ভারতকে ট্রানজিট বানিয়ে ইলিশ পাচার, খবর প্রকাশের পর রপ্তানি বন্ধ
প্রকাশ: ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

বাংলাদেশ থেকে ইলিশ কেজি প্রতি ১৯০০ থেকে ২ হাজার টাকায় কিনে ভারতে পাঠাতে মোট ব্যয় দাঁড়ায় ২১০০ থেকে ২২০০ টাকা। ডলারে যার মূল্যমান ২০ থেকে ২১ ডলার। এতে লোকসান ৫০০-৬০০ টাকা। পশ্চিমবঙ্গ থেকে সেই ইলিশ বিভিন্ন দেশে পুনঃরপ্তানি হয় কেজিপ্রতি ৪০-৪৫ ডলারে। অর্থাৎ প্রতি কেজিতে লাভ দাঁড়ায় ২০ থেকে ২৪ ডলার বা ২ হাজার ৮০০ টাকা পর্যন্ত। পুরো প্রক্রিয়ায় সহায়তা করে পশ্চিমবঙ্গের কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। সোমবার যুগান্তরে প্রকাশিত হয় ভারতকে ট্রানজিট হিসাবে ব্যবহার করে বিভিন্ন দেশে ইলিশ পাচারের বিস্তারিত সংবাদ। এরপর পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় ইলিশ রপ্তানি।
বেনাপোল ফিশ কোয়ারেন্টাইন বিভাগের কর্মকর্তা আকসাদুল ইসলাম জানান, ‘রোববার থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত বৈধভাবে এক কেজি ইলিশও সীমান্ত পার হয়নি।’ বেনাপোল স্থলবন্দরের এক কর্মকর্তা বলেন, রপ্তানির জন্য রোববার স্থলবন্দরে আসে ইলিশ বোঝাই দুটি ট্রাক। রহস্যজনক কারণে পরে সিদ্ধান্ত বদলে ফিরে যায় তারা।’ বেশি দামে কিনে কম দামে রপ্তানি তাই পাঠানো বন্ধ বলে দাবি করা হলেও খোঁজ নিয়ে মিলেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। ভারত হয়ে তৃতীয় দেশে ইলিশ পাচারের খবর জানাজানি হওয়ার কারণেই বন্ধ হয়ে গেছে আমদানি-রপ্তানি। বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের কলকাতায় মাছের আড়ত আর ফ্ল্যাট থাকার খবরেও শুরু হয়েছে তোলপাড়। দুই দেশের একাধিক ব্যবসায়ী নিশ্চিত করেছেন বিষয়টি। জানা যায়, বাংলাদেশ থেকে বেশি দামে কিনে কম দামে ভারতে রপ্তানি করা হয়। সেখান থেকে গোপনে তৃতীয় দেশে পাচার করে কয়েকগুণ লাভ করে সিন্ডিকেট। ভারতে রপ্তানি হওয়া ইলিশ কলকাতাসহ দেশটির বাজারে বিক্রি হয় সামান্যই।
বহু বছর ধরে চলছে ভারতকে ট্রানজিট বানিয়ে ইলিশ পাচার : ২০০৭ সাল থেকে বন্ধ বাংলাদেশ থেকে ইলিশ রপ্তানি। তারপরও বছরে একবার পূজার সময় ইলিশ পাঠানো হয় ভারতে। এবারও পূজা উপলক্ষ্যে ভারতে ১২শ টন ইলিশ রপ্তানির অনুমতি দিয়েছে সরকার। প্রতি কেজির রপ্তানি মূল্য ধরা হয়েছে সাড়ে বারো ডলার বা ১ হাজার ৫২৫ টাকা। তবে গোল বাঁধে দেশের বাজারে ইলিশের দাম আর ভারতে রপ্তানির নির্ধারিত মূল্য নিয়ে। প্রথম যেদিন যায় ইলিশ, সেদিন দেশের বাজারে এলসি সাইজের (প্রতি পিস ৭শ থেকে সাড়ে ৯শ গ্রাম) কেজি ছিল ১৮শ টাকা। এই দামে কিনে বরফ, প্যাকিং ও পরিবহণ মিলিয়ে ভারত পর্যন্ত পৌঁছাতে খরচ দাঁড়ায় ২ হাজার টাকার বেশি। দ্বিতীয়/তৃতীয় দিনে এসে