সিন্ডারেলা ম্যান: জীবনযুদ্ধে ঘুরে দাঁড়াতে এই সিনেমাটা দেখতে পারেন
প্রকাশ: ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

শো বিজনেসের পরিবার থেকে এসেছেন রন হাওয়ার্ড। বাবা-মা ছিলেন অভিনয় জগতে। নিজেও ছোটবেলায় ছিলেন ক্যামেরার সামনে, এখন পেছনে। কৈশোরের প্রেমকে পরিণতি দিয়েছেন সফল দাম্পত্যজীবনে। পারিবারিক বাঁধনের গুরুত্বটা হাওয়ার্ড তাই খুব ভালোভাবেই জানেন। সে কারণে তাঁর সিনেমায়ও সম্ভবত পারিবারিক সেন্টিমেন্টগুলো বেশ মর্মস্পর্শী হয়ে প্রকাশ পায়।
‘আ বিউটিফুল মাইন্ড’ এ যেমন জেনিফার কনেলি ও রাসেল ক্রোর দাম্পত্য রসায়ন। খুব মর্মস্পর্শী কিছু ফ্রেম, তীক্ষ্ণ কিন্তু নরম সংলাপ আর চোখে লেগে থাকা ক্যামেরার কাজের সঙ্গে মনে গেঁথে থাকা আবহসংগীত। হাওয়ার্ড ‘আ বিউটিফুল মাইন্ড’ দিয়ে অস্কার জিততে পারেন, কিন্তু কোনো কোনো বিশ্লেষকের মতে, ‘সিন্ডারেলা ম্যান’ সম্ভবত এমন সব ফ্রেমে তাঁর সেরা সিনেমা। মজার বিষয়, দুটোই কিন্তু সত্য ঘটনা অবলম্বনে জীবনীচিত্র।
‘বিউটিফুল মাইন্ডে’ গণিতবিদ জন ন্যাশের চরিত্রে ক্রোকে যতটা জনবিচ্ছিন্ন লেগেছে, সেটা দেখেই সম্ভবত নিউজিল্যান্ডের এই অভিনেতাকে নিজের ‘সিন্ডারেলা ম্যান’ হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন হাওয়ার্ড। কারণ, সিনেমাটা বক্সিং নিয়ে হলেও এর ক্যানভাস অনেক বড়।
তিরিশ-চল্লিশের দশকে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে মহামন্দা, চারপাশে বেকারত্ব, এর মাঝে তিন সন্তান নিয়ে এক পরিবারের টিকে থাকার লড়াই। যে পরিবারের বাবাকে প্রতিদিন নামতে হয় জীবনসংগ্রামে। মহামন্দার আগে সে বক্সার ছিল। হাতের চোটে লাইসেন্স বাজেয়াপ্ত হওয়ার পর দেখতে হয় জীবনের কঠিনতম রূপ। চারপাশে কোথাও কাজ নেই, চেয়েচিন্তে জাহাজঘাটে শ্রমিকের কাজ জোটে কোনো দিন, আবার কখনো সরকারি ‘ভিক্ষা’র (সোশ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট) জন্যও হাত পাততে হয়।
সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর এই গল্পে হাওয়ার্ডের সিন্ডারেলা ম্যান ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন মহামন্দায় সব সাধারণ মার্কিন নাগরিকের আশা-ভরসার প্রতীক। পর্দার এই গল্পটি আসলে ১৯৩৫ থেকে ১৯৩৭ পর্যন্ত হেভিওয়েট বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের খেতাব ধরে রাখা জেমস ওয়াল্টার ব্র্যাডকের। ১৯৩৫ সালে ম্যাক্স বায়েরকে হারিয়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ খেতাব জয়ের আগে ব্র্যাডককে জীবনের যে খাড়া পাহাড় বেয়ে ওপরে উঠতে হয়েছে, যেটার কারণে সাংবাদিক ডেমন রুনিয়ন ব্র্যাডকের নাম দিয়েছিলেন ‘সিন্ডারেলা ম্যান’; প্রচণ্ড হতাশার মাঝেও মানুষকে আশা দেখানোর সেই গল্পেরই চিত্রনাট্য লিখেছেন ‘আ বিউটিফুল মাইন্ড’ এ হাওয়ার্ডের সঙ্গে কাজ করা চিত্রনাট্যকার আকিভা গোল্ডসমান।
আবেগময় ছোট ছোট মুহূর্তের প্রকাশে হাওয়ার্ড যেমন ওস্তাদ, চিত্রনাট্যে সেসব রসদ থাকায় সিনেমাটি দেখে মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, এটা কি শুধুই বক্সিংয়ে সর্বকালের অন্যতম সেরা সিনেমা? ‘ফ্যামিলি ড্রামা’ জনরায়ও তো ‘ক্ল্যাসিক’?
