সুন্দরবনে বিষপ্রয়োগ ঠেকাতে গিয়ে হামলার শিকার হচ্ছেন বনরক্ষীরা
প্রকাশ: ২৪ জুলাই, ২০২৫
সন্ধ্যা নামলেই সুন্দরবনের খাল আর গহিন বনে নামে আরেক রকম ভয়। নদীর পানিতে তখন বইতে থাকে বিষ। নিস্তব্ধ অন্ধকারে শোনা যায় শুধু পানির খলখল আর দূর থেকে ভেসে আসা মাছ ধরতে নামা কিছু মানুষের ফিসফাস।
২০ জুলাই রাতে সুন্দরবনের শাকবাড়িয়া টহল ফাঁড়ির বনরক্ষীরা খবর পান, খুলনার কয়রা উপজেলার সুন্দরবন–সংলগ্ন ৬ নম্বর কয়রা গ্রামের কিছু লোক বিষ, জাল আর নৌকা নিয়ে বনের দিকে নামছে। অথচ সরকারি নিয়মে ১ জুন থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত তিন মাস পুরো সুন্দরবনে জেলেদের প্রবেশ পুরোপুরি বন্ধ।
টহল ফাঁড়ি থেকে ছোট্ট ট্রলার ছেড়ে শাকবাড়িয়া নদী ধরে এগোলেন চার বনরক্ষী। রাত তখন আরও গাঢ়, চারপাশে নিস্তব্ধতা। দূর থেকে দেখা গেল, বনের গা ঘেঁষে লোকালয়ের ৬ নম্বর কয়রা গ্রামের নদীর তীরে কেওড়াবাগানের আড়ালে তিনটি নৌকা সাজানো। নৌকায় করে ভেসাল জাল, কর্কশিটভর্তি বরফ, বিষসহ পুরো প্রস্তুতি চলছে সুন্দরবনে ঢোকার।
শাকবাড়িয়া টহল ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাহিনুর রহমান ছিলেন সেই টহল দলের নেতৃত্বে। তিনি বলেন, ‘আমরা কাছাকাছি পৌঁছাতেই নৌকায় থাকা লোকগুলো নেমে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। আমরা চার বনরক্ষী তখন নিঃশব্দে নৌকাগুলো জব্দ করে টহল বোটের সঙ্গে বেঁধে ফেললাম। ভাবছিলাম, কাজ শেষ। কিন্তু হঠাৎ রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে ছায়ার মতো ফিরে আসে সেই জেলেরা। সাথে লাঠি, দা আর অশ্রাব্য গালিগালাজ। ওরা ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাদের ওপর। আমাদের সরকারি পোশাক ছিঁড়ে ফেলে এলোপাতাড়ি মারতে থাকে। হামলাকারীরা মারধরের মধ্যেই জব্দ নৌকাগুলোও ছিনিয়ে নিয়ে যায়।’
বন বিভাগের কাশিয়াবাদ ফরেস্ট স্টেশনের কর্মকর্তা নাসির উদ্দীন জানান, ‘শাকবাড়িয়া ফাঁড়িটি আমার স্টেশনের আওতাধীন। ওই রাতে খবর পেয়ে দ্রুত পৌঁছাই। বনরক্ষী ছিলেন চারজন, হামলাকারী ছিল ২০ জনের মতো। আহতদের কয়রা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে চিকিৎসা করিয়েছি।’
এ ঘটনায় সোমবার (২১ জুলাই) কয়রা থানায় বনরক্ষীরা লিখিত এজাহার করেছেন। এজাহারে কয়রা গ্রামের হাসান গাজী, আলাউদ্দিন গাজী, সালাউদ্দিন গাজী, শাহাবুদ্দিন গাজী, শাহিনুর রহমানসহ একাধিক অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির বিরুদ্ধে সরকারি কাজে বাধা, মারধর, ছিনতাই ও হত্যার হুমকির অভিযোগ আনা হয়েছে। বিষয়টি বুধবার (২৩ জুলাই) সকালে প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছেন কয়রা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ইমদাদুল হক।
সম্প্রতি বনরক্ষীদের ওপর এমন আরও হামলার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ১০ জুলাই সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় কয়রা টহল ফাঁড়ির বনকর্মীরা তখন ছাচানাংলা খালের ভেতর টহল করছিলেন। কয়রা টহল ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সজল মজুমদার বলেন, ‘খালে ঢুকে দেখি, দুটো নৌকায় কয়েকজন বসে বিষ ছিটাচ্ছে। আমরা কাছে যেতেই ওরা মাছভর্তি নৌকা ফেলে বনের ভেতর পালাল। কিছুক্ষণ পর ছায়ার মতো হাতে লাঠিসোঁটা নিয়ে ফিরে এসে হামলা করে আমাদের ওপর।’
সাধন মজুমদারের ভাষ্য, ‘ওরা আমাদের সরকারি পোশাক ছিঁড়ে ফেলে, আমাকে আর ট্রলারচালক আলমগীর হোসেনকে বেদম মারতে থাকে। আরেকজনের হাতও ভেঙে যায়। শেষে মাছভর্তি দুই নৌকাও ছিনিয়ে নিয়েছিল।’ পরদিন, ১১ জুলাই, কয়রা থানায় ছয়জনের নাম উল্লেখ করে মামলা হয়। আসামির তালিকায় রয়েছেন কয়রা উপজেলার মহেশ্বরীপুর গ্রামের হারুন সরদার, রেজাউল সরদার, তৈয়বুর সরদার, জুয়েল সরদার, ইসরাফিল গাজী ও আছাদুল সরদার।
এরও আগে গত ১৩ জুন কয়রার জোড়শিং গ্রামের আরেক দলও বনরক্ষীদের থেকে আটক নৌকা ছিনিয়ে নিয়েছিল। আর গত মার্চে হরিণ শিকারের মামলা দেওয়ায় কয়রা টহল ফাঁড়ির তৎকালীন কর্মকর্তা ফারুকুল ইসলামকে রাস্তায় ধরে বেধড়ক মারধর করেছিল দুর্বৃত্তরা। সেই ঘটনার কথা মনে করে তিনি বলেন, ‘রাস্তার ওপরে তুলে কিলঘুষি মেরেছিল, স্থানীয়রা না এলে জান বাঁচত না।’
পশ্চিম সুন্দরবনের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এ জেড এম হাছানুর রহমান বললেন, ‘বনের সুরক্ষায় কোনো ছাড় নেই। বিষ দিয়ে মাছ ধরার বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স। আমাদের বনরক্ষীরা জীবন বাজি রেখে কাজ করছে বলেই মাছ, চিংড়ি, বিষের বোতল, নৌকা জব্দ হচ্ছে। তবে দুর্বৃত্তদের থামাতে গিয়ে ওরাই হামলার শিকার হচ্ছে।’ তিনি জানান, পুলিশ ও বন বিভাগ যৌথভাবে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চালাচ্ছে।