আরও খরচ যোগ হয়ে ২২শ টাকা পর্যন্ত গিয়ে দাঁড়ায়। যেখানে রপ্তানি মূল্য ১ হাজার ৫২৫ সেখানে ২ হাজার-২২শ টাকা খরচ করে কিভাবে যাচ্ছে ইলিশ তাই নিয়ে ওঠে প্রশ্ন। এর উত্তর খুঁজতে গিয়েই মেলে ভারতকে ট্রানজিট বানিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইলিশ পাচারের কাহিনি। কলকাতার একাধিক মাছ ব্যবসায়ী জানান, ‘বহু বছর ধরেই চলছে এভাবে বাংলাদেশি ইলিশ পাচার। বছরজুড়ে চোরাইপথে বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গে আসে ইলিশ। সেই ইলিশ হিমায়িত করে পুনরায় বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয় ভারত থেকে। কলকাতার কয়েকজন সংবাদকর্মী যুগান্তরকে বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে কেজি ১৯শ থেকে ২ হাজার টাকায় কিনে ভারতে পাঠাতে মোট ব্যয় দাঁড়ায় ২১শ থেকে ২২শ টাকা। ডলারে যার মূল্যমান ২০ থেকে ২১ ডলার। খালি চোখে দেখা লোকসান ৫-৬শ টাকা। তবে পশ্চিমবঙ্গ থেকে সেই ইলিশ বিভিন্ন দেশে পুনঃরপ্তানি হয় কেজিপ্রতি ৪০-৪৫ ডলারে। অর্থাৎ প্রতি কেজিতে লাভ দাঁড়ায় ২০ থেকে ২৪ ডলার বা ২ হাজার ৮০০ টাকা পর্যন্ত। পুরো প্রক্রিয়ায় সহায়তা করে পশ্চিমবঙ্গের কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। বাংলাদেশের অন্তত চারজন রপ্তানিকারকের গদি/আড়ত আছে কলকাতার হাওড়াসহ বিভিন্ন বাজারে। এদের একজন নীরব হোসেন টুটুলের শ্বশুরবাড়ি কলকাতার বশিরহাটে। ৪টি লাইসেন্সে বাংলাদেশ থেকে ইলিশ রপ্তানির অনুমতি পেয়েছেন তিনি। আরও দুই রপ্তানিকারক সেভেন স্টার ফিশ প্রসেসিং করপোরেশন ও কেবিসিসহ টুটুলের আড়ত আছে হাওড়া বাজারে। বশিরহাট, বারাসাত ও হাওড়ায় রয়েছে এদের ফ্ল্যাটসহ মাছ ব্যবসার স্থাপনা। টুটুলের শ্বশুরবাড়ির পাশাপাশি অন্যরাও এখানে (পশ্চিমবঙ্গে) করেছেন আত্মীয়স্বজন। কলকাতার কয়েকজন ব্যবসায়ী নেতার সহায়তায় সেই আত্মীয়স্বজনের নামে করা হয়েছে ভারতীয় রপ্তানিকারকের লাইসেন্স। ওইসব লাইসেন্সেই ভারতকে ট্রানজিট বানিয়ে বিভিন্ন দেশে পাচার হয় বাংলাদেশের ইলিশ। রপ্তানির নামে বাংলাদেশ থেকে যে ইলিশ যায় তার সামান্যই নামে কলকাতার বাজারে। বাকিটা রাখা হয় পাচারের টার্গেটে।’
কলকাতার বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া এসব তথ্যের প্রমাণ মেলে সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার কয়েকজন বাংলা খাবার হোটেলের মালিক ও প্রবাসী বাংলাদেশির কাছ থেকে। সেসব জায়গায় দেদার মেলে পদ্মার ইলিশ। ভারত হয়ে তা যায় বলে জানিয়েছেন তারা। এক্ষেত্রে চুক্তি হয় বাংলাদেশি রপ্তানিকারকদের সঙ্গে।
