Advertisement
  • হোম
  • চাকরি
  • ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের ফল, প্রায় ৬০ হাজার শিক্ষক পদ...

১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের ফল, প্রায় ৬০ হাজার শিক্ষক পদ শূন্য, এনটিআরসিএ যা করবে

প্রথম আলো

প্রকাশ: ২৩ আগস্ট, ২০২৫

অষ্টাদশ শিক্ষক নিবন্ধন স্কুল পর্যায়ের পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন পরীক্ষার্থীরা। সারদা সুন্দরী বালিকা উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্র, গোয়ালচামট, ফরিদপুর,ছবি: আলীমুজ্জামান
অষ্টাদশ শিক্ষক নিবন্ধন স্কুল পর্যায়ের পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন পরীক্ষার্থীরা। সারদা সুন্দরী বালিকা উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্র, গোয়ালচামট, ফরিদপুর,ছবি: আলীমুজ্জামান

১৮তম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষার চূড়ান্ত ফল প্রকাশিত হয়েছে। আবেদন করেছিলেন ১৮ লাখ ৬৫ হাজার ৭১৯ জন প্রার্থী। দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষে শিক্ষক নিয়োগে সুপারিশ পেয়েছেন মাত্র ৪১ হাজার জন। অথচ সারা দেশ থেকে শূন্য পদের চাহিদা দেওয়া হয়েছিল ১ লাখ ৮২২টির। ফলে প্রায় ৬০ হাজার পদ খালি থেকে যাচ্ছে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।

এত বিপুলসংখ্যক শূন্য পদ পূরণ না হওয়ায় শিক্ষাসংশ্লিষ্ট অনেকেই বিস্মিত হয়েছেন। তাঁরা বলছেন, আবেদনকারীর বিপুল সংখ্যার তুলনায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া যাচ্ছে না, যা শিক্ষাব্যবস্থার মান নিয়েও নতুন করে প্রশ্ন তুলছে।

বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) তথ্য অনুযায়ী, ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনে প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় অংশ নেন ১৩ লাখ ৪০ হাজার ৮৩৩ জন প্রার্থী। তাঁদের মধ্যে উত্তীর্ণ হন ৪ লাখ ৭৯ হাজার ৯৮১ জন। লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেন ৩ লাখ ৪৮ হাজার ৬৮০ জন এবং উত্তীর্ণ হন ৮৩ হাজার ৮৬৫ জন। মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নেন ৮১ হাজার ২০৯ জন, শেষ পর্যন্ত উত্তীর্ণ হন ৬০ হাজার ৬৩৪ জন প্রার্থী।

কিন্তু পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও সবাইকে নিয়োগে সুপারিশ করা সম্ভব হয়নি। এনটিআরসিএ জানিয়েছে, নিয়োগের শর্ত পূরণ না হওয়া এবং অনেক প্রার্থী যে বিষয়ে আবেদন করেছেন সে বিষয়ে পদ খালি না থাকায় প্রায় ২০ হাজার উত্তীর্ণ প্রার্থীকে সুপারিশের তালিকায় রাখা হয়নি। ফলে শেষ পর্যন্ত নিয়োগ সুপারিশ পান ৪১ হাজার জন।

ষষ্ঠ নিয়োগ সুপারিশ কার্যক্রমের আওতায় এত বেশি পদ খালি থাকার বিষয়ে এনটিআরসিএর সদস্য (যুগ্ম সচিব) ইরাদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা যোগ্য প্রার্থী খুঁজে পাচ্ছি না। অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষক নিবন্ধনের শর্তই প্রার্থীরা পূরণ করতে পারছে না। ইবতেদায়ি মৌলভি পদে প্রায় আট হাজার শূন্য পদ আছে, কিন্তু পাস করেছে মাত্র ৯০০ জন প্রার্থী। সহকারী শিক্ষক (চারু ও কারুকলা) পদে শূন্য পদ প্রায় ৯ হাজার, সেখানে উত্তীর্ণ হয়েছে মাত্র ৫০০ জন। যোগ্য প্রার্থী না পাওয়াটাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।’

