দীর্ঘ দিনের ক্ষোভ থেকে গণপিটুনি, মা-ছেলে-মেয়ে নিহত
প্রকাশ: ৭ জুলাই, ২০২৫

কুমিল্লার মুরাদনগরে গণপিটুনিতে মা-ছেলে-মেয়ে নিহত হয়েছেন। দীর্ঘ দিনের ক্ষোভ থেকে এলাকাবাসী এ ঘটনা ঘটিয়েছেন বলে জানা গেছে। নিহতরা সবাই মাদককারবারি। মাদক কারবারসহ তাদের নানা অপকর্মে অতিষ্ঠ ছিলেন এলাকাবাসী।
নিহতরা হলেন- রুবি আক্তার (৫৮), তার মেয়ে জোনাকি আক্তার (৩২) ও ছেলে মো. রাসেল (৩৫)। এতে গুরুতর আহত হয়েছেন রুমা আক্তার নামে তার আরেক মেয়ে।
বৃহস্পতিবার সকালে উপজেলার বাঙ্গরা বাজার থানাধীন কড়ইবাড়ী গ্রামে এ ঘটনা ঘটেছে। এদিকে খবর পেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন পুলিশ সুপার নাজির আহমেদ খান, ডিবি সিআইডি পিবিআই এবং র্যাব কর্মকর্তারা। এ ঘটনায় এলাকায় চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে।
পুলিশ এবং স্থানীয়রা জানান, নিহত রুবি আক্তার এবং তার ছেলেমেয়েরা দীর্ঘদিন যাবত এলাকায় মাদক ব্যবসাসহ নানা অপকর্ম করে আসছিল। রুবির বিরুদ্ধে ৯টি মাদক মামলা এবং ২টি সাজা পরোয়ানা রয়েছে। তার মেয়ে নিহত জোনাকির বিরুদ্ধে ৫টি, ছেলে রাসেলের বিরুদ্ধে ৯টি এবং আহত রুমার বিরুদ্ধে ২টি মামলা রয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, বুধবার বিকালে রুবির জামাতা ১৫টি মাদক মামলার আসামি মনির হোসেন ও তার সঙ্গীয়রা স্থানীয় স্কুলশিক্ষক রুহুল আমিনের একটি মোবাইল ছিনিয়ে নেয়। এ ঘটনায় বৃহস্পতিবার সকালে রুবিকে স্থানীয় ইউপি সদস্য বাচ্চু মিয়া এবং আকাবপুর ইউপি চেয়ারম্যান শিমুল বিল্লাল জিজ্ঞাসা করতে যান। তখন ওই দুই জনপ্রতিনিধির ওপর হামলা করা হয়।
এতে এলাকায় চরম উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। পরিস্থিতি এড়াতে ইউপি চেয়ারম্যান শিমুল বিল্লাল এবং সদস্য বাচ্চু মিয়া দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। একপর্যায়ে রুবি এবং তার ছেলেমেয়েরা আশপাশের লোকজনের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন।
এ সময় এলাকার লোকজন ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাদের গণপিটুনি দেন। এতে ঘটনাস্থলেই রুবি এবং তার ছেলে রাসেল ও মেয়ে জোনাকি নিহত হন। গুরুতর আহত অবস্থায় তার অপর মেয়ে রুমা আক্তারকে মুরাদনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যান আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা। পরিস্থিতি সামাল দিতে এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়।
কড়ইবাড়ী এলাকার আবু বকর বলেন, আলোচিত মাদক ব্যবসায়ী রুবি আক্তারের অত্যাচারে অতিষ্ঠ ছিলেন এলাকার লোকজন। তারা বাড়িতে প্রকাশ্যে মাদক ব্যবসা এবং এলাকায় চুরি-ডাকাতি ছিনতাই করত।
রুবি এবং তার ছেলেমেয়েরা এলাকার লোকজনের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত ৮২টি মামলা দিয়েছে। মাদক ব্যবসা চুরি ছিনতাইয়ে কেউ প্রতিবাদ করলেই উল্টো মামলা দিয়ে হয়রানি করত এই পরিবার। তাই অতিষ্ঠ হয়ে এলাকাবাসী তাদের গণপিটুনি দিয়েছেন।
একই এলাকার বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং সাবেক ইউপি সদস্য জহিরুল ইসলাম বলেন, গত ৪০ বছর যাবত এই পরিবারের যন্ত্রণা আমরা ভোগ করে আসছি। তাদের অপকর্ম নিয়ে কেউ কথা বললেই মামলা হামলা নির্যাতন করা হতো। তাদের বাড়িতে নিয়মিত মাদকের আসর ও চোর-ডাকাতের বৈঠক হতো। এলাকার যারাই তাদের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছে তারাই মামলা-হামলার শিকার হয়েছে। আজকের এই গণপিটুনি দীর্ঘ ৪০ বছরের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ।
আকাবপুর ইউপি চেয়ারম্যান শিমুল বিল্লাল বলেন, মোবাইল ছিনতাইয়ের একটি ঘটনা আমি জিজ্ঞেস করতে গেলে আমাকে এবং ইউপি সদস্য বাচ্চু মিয়াকে মারধর করা হয়। আমরা সম্মান বাঁচাতে ঘটনা এড়িয়ে এলাকায় চলে যাই। পরে গ্রামবাসীর সঙ্গে তারা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এতে গণপিটুনিতে মাদক ব্যবসায়ী রুবি তার ছেলে এবং মেয়ে নিহত হয়। আসলে এমন হত্যাকাণ্ড কোনোভাবেই কাম্য নয়; কিন্তু দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ মানুষ ধরে রাখতে পারেনি। এটা একটা চরম ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ।
এদিকে একই পরিবারের তিনজনকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় আবারও দেশব্যাপী আলোচনার প্রেক্ষাপট মুরাদনগর। এ উপজেলাটি রাজনৈতিক সামাজিক এবং নানা ঘটনার কারণে আলোচনায় রয়েছে। গোটা মুরাদনগরেই একটি অস্থিরতা বিরাজ করছে।
সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সভাপতি শাহ আলমগীর খান বলেন, আইন হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা বাড়তে থাকলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বেড়ে যাবে। সামাজিক অস্থিরতা প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও জোরালো ভূমিকা নিতে হবে। পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে অস্থিরতা নিরসনে এগিয়ে আসতে হবে।
বাঙ্গুরা বাজার থানার ওসি মাহফুজুর রহমান বলেন, গণপিটুনিতে রুবি আক্তার, তার মেয়ে জোনাকি এবং ছেলে রাসেল ঘটনাস্থলেই নিহত হয়েছেন। তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই মাদকসহ অন্যান্য অপরাধে মামলা রয়েছে।
তিনি বলেন, রুবির অপর মেয়ে রুমা আক্তারকে মুরাদনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে। এভাবে আইন হাতে তুলে নেওয়া ঠিক হয়নি। আমরা বিষয়টি তদন্ত করে দেখছি। ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পুলিশ সুপার নাজির আহমেদ খান বলেন, তারা অপরাধী হয়ে থাকলে তাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে দিতে পারত। আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে যারাই এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটিয়েছে- তাদের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইন অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা নিহত তিনজনের লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠিয়েছি। এ ঘটনায় মামলা দায়ের করা হবে এবং জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হবে।