৃষক এ পদ্ধতিতে সবজি চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। বর্তমানে এ উপজেলায় অন্তত ১৮০ হেক্টর জলাশয়ে ভাসমান সবজি চাষ হচ্ছে। দুইশ বছরেরও আগে থেকে চলে আসা এ বিরল কৃষি পদ্ধতির চাষ দেশ ছাপিয়ে বিশ্ব স্বীকৃতি অর্জন করেছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ওই স্বীকৃতিপত্র বাংলাদেশ কৃষি মন্ত্রণালয়ের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। কৃষি বিশেষজ্ঞরাও বর্তমানে জলমগ্ন ভূমিতে এ ধরনের বিশেষ পদ্ধতির চাষাবাদের প্রশিক্ষণসহ কৃষকদের ব্যাপকভাবে উৎসাহিত করছেন।

নাজিরপুর উপজেলা সদর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার উত্তরে বৈঠাকাটা বাজার সন্নিহিত মুগারঝোর গ্রাম অবস্থিত। এখানে জলাভূমিসহ বিলাঞ্চলের ১৮০ হেক্টর জমিতে নয়নাভিরাম ব্যতিক্রমী এ চাষাবাদের দেখা মেলে।

ভাসমান বেড তৈরি : বর্ষার শুরু অর্থাৎ আষাঢ় থেকে কার্তিক মাস পর্যন্ত এই ৫ মাস কৃষকদের ভাসমান ধাপের ওপর ৪১ প্রজাতির শাক-সবজির চারা উৎপাদন ও বিক্রির সময়। আষাঢ়ে এসব গ্রামের নিচু জমি পানিতে প্লাবিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কৃষকরা নেমে পড়ে ধাপ প্রস্তুতির কাজে। কচুরিপানা, দুলালীলতা, শ্যাওলা, টেপপানা, গুঁড়িপানা ইত্যাদি জলজ উদ্ভিদের সঙ্গে খড়কুটা এবং নারিকেলের ছোবড়াগুঁড়া মিলিয়ে স্তরে স্তরে সাজিয়ে তৈরি করা হয় ভাসমান বীজতলা বা ধাপ। যা পচে তৈরি হয় জৈব সার। ১০০-১৮০ ফুট লম্বা, ৫-৬ ফুট চওড়া এবং এক-দেড় ফুট পুরু বীজতলা তৈরি হয়, যা থাকে ৮-১০ ফুট পানিতে ভাসমান।

পুরুষরা ধাপ তৈরি, চারা স্থাপন, পরিচর্যা ও চারা বিক্রির কাজ করেন। আর নারী ও ছোট ছেলেমেয়েরা বাড়িতে বসে চারা তৈরির প্রাথমিক স্তর অর্থাৎ বীজের অঙ্কুরোদগম ঘটানোর কাজ করে। শ্যাওলা, নারিকেল ছোবড়া ও কেঁচো সার ইত্যাদি দিয়ে ছোট ছোট বল আকারের বস্তু তৈরি করে। স্থানীয় ভাষায় একে ‘টেমা বা দৌল্লা’ বলে। এর মধ্যে বীজ রেখে অঙ্কুরোদগম ঘটানো হয়, যা পরে ভাসমান বীজতলা বা ধাপের ওপর স্থাপন করে নির্দিষ্ট সময় পরিচর্যার পর চারায় পরিণত করা হয়।

সরেজমিন দেখা যায়, বিলাঞ্চলের পানির ওপর ভাসমান বেডে শসা, কাঁকরোল, মিষ্টিকুমড়া, লাউ, বেগুন, টমেটো, পেঁপে, মরিচের চারা, লালশাক, পালংশাক ও মুলাসহ নানা প্রকার সবজির সমারোহ। বিলের পানি ছাড়াও এই পদ্ধতিতে বাড়ির পাশে জলাশয়ে সবজি চাষ করা হচ্ছে। এখন চলছে ভাসমান বেডে কৃষকের চারা তৈরির আসল সময়। আবার দেখা যায়, শীতের মৌসুমে বিলের পানি অনেকটা নিচে নেমে গেলে সবজি চারা বিক্রি করার পরে এখানেই রোপণ করা হবে বোরো ধান। মুগারঝোর গ্রামের কৃষক ইব্রাহীম সেখ (৬০) বলেন, এলাকার অধিকাংশ জমিতে এক ফসল হয়। বছরের প্রায় ৬ মাস পানিতে তলিয়ে থাকে এসব অঞ্চল। আগে অভাব অনাটন লেগেই থাকত, পরে ভাসমান সবজি চাষ শুরু করার পরে আর আমাদের পেছনে ফিরে তাকাতে হয় না। এই সবজি চারা বিক্রয় ও সবজি তোলা শেষ হলেই একই বেডে বিরি ধান রোপণ করা হবে। তিনি বলেন, এবার ২০টি বেডে সবজি চারা চাষ করেছি। বেডপ্রতি তৈরি করতে খরচ হয়েছে প্রায় ১১ হাজার টাকা। গেল বছরের তুলনায় এ বছর দাম কিছু বৃদ্ধি থাকায় আশা করি, বেডপ্রতি ২০ হাজার টাকার চারা বিক্রি করতে পারব।

দেউলবাড়ী গ্রামের রাজেস আলী বলেন, সপ্তাহে দুদিন গাওখালী ভাসমান বাজারে নৌকার হাটে এবং গাওখালী বাজারে সবজি নিয়ে বিক্রি করি। কখনো কখনো ব্যবসায়ীরা এসে বাড়ি থেকেই সবজি কিনে নিয়ে যান। বিষমুক্ত হওয়ায় প্রচুর চাহিদা রয়েছে এসব সবজির। এখান থেকে সবজি এবং চারা ট্রাকে এবং নদীপথে বিভিন্ন জায়গায় চলে যায়, ঢাকায়ও রয়েছে এর ব্যাপক চাহিদা। মুগারঝোড় গ্রামের কৃষক মো. ফেরদাউস (৫০) বলেন, ছোটবেলা থেকেই ভাসমান সবজি চাষ করে আসছি। আমাদের বাবা-দাদারা এভাবে চাষ করতেন।

এ বিষয়ে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ইসরাতুন্নেছা এশা বলেন, উপজেলায় এ বছর প্রায় ১৮০ হেক্টর জমিতে ২ হাজার ১৭৫টি ভাসমান বেড রয়েছে। পরিবেশবান্ধব ও জৈব পদ্ধতিতে এ ফসল আবাদ করা হয়। চাষের খরচ তুলনামূলকভাবে খুবই কম। সেচের প্রয়োজন খুব একটা পড়ে না। খুব কম সার ও বালাইনাশক ব্যবহার করে ফসল উৎপাদন করা যায়।

আরও পড়ুন

Lading . . .