সেটা বিচারের দায় দর্শকের। তবে ক্রো হাওয়ার্ডের সঙ্গে তাঁর এই দ্বিতীয় প্রজেক্টে নিজেকে ভেঙেচুরে গড়েছিলেন। ২০০৩ সালে মুক্তি পাওয়া ‘মাস্টার অ্যান্ড কমান্ডার’ সিনেমায় অভিনয়ের সময় তাঁর ওজন বেড়ে গিয়েছিল। ব্র্যাডকের চরিত্রে মানানসই হতে ২০ কেজি ওজন কমান। বক্সিংয়ের কিংবদন্তি প্রমোটার ও মুহাম্মদ আলীর সাবেক ট্রেনার অ্যাঞ্জেলো ডান্ডির তত্ত্বাবধানে বক্সিং শেখেন বন্ধু ও রাশান বক্সার কস্তাইয়া জাইয়ুর কাছে। ব্র্যাডকের মতোই পাঞ্চ শিখেছেন আর ফুটওয়ার্ক।
হলিউডের চিরকালীন সাফল্যসূত্র ‘র্যাগস টু রিচ’–এর এই গল্পে ক্রো কতটা মানানসই, সে বিষয়ে খ্যাতিমান চিত্র সমালোচক রজার এবার্টের মন্তব্য পড়তে পারেন, ‘ভদ্রলোক বক্সার ব্র্যাডকের এই চরিত্রের জন্য আপনার জেমস স্টুয়ার্ট ও স্পেনসার ট্রেসিকে মনে পড়তে পারে, হয়তো টম হ্যাংকসও। তবে হ্যাংকস ও স্টুয়ার্টকে প্রাইজফাইটার বলে মনে হয় না। সম্ভবত ট্রেসি?’
খেলাধুলার বিষয়টি ক্রোর রক্তেই। নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেট কিংবদন্তি মার্টিন ক্রো ও জেফ ক্রো তাঁর কাজিন। নিজেও ক্রিকেট খেলেন সময় পেলে। ২০০৫ সালে সিন্ডারেলা ম্যান মুক্তির পরের বছরই অস্ট্রেলিয়ার সাউথ সিডনি র্যাবিটহোলসের সহমালিক হন।
হাওয়ার্ডের সিন্ডারেলা ম্যানকে ফুটিয়ে তোলায় দুজন অসাধারণ সহশিল্পীও আছেন। অস্কারজয়ী রেনে জেলওয়েগার ব্র্যাডকের স্ত্রী মায়ে ব্র্যাডকের চরিত্রে অভিনয় করে এম্পায়ার অ্যাওয়ার্ডস জেতেন। আর ব্র্যাডকের বন্ধু ও ম্যানেজারের চরিত্রে অভিনয় করে অস্কারে সেরা পার্শ্ব চরিত্রে অভিনেতার পুরস্কার জেতেন পল গিমাত্তি।
সেরা সম্পাদনা ও সেরা মেকআপেও অস্কার জিতেছে সিন্ডারেলা ম্যান। তাতে টরন্টোয় শুটিংয়ের সময় শহরের একটা বড় অংশ তিরিশের দশকের নিউইয়র্ক শহরের মতো সজ্জায় সাজিয়ে নেওয়ার বড় ভূমিকা আছে। কানাডার ডিপার্টমেন্টাল স্টোর ‘দ্য বে’–এর কুইন স্ট্রিটের শোরুমকে ম্যাডিসন স্কয়ারের সজ্জা দেওয়া হয়েছিল।
হাওয়ার্ডের দলের এই ঐকান্তিক প্রচেষ্টা কতটা সফল, সেটা শুধু অস্কার জয় নয়, প্রেরণাদায়ক একটি উদাহরণেও টের পাওয়া যায়। মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ফুটবল দলকে ২০০৬ মৌসুম শুরুর আগে প্রেরণা দিতে এই সিনেমাটি দেখান কোচ ও ক্রোর বন্ধু লয়েড কার। তবু দল প্রথম ম্যাচে ভালো না করায় ‘সিন্ডারেলা ম্যান’ নিজে গিয়ে বন্ধুর দলকে পরবর্তী ম্যাচের আগে দিকনির্দেশনামূলক কথা বলেন এবং উলভারাইনস নামের সেই দল পরের ম্যাচটা জিতেছিল ৩৮-০ তে!
তবে বক্সিং ভালো না লাগলেও অসুবিধা নেই। রোমান্টিক ড্রামা যাঁরা পছন্দ করেন, তাঁদের মনের মুকুরেও এই সিনেমা সদাজাগ্রত। প্রচণ্ড দারিদ্র্যতার মাঝেও ঘরের বাইরে ফালি ফালি তুষারপাতের ভেতরে জীবনসঙ্গীর হাত ধরে মিষ্টি মিষ্টি সেই রোমান্টিক মুহূর্তটির জন্যও সিন্ডারেলা ম্যান দেখা যায়। কারণ, পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ নিজ নিজ লড়াই জিততে চায়, আর সেই লড়াইয়ে তাঁরা একেকজন সিন্ডারেলা ম্যান বলেই সিনেমাটি গেঁথে যায় একদম মর্মমূলে!
সিন্ডারেলা ম্যান (২০০৫):
পরিচালক: রন হাওয়ার্ড
চিত্রনাট্য: আকিভা গোল্ডসমান, ক্রিস হলিংসওর্থ
অভিনয়: রাসেল ক্রো, রেনে জেলেওয়েগার, পল গিমাত্তি, ব্রুস ম্যাকগিল
মুক্তি: ৩ জুন, ২০০৫
আইএমডিবি রেটিং: ৮.০/ ১০
রানটাইম: ২ ঘণ্টা ২৪ মিনিট।
আরও পড়ুন