প্রকাশ: ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

রংপুর কারমাইকেল কলেজের প্রধান ফটকের সামনের সড়কটি ছায়াঘেরা। ফটক ধরে কিছু দূর এগোলে চোখে পড়ে একটি সাইনবোর্ড। লেখা, ‘দাঁড়াও পথিকবর, আমার নাম কাইজেলিয়া।’
সাইনবোর্ডটি লাগানো একটি গাছের সামনে। সেটির নামই কাইজেলিয়া। বয়স শত বছরের বেশি। কারমাইকেল কলেজে এই গাছ আরও থাকলেও শতবর্ষী কাইজেলিয়া মাত্র দুটি। এর মধ্যে সাইনবোর্ড দেওয়া গাছটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পশ্চিমে। অন্যটি কলেজের মসজিদের পাশে।
গাছে সাইনবোর্ডটি লাগানো হয়েছিল ২০০৯–১০ সালের দিকে। তাতে যেন গাছটি নিজেই নিজের পরিচয় তুলে ধরেছে। লেখা, ‘আমি Bignoniaceae গোত্রের। আমার বৈজ্ঞানিক নাম Kigelia africana । আমার বাস আফ্রিকা হলেও এই কলেজের প্রতিষ্ঠালগ্নে কতিপয় বৃক্ষপ্রেমিক আমাকে ১৯২০ সালের দিকে এখানে রোপণ করেছিলেন। কারমাইকেল কলেজ ছাড়া বাংলাদেশের কোথাও আমাকে দেখতে পাবে না। এশিয়াতে আমি এখন লুপ্তপ্রায়। যদি তোমরা সঠিক পরিচর্যা না কর, তবে অচিরেই আমি নিঃশেষ হয়ে যাব।’
কারমাইকেল কলেজের গাছ দুটি বিলুপ্ত হয়নি; বরং কাইজেলিয়া দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েছে। এর পেছনে বড় অবদান বাটুল সিংয়ের। একসময় কারমাইকেল কলেজের মালি ছিলেন। বর্তমানে অন্য একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। কাইজেলিয়া টিকিয়ে রাখতে বাটুল সিংয়ের প্রচেষ্টার কথা তাঁর মুখেই শুনব। আগে জেনে নিই দুর্লভ এই গাছটি নিয়ে কলেজেরই উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক সহযোগী অধ্যাপক খালেদ শারাফীর কথা।
খালেদ শারাফী ১৯৭২ সালে কারমাইকেল কলেজে উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্র ছিলেন। তিনি বলেন, ‘তখন আমরা এটিকে দুর্লভ উদ্ভিদ বলে শুনতাম। শিক্ষক হওয়ার পর ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষককে গাছটির বংশবৃদ্ধির জন্য ফল ও তথ্য সংগ্রহ করতে দেখেছিলাম। কিন্তু ফলাফল আসেনি।’
খালেদ শারাফী বলেন, ২০০২ সালের দিকে কাইজেলিয়া সম্পর্কে ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের তখনকার ছাত্র ও বর্তমানে বাংলা একাডেমির সহপরিচালক মো. আবিদ করিম। ২০০৪ সালে বাকৃবির ফসল উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. মোস্তাফিজার কাইজেলিয়ার বীজ থেকে চারা উৎপাদন করতে সক্ষম হন। ওই বছরের ১১ ডিসেম্বর রংপুরের ছান্দনিক সাহিত্য-সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর উদ্যোগে কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের সামনে দুটি ও রংপুর সরকারি কলেজে দুটি চারা রোপণ করা হয়। এরপর মালি বাটুল সিং অনেক বছরের চেষ্টায় চারা উৎপাদনে সক্ষম হলে রংপুরে কাইজেলিয়া গাছের সম্প্রসারণ ঘটে। চিকিৎসাক্ষেত্রে এই গাছের গুণাগুণের কথা বলা হয়। তবে এই নিয়ে তেমন গবেষণা হয়নি।
কাইজেলিয়াগাছের উচ্চতা ২০ থেকে ২৫ মিটার। ফুলের রং মেরুন। এর ফল লম্বাটে ও গোলাকার। একেকটি ফলের ওজন ৫০০ গ্রাম থেকে ২ কেজি। ফল কাঁচা অবস্থায় হালকা বাদামি রঙের। কাঁচা বা পোক্ত—কোনো অবস্থাতেই এই ফল খাওয়া যায় না। ২০০৯–১০ সালের দিকে এমনই একটি ফল বাড়ি নিয়ে চারা উৎপাদনের চেষ্টা করেছিলেন বাটুল সিং। ফলের বাইরের আবরণ শক্ত। তাই ঘষে নরম করেছিলেন, যেন আলো, বাতাস ও পানি ভেতরে সহজে প্রবেশ করে দ্রুত অঙ্কুরোদগম হয়। উদ্ভিদবিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয় স্কারিফিকেশন পদ্ধতি।
সেই সময়ের স্মৃতিচারণা করছিলেন বাটুল সিং। বলছিলেন, ‘যখন বীজ বের করি, তখন বিষাক্ত গন্ধ বের হয়। ভয় পেয়েছিলাম। হাত হলুদ হয়ে গিয়েছিল। পরে পলিথিন হাতে পরে বীজ বের করে নিই। বীজ মাটিতে দেওয়ার পর বিষাক্ততা কেটে গেলে অনেক সময় সেগুলো পিঁপড়া ও পোকায় খেয়ে ফেলেছিল। ফলে চারা গজাত না। কিন্তু হাল ছাড়িনি।’
২০১২-২০২০ সালের দিকে সফল হন বাটুল সিং। ১৫ থেকে ২০টি কাইজেলিয়ার চারা উৎপাদন করেন তিনি। সেগুলো নিয়ে যান কলেজের সে সময়ের অধ্যক্ষ বিনতে হুসাইন নাসরিন বানুর কাছে। তিনি তাঁকে উৎসাহ দেন। এরপর বাড়িসংলগ্ন কলেজের জমিতে কাইজেলিয়ার চারা উৎপাদন চালিয়ে যান বাটুল সিং।
কাইজেলিয়া নিয়ে আশার কথা জানালেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফসল উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. আশরাফুজ্জামান। প্রথম আলো কে তিনি বলেন, কাইজেলিয়া এখন আর বিলুপ্ত উদ্ভিদ নয়। দেশে এখন অনেক কাইজেলিয়াগাছ রয়েছে। ভারতের কেরালাতেও রাস্তার দুই পাশে সারি সারি কাইজেলিয়াগাছ দেখেছেন তিনি। তবে সমস্যা হলো, সব গাছে ফুল ও ফল আসে না। যেমন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০টি গাছের মধ্যে মাত্র ১টিতে ফুল ও ফল আসে। অন্যগুলোতে শুধু ফুল আসে। কেন কাইজেলিয়ার সব গাছে ফুল ও ফল আসে না, তা নিয়ে গবেষণা দরকার।
আরও পড়ুন