ধর্ম ও বিজ্ঞানের সম্পর্ক: পশ্চিমা অনুকরণ থেকে মুক্তির পথ
প্রকাশ: ২২ আগস্ট, ২০২৫

ধর্ম ও বিজ্ঞানের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা আজকের বিশ্বে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিশেষ করে আরব–ইসলামি বিশ্বে এ প্রশ্নটি আরও জটিল। কারণ, আমরা প্রায়ই পশ্চিমা চিন্তাধারার প্রভাবে এ সম্পর্কটি বোঝার চেষ্টা করি। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, কীভাবে আমরা পশ্চিমা চিন্তার অনুকরণ থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের নিজস্ব ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে ধর্ম ও বিজ্ঞানের সম্পর্ক নির্ধারণ করব? এই লেখায় আমরা সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজব।
আজকের বিশ্বে চিন্তাভাবনা ও দর্শনের ক্ষেত্রে দুটি জিনিস খুব গুরুত্বপূর্ণ—আমাদের নিজস্ব পরিচয় ধরে রাখা এবং বিশ্বের অন্যান্য চিন্তাধারার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন। যদি আমরা নিজস্বতা ও বৈশ্বিক সংযোগের মধ্যে ভারসাম্য না রাখতে পারি, তাহলে উদ্ভাবনী সৃজন আমাদের দিয়ে হবে না। আমরা শুধু অন্যের চিন্তার অনুকরণ করতে থাকব।
প্রশ্ন উঠেছে, কীভাবে আমরা পশ্চিমা চিন্তার অনুকরণ থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের নিজস্ব ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে ধর্ম ও বিজ্ঞানের সম্পর্ক নির্ধারণ করব?
নিজস্বতা মানে এমন নয় যে আমরা বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাব; বরং এটি এমন একটি পরিচয়, যা অন্যদের সমৃদ্ধ করে এবং আমাদের চিন্তাভাবনাকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরে। এটি বিচ্ছিন্নতার নিজস্বতা নয়; বরং পরিপূরক ও সমৃদ্ধ নিজস্বতা।
ইসলামি ঐতিহ্য ও বাস্তবতা থেকে উদ্ভূত চিন্তাভাবনার মাধ্যমে আমরা আমাদের সমস্যাগুলোর সমাধান খুঁজতে পারি। হ্যাঁ, এটি অনেক আধুনিক আরব দার্শনিকের বিপরীত, যাঁরা মনে করেন পশ্চিমা বা প্রাচীন গ্রিক চিন্তাধারার অনুকরণ ছাড়া কোনো উপায় নেই।
তহা আবদুর রাহমানের মতে, এ ধরনের অনুকরণ আমাদের চিন্তাকে সীমিত করে দেয় এবং আমাদের নিজস্ব সম্ভাবনাগুলোকে আড়াল করে। আমাদের এমন একটি দর্শন গড়ে তুলতে হবে, যার ভিত্তি হবে একই সঙ্গে আমাদের ঐতিহ্য, আবার সমকালীন পটভূমিও। (তহা আবদুর রাহমান, রুহ আল–হাদাসাহ , আল–মারকাজ আল–সাকাফি আল–আরাবি: ২০০৬, পৃষ্ঠা ১২০)
দর্শন বা চিন্তাভাবনা কখনো শূন্যতায় জন্ম নেয় না। এটি একটি নির্দিষ্ট সময়, সমাজ ও সভ্যতার প্রতিফলন। দর্শন একটি নির্দিষ্ট যুগে জন্ম নেয়, একটি প্রজন্ম এটি বহন করে এবং এটি একটি সমাজের সেবা করে। তাই আমাদের নিজেদের প্রজন্মের সভ্যতাগত অবস্থান নিয়ে ভাবতে হবে। প্রতিটি যুগে মানুষের মানসিক, মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক কাঠামো ভিন্ন হয়। এই কাঠামোগুলো সর্বজনীন হতে পারে, তবে তার আগে এটি আমাদের নিজস্ব পটভূমি থেকে উঠে আসতে হবে।
আমাদের এমন একটি দর্শন গড়ে তুলতে হবে, যার ভিত্তি হবে একই সঙ্গে আমাদের ঐতিহ্য, আবার সমকালীন পটভূমিও।তহা আবদুর রাহমান, রুহ আল–হাদাসাহ, পৃষ্ঠা ১২০