জানাজানি হওয়ার পর বন্ধ ভারতে ইলিশ রপ্তানি : ভারতকে ট্রানজিট বানিয়ে ইলিশ পাচার নিয়ে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি অনুসন্ধান শুরু করে যুগান্তর। তথ্যপ্রমাণ পাওয়ার পর শনিবার দুই দেশের রপ্তানি ও আমদানিকারকদের সঙ্গে কথা বলেন এই প্রতিবেদক। যথারীতি দুপক্ষই অস্বীকার করে সব। সেই সঙ্গে ঘটে আরও একটি ঘটনা। শনিবার বাংলাদেশ থেকে রপ্তানির জন্য পাবনার সেভেন স্টার ফিশ প্রসেসিং করপোরেশনের দুই ট্রাক ভর্তি ইলিশ যায় বেনাপোল বন্দরে। কিন্তু পরে আকস্মিক সিদ্ধান্তে রপ্তানি না করে ফিরিয়ে আনা হয় ওই ইলিশ। সোমবার যুগান্তরে প্রকাশিত হয় ভারতকে ট্রানজিট হিসাবে ব্যবহার করে বিভিন্ন দেশে ইলিশ পাচারের বিস্তারিত সংবাদ। এরপর পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় ইলিশ রপ্তানি।
সেভেন স্টারের বরিশাল প্রতিনিধি কামাল হোসেন দাবি করেন, ‘ক্রয় মূল্যের চেয়ে রপ্তানি মূল্য কম হওয়ায় ভারতে না পাঠিয়ে যশোরের বাজারে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে দুই ট্রাক ইলিশ।’ দেশের বাজার থেকে যখন কিনলেন তখনই তো জানতেন যে কেনার চেয়ে রপ্তানির দাম কম, তাহলে বেনাপোল পর্যন্ত পাঠিয়ে কেন ফেরত আনলেন-জানতে চাইলে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি।
বাংলাদেশ ফিশ এক্সপোর্টার্স অ্যান্ড ইমপোর্টাস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নিজামউদ্দিন বলেন, ‘ক্রেতা ঠিক করে তারপরই শুধু পাইকারি বাজার থেকে মাছ সংগ্রহ করেন রপ্তানিকারকরা। রপ্তানির জন্য স্থলবন্দর পর্যন্ত নিয়ে ফেরত আনার পেছনে নিশ্চই কোনো কারণ আছে। বিষয়টি সরকারের খতিয়ে দেখা উচিত।’
শুধু সেভেন স্টারই নয়, দেশের বাজার থেকে ইলিশ সংগ্রহ বন্ধ করে দিয়েছে রপ্তানির অনুমতি পাওয়া প্রায় সব প্রতিষ্ঠান। এক সুরে সবাই বলতে শুরু করেছেন, বাজার দরের তুলনায় রপ্তানিমূল্য কম হওয়ায় ইলিশ কিনছেন না তারা। বরিশালের রপ্তানিকারক মাহিমা এন্টারপ্রাইজের ব্যবস্থাপক বাবুল আলীও বলেছেন একই কথা। অথচ রপ্তানি শুরু হওয়ার পর মাত্র ৩ দিনে প্রায় ৭ হাজার কেজি ইলিশ গেছে ভারতে।
বরিশাল চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি এবায়েদুল হক চান বলেন, ‘বেশ বড় একটা সিন্ডিকেট বহু বছর ধরে এই অপকর্ম করছে। এবার সব ফাঁস হওয়ায় রপ্তানি বন্ধ করে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছে।’
জানতে চাইলে পশ্চিমবঙ্গ ফিশ ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আনোয়ার মকসুদ বলেন, ভারত হয়ে তৃতীয় দেশে বাংলাদেশি ইলিশ পাঠানোর অভিযোগ সত্য নয়। বাংলাদেশে ইলিশের দাম অনেক বেশি। এই দামে আমদানি করে পোষায় না। সেজন্য আমরা বাংলাদেশ থেকে ইলিশ পাঠাতে নিষেধ করেছি। প্রথম দুদিনে তো ৭ হাজার কেজি এসেছে। তখন যদি দামে পোষায় তো এখন কেন পোষাচ্ছে না, প্রশ্ন করলে সঠিক কোনো উত্তর দিতে পারেননি ভারতীয় এই ব্যবসায়ী।