শিক্ষাবিশেষজ্ঞরা বলছেন, এত বেশিসংখ্যক শূন্য পদ পূরণ না হওয়ার বিষয়টি দেশের শিক্ষার মান নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। তাঁরা মনে করেন, উচ্চশিক্ষিত তরুণদের একটা বড় অংশ চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছেন না।

এনটিআরসিএর আগের পরীক্ষার ফলাফলও একই রকম সংকেত দিচ্ছে। ১৬তম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন সাড়ে ৯ লাখ প্রার্থী। তাঁদের মধ্যে চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হন মাত্র সাড়ে ১৮ হাজার জন। ১৭তম শিক্ষক নিবন্ধনে আবেদন করেছিলেন ২৪ লাখ ১০ হাজার ৯৬২ জন, চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন মাত্র ২৩ হাজার প্রার্থী। তুলনায় ১৮তম নিবন্ধনে উত্তীর্ণের হার কিছুটা বেশি হলেও চাহিদা অনুযায়ী পদ পূরণে তা যথেষ্ট নয়।

সম্প্রতি বৈষম্যহীন টেকসই উন্নয়ন টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যেই বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি। প্রতি ১০০ জন বেকারের মধ্যে ২৮ জনই উচ্চশিক্ষিত। শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষার ফলও সেই বাস্তবতাকে স্পষ্ট করে তুলছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এস এম হাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, শিক্ষার মান নিয়ে বহু বছর ধরেই প্রশ্ন রয়েছে। শিক্ষক নিয়োগে যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া সেই প্রশ্নকে আরও প্রকট করছে। ১ লাখ ৮২২টির পদের বিপরীতে সুপারিশ পেয়েছেন মাত্র ৪১ হাজার জন। ৬০ হাজার পদ খালি থাকছে। ১৬ ও ১৭তম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষাতেও পদ খালি ছিল। এত বিপুলসংখ্যক পদ খালি রেখে আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে চলছে? এটি বর্তমানে একটি বড় প্রশ্ন। জরুরি ভিত্তিতে সব শূন্য পদে শিক্ষক নিয়োগের জন্য একটি বিশেষ শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা নেওয়া উচিত। কিন্তু তার আগে শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধি, পদোন্নতি, বদলিসহ অন্যান্য পারিতোষিক সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে। শিক্ষকদের জীবনমান উন্নয়নের পদক্ষেপ না নিলে মেধাবীরা শিক্ষক পেশায় আসবে না। প্রতিবছরেই পদ ফাঁকা থাকবে।

শিক্ষাবিদেরা মনে করছেন, শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় আবেদনকারীর সংখ্যা লাখ লাখ কিন্তু যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া দেশের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য একটি বড় সতর্কবার্তা। তাঁদের মতে, শিক্ষক হওয়ার জন্য কেবল ডিগ্রিই যথেষ্ট নয়, দরকার সঠিক দক্ষতা, বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান ও শিক্ষাদানের পদ্ধতিগত দক্ষতা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে আমরা যে সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছি, তা আসলে পুরো শিক্ষাব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে না পারলে এই সংকট আরও গভীর হবে।’

১৮তম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় প্রায় ৬০ হাজার পদ খালি থেকে যাওয়ায় আগামী শিক্ষাবর্ষে অনেক প্রতিষ্ঠান শিক্ষক–সংকটে পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে এনটিআরসিএ জানিয়েছে, পরবর্তী নিবন্ধন পরীক্ষা ও বিশেষ নিয়োগ কার্যক্রমের মাধ্যমে ধাপে ধাপে পদগুলো পূরণের চেষ্টা চলবে।

এনটিআরসিএর চেয়ারম্যান মো. আমিনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘মানসম্মত প্রার্থী না পাওয়ায় প্রতিবছরই অনেক পদ ফাঁকা থেকে যাচ্ছে। এতে করে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। সংকট নিরসনের জন্য আমরা একটি সুপারিশমালা প্রস্তুত করছি, যা শিগগিরই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।’

শিক্ষাবিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু নিয়োগ কার্যক্রম বাড়িয়ে সমস্যার সমাধান হবে না। শিক্ষক তৈরির পর্যায়েই মানোন্নয়নের উদ্যোগ নিতে হবে। নইলে প্রতিবছরই বিপুলসংখ্যক পদ শূন্য থাকবে, আর শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই।

Lading . . .