ইলেকট্রিক শকে মাছ শিকার, হুমকিতে জীববৈচিত্র্য
প্রকাশ: ১৮ আগস্ট, ২০২৫

দেশ তথ্যপ্রযুক্তিতে এগিয়ে গেলেও এর কিছু অপব্যবহারে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রকৃতি ও পরিবেশ। এরই অপব্যবহার করে নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার সীমান্তবর্তী তিস্তা নদীতে অসাধু একটি চক্র দিন-রাত ইনভার্টারের মাধ্যমে ইলেকট্রিক শক দিয়ে মাছ শিকার করছে। শুধু মাছ নয়, এভাবে জলজ উদ্ভিদ ও অন্যান্য প্রাণিকুলও ধ্বংস হচ্ছে বলে জানিয়েছেন পরিবেশ সচেতন মহল।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ব্যাটারি বা ইনভার্টারের সঙ্গে বৈদ্যুতিক তার যুক্ত করে নদীতে ফেলা হয়। এতে পানিতে প্রবাহিত হয় বিদ্যুৎ। শক খেয়ে ছোট থেকে বড় সব মাছ, এমনকি কুঁচিয়া, কাঁকড়া, ব্যাঙ, শামুক, শৈবালসহ নানা জলজ প্রাণী অচেতন বা মৃত অবস্থায় ভেসে ওঠে। অসাধু জেলেরা এরপর জাল দিয়ে সহজেই সেগুলো সংগ্রহ করে নৌকায় তোলে। এভাবে রেণু মাছ থেকে শুরু করে প্রজননক্ষম মাছ পর্যন্ত নির্বিচারে মারা যায়।
সরেজমিন দেখা যায়, পশ্চিম ছাতনাই ইউনিয়নের কালিগঞ্জ, পূর্ব ছাতনাই ইউনিয়নের ঝাড়সিংহেশ্বর, খগাখরিবাড়ি ইউনিয়নের পাগলপাড়া, টেপাখরিবাড়ি ইউনিয়নের জিহাদ বাজার ও তেলির বাজার, খালিশা চাপানি ইউনিয়নের ছোটখাতা গ্রোয়েন বাঁধ, গোলজারের মেম্বারের বাড়ির নিকটে টি-বাঁধ, বাইশপুকুর, ঝুনাগাছ চাপানি ইউনিয়নের ভেন্ডাবাড়ি, ছাতুনামা, আশ্রয়ণ প্রকল্প, ডনের স্পারসহ নদী এলাকার বিভিন্ন স্থানে প্রকাশ্যে বৈদ্যুতিক শক দিয়ে মাছ ধরা হচ্ছে।
স্থানীয় জেলে আব্দুল মালেক বলেন, আগে আমাদের জালে প্রচুর মাছ উঠত। এখন দিনভর জাল ফেলেও আগের মতো মাছ মেলে না। এই বৈদ্যুতিক শক দিয়েই সব মাছ মেরে ফেলা হচ্ছে। এতে আমরা জেলেরা নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছি।
কৃষক আনোয়ার হোসেন বলেন, মাছ তো কমছেই, এর পাশাপাশি তিস্তায় কুঁচিয়া, ব্যাঙসহ নানা প্রাণীও আর চোখে পড়ে না। এগুলো জমির উর্বরতায় ভূমিকা রাখত। ইলেকট্রিক শক পুরো পরিবেশকে নষ্ট করছে।
স্থানীয় মাছ ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম বলেন, আমরা হাটে আগে দেশি শোল, টেংরা, পুঁটি, বোয়ালসহ নানা প্রজাতির মাছ বিক্রি করতাম। এখন এগুলো বাজারে খুবই বিরল। সব জায়গায় শুধু চাষের মাছ পাওয়া যাচ্ছে।
পরিবেশবিদ ড. হুমায়ুন কবীর বলেন, ইলেকট্রিক শক দিয়ে মাছ ধরা হচ্ছে পরিবেশের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর পদ্ধতি। এতে শুধু মাছ নয়, পুরো জলজ খাদ্যশৃঙ্খল ভেঙে পড়ে। ব্যাঙ, কুঁচিয়া, শামুক ও শৈবালের মতো প্রজাতি ধ্বংস হলে মাটির উর্বরতাও কমে যাবে। দীর্ঘমেয়াদে এটি কৃষি, মৎস্য ও মানবজীবন—সবকিছুর ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে।
মৎস্যবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. মাহবুবুর রহমান বলেন, ইলেকট্রিক শক মাছের প্রজনন চক্রকে সম্পূর্ণভাবে নষ্ট করে দিচ্ছে। রেণু মাছ মারা যাওয়ায় প্রজন্মভিত্তিক বংশবিস্তার ব্যাহত হচ্ছে। ফলে দেশীয় মাছ যেমন—শোল, বোয়াল, টেংরা, পুঁটি—দ্রুত বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এটি শুধু খাদ্য নিরাপত্তার জন্য নয়, জীববৈচিত্র্যের জন্যও ভয়াবহ হুমকি।
উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. মামুনুর রশিদ (অ:দা) বলেন, ইলেকট্রিক শক দিয়ে মাছ ধরা একটি ভয়াবহ পদ্ধতি। এতে শুধু মাছ নয়, সব ধরনের জলজ প্রাণী ধ্বংস হয়। এই কার্যক্রম বন্ধে আমাদের জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে। পাশাপাশি সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান পরিচালনা করে অসাধু জেলেদের আটক করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে ডিমলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ইমরানুজ্জামান বলেন, ইলেকট্রিক শক দিয়ে মাছ ধরা শুধু অবৈধ নয়, এটি পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক হুমকি। প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমরা ইতোমধ্যে বিষয়টি নজরদারিতে এনেছি। যেকোনো সময় যৌথ অভিযান পরিচালনা করে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পাশাপাশি আমরা বিভিন্ন সভা-সেমিনারে স্থানীয় জেলেদের সচেতন করতে নিয়মিত প্রচারণা চালাচ্ছি।