হাসান হানাফি বলেন, সর্বজনীনতা নিজস্বতার পরে আসে। ধর্ম ও বিজ্ঞানের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনায় আমরা প্রায়ই পশ্চিমা চিন্তাধারার প্রভাবে পড়ে যাই। আমরা তাদের কাঠামোর মধ্যে থেকে চিন্তা করি, যা আমাদের সমস্যাগুলোর সমাধান দেয় না; বরং এটি আমাদের চিন্তাকে আরও জটিল করে।
মুসলিম ও আরব চিন্তাবিদেরা প্রায়ই পশ্চিমা আধুনিকতা বা পোস্ট–আধুনিকতার পথ অনুসরণ করেন, যা আমাদের ঐতিহ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। (হাসান হানাফি , মাউকিফুনা আল–হাদারি , দারুল ফিকর: ১৯৮৭, পৃষ্ঠা ৮৯)
ধর্ম ও বিজ্ঞানের সম্পর্ক নিয়ে আমাদের আলোচনা জটিল হয়ে ওঠে কেন? কারণ, আমরা পশ্চিমা চিন্তার সীমাবদ্ধতার মধ্যে আটকে যাই। পশ্চিমা দৃষ্টিকোণে বিজ্ঞান বলতে শুধু প্রাকৃতিক বিজ্ঞান বোঝায় এবং ধর্ম বলতে শুধু বিশ্বাসের বিষয়।
এই ধারণা খ্রিষ্টান ঐতিহ্য থেকে এসেছে, যা আমাদের ইসলামি পটভূমির সঙ্গে যায় না। এই সীমাবদ্ধতা আমাদের সমস্যাগুলোকে আরও জটিল করে। আমাদের এ দুই ধরনের সীমাবদ্ধতা প্রত্যাখ্যান করতে হবে।
তহা আবদুর রাহমান প্রস্তাব করেছেন, আমাদের বিজ্ঞানের ধারণাকে বড় করতে হবে। এটি শুধু প্রাকৃতিক বিজ্ঞান নয়; বরং বুদ্ধির বিভিন্ন স্তরের সমন্বয়। তিনি এটিকে বলেন ‘মারাতিব আল–আকল’ বা বুদ্ধির স্তরগুলো। একইভাবে ধর্মের ধারণাকেও বিস্তৃত করতে হবে। ইসলামে ধর্ম শুধু বিশ্বাস নয়; বরং জীবনের সব দিক জুড়ে থাকে।
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘ইমান ষাটের অধিক বা সত্তরের অধিক শাখায় বিভক্ত। এর সর্বোত্তম হলো, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলা, আর সর্বনিম্ন হলো পথ থেকে ক্ষতিকর বস্তু সরিয়ে ফেলা। লজ্জাও ইমানের একটি শাখা।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৩৫) এই হাদিস থেকে আমরা দেখি, ইসলামে ধর্ম জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিস্তৃত। (তহা আবদুর রাহমান, কাইফা নুফাক্কির, দারুল ফিকর: ২০০৭, পৃষ্ঠা ৭৮)
মুসলিম ও আরব চিন্তাবিদেরা প্রায়ই পশ্চিমা আধুনিকতা বা পোস্ট–আধুনিকতার পথ অনুসরণ করেন, যা আমাদের ঐতিহ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।হাসান হানাফি, মাউকিফুনা আল–হাদারি, পৃষ্ঠা ৮৯
মুসলিম সভ্যতার ইতিহাসে ধর্ম ও বিজ্ঞানের মধ্যে কখনো বিরোধ ছিল না। আমাদের পূর্বপুরুষেরা ধর্ম ও বিজ্ঞানকে একীভূত করে একটি সমন্বয়মূলক মডেল তৈরি করেছিলেন। তাঁরা ধর্মের সংকীর্ণতা থেকে বেরিয়ে ইসলামের ন্যায়বিচারে পৌঁছেছেন। তাঁরা দুনিয়ার সীমাবদ্ধতা থেকে দুনিয়া ও আখিরাতের বিস্তারে গিয়েছেন। তাঁরা মানুষের উপাসনা ছেড়ে একমাত্র আল্লাহর উপাসনায় ফিরেছেন, যাঁর সৃষ্টি ও আদেশে কোনো বিরোধ নেই। পবিত্র কোরআনের নিয়ম ও বিশ্বের নিয়ম একই সত্যের প্রতিফলন।
ধর্ম ও বিজ্ঞানের সম্পর্ক নিয়ে পশ্চিমা অনুকরণ থেকে মুক্তি পেতে হলে আমাদের নিজস্ব ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে হবে। আমাদের ঐতিহ্য ও বাস্তবতা থেকে উদ্ভূত চিন্তাভাবনা আমাদের সমস্যার সমাধান দেবে। বিজ্ঞান ও ধর্মের সংকীর্ণ ধারণা প্রত্যাখ্যান করে আমরা এমন একটি সম্পর্ক গড়তে পারি, যা সৃজনশীল এবং আমাদের সভ্যতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই পথই আমাদের সভ্যতার পুনর্জাগরণের চাবিকাঠি।
সূত্র: ইসলাম অনলাইন