চলাচলের অনুপযোগী পটুয়াখালীতে শ' শ' কিমি সড়ক, নজর নেই কর্তৃপক্ষের
প্রকাশ: ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

রাজনৈতিক নেতা ও আমলাদের তদবির এবং টেন্ডার প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্টদের নয়ছয়ের কারণে কম গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা-ঘাটের সংস্কার ও নির্মাণ হলেও জেলার অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ সড়ক চরম অবহেলার শিকার। বছরের পর বছর হাত লাগেনি জেলার কয়েকশ কিমি সড়কে। ফলে পটুয়াখালী জেলার শ’ শ’ কিলোমিটার জনবহুল সড়ক বর্তমানে একেবারে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এতে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্টদের কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেই।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) পটুয়াখালী কার্যালয়ের তথ্যমতে, জেলার মোট ১২,৩৩৮.৩০ কিমি গ্রামীণ সড়কের মধ্যে ৩,১১৪.৪০ কিমি পাকা সড়ক। এর মধ্যে ৬৪৭ কিমি সড়ক চলাচলের একেবারে অযোগ্য হয়ে পড়েছে। দীর্ঘদিন ধরে সংস্কার না হওয়ায় সড়কগুলোর এমন বেহাল দশা হয়েছে। এছাড়া, জেলায় রয়েছে প্রায় ৯,২২৩ কিমি কাঁচা সড়ক, যার বেশিরভাগই সংস্কারবিহীন অবস্থায় পড়ে আছে। এলজিইডি থেকে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) পাঠানো হলেও এখনো তা অনুমোদন পায়নি। ফলে নতুন কোনো সড়ক নির্মাণ কার্যক্রমও শুরু করা যাচ্ছে না।
প্রতিটি উপজেলাতেই শত কিলোমিটারের বেশি সড়ক চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে আছে। এলজিইডি সূত্র অনুযায়ী, বাউফলে ১২০ কিমি, দশমিনায় ৭০ কিমি, গলাচিপায় ৮৫ কিমি, কলাপাড়ায় ৬৫ কিমি, মির্জাগঞ্জে ৭২ কিমি, সদর উপজেলায় ১৫০ কিমি, দুমকিতে ৪০ কিমি এবং রাঙ্গাবালীতে ৪৫ কিমি সড়ক অত্যন্ত নাজুক।
বাউফলের বগা ইউনিয়ন থেকে জেলা সদরের সংযোগ সড়কের প্রায় সাড়ে ৩ কিমি অংশ ভেঙে গেছে। মিলঘর–কালাইয়া–বাউফল সড়কে (৮ কিমি) বড় বড় গর্তের কারণে ইজিবাইক ও মোটরসাইকেল চলাচলে ভয়াবহ দুর্ঘটনার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। ধাউরাভাঙ্গা এলাকার বাসিন্দা আলতাফ মাহমুদ বলেন, ‘বছরের পর বছর রাস্তার এই অবস্থা। মানুষ চরম কষ্টে আছে।’ অথচ গুরুত্ব বিবেচনায় না নিয়ে রাজনৈতিক তদবিরে গ্রামগঞ্জের কোনা-কানাচের রাস্তাও পাকা করা হচ্ছে।
বাউফলের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপজেলা প্রকৌশলী মো. বোরহান উদ্দিন মোল্লা জানান, ‘সাড়ে ৯ কোটি টাকার প্রাক্কলন পাঠানো হয়েছে। অনুমোদন পেলে সংস্কার কাজ শুরু হবে।’
কলাপাড়ার তেগাছিয়া খেয়াঘাট থেকে তুলাতলী চৌরাস্তা পর্যন্ত (৬ কিমি) সড়কের প্রায় ৭৫% কার্পেটিং উঠে গেছে। খানাখন্দে ভরা এ সড়কে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ছে। স্থানীয় চেয়ারম্যান মেজবাহ উদ্দিন খান দুলাল বলেন, ‘অনেকবার বলেছি, কিন্তু শুধু বলা হচ্ছে—হবে, বাস্তবে কাজ হচ্ছে না।’
কলাপাড়া উপজেলা প্রকৌশলী সাদেকুর রহমান জানান, ‘কলাপাড়ায় ৬৫ কিমি সড়ক এখন জরুরি সংস্কারের অপেক্ষায়।’
দশমিনা উপজেলার বহরমপুর–বেতাগি সড়কের ১০ কিমি অংশ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। বর্ষায় পানি জমে যায়, শুকনো মৌসুমে ধুলাবালিতে চলাচল অসম্ভব হয়ে পড়ে। উপজেলা প্রকৌশলী মো. মকবুল হোসেন বলেন, ‘নির্মাণের পর কোনো সংস্কার না হওয়ায় সড়কটির এ অবস্থা। এখনই কাজ না করলে আরও খারাপ হবে।’
গলাচিপা উপজেলা সদর থেকে কলাগাছিয়া সড়কের ২১ কিমির মধ্যে ১৯ কিমিই চরমভাবে জরাজীর্ণ। চরকাজল–চরবিশ্বাস (১০ কিমি) ও উলানিয়া–চিকনিকান্দি (৮ কিমি) সড়কের অবস্থাও করুণ। এসব রাস্তা দিয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ দুর্ভোগ নিয়ে চলাচল করে। ভুক্তভোগী ইউসুফ মোল্লা বলেন, ‘ভাড়ার গাড়িও আসে না। অতিরিক্ত ভাড়ায় ঝুঁকি নিয়ে চলতে হয়।’
গলাচিপা উপজেলা প্রকৌশলী মো. জাহাঙ্গীর আলম জানান, ‘৪০৮.৯০ কিমি পাকা সড়কের মধ্যে ২০০ কিমি সংস্কারের প্রয়োজন, যার মধ্যে ৮৫ কিমি পুরোপুরি নষ্ট। প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দের অভাবে কাজ করা যাচ্ছে না।’
এলজিইডি’র আর্থিক সীমাবদ্ধতার কথা জানিয়ে পটুয়াখালী এলজিইডি’র নির্বাহী প্রকৌশলী মো. হোসেন আলী মীর বলেন, ‘৬৪৭ কিমি সড়ক সংস্কারে প্রয়োজন অন্তত ৪৫২ কোটি টাকা। অথচ বরাদ্দ মিলেছে মাত্র ৬৬ কিমি সড়কের জন্য। বার্ষিক বরাদ্দ অপ্রতুল হওয়ায় টেকসই উন্নয়ন সম্ভব হচ্ছে না।’
তিনি আরো জানান, ‘পটুয়াখালী গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প’ নামে একটি ডিপিপি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। অনুমোদন পেলে নতুন সড়ক নির্মাণ শুরু হবে।
পটুয়াখালীর গ্রামীণ সড়ক ব্যবস্থাপনা এখন এক সংকটময় পরিস্থিতি অতিক্রম করছে। ভাঙাচোরা রাস্তায় প্রতিদিন ঝুঁকি নিয়ে শিক্ষার্থী, কৃষক, রোগীসহ সাধারণ মানুষ চলাচল করছে। যথাযথ বরাদ্দ ও দ্রুত বাস্তবায়ন না হলে এই দুর্ভোগ আরও দীর্ঘায়িত হবে—এমনটাই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
আরও পড়ুন