প্রকাশ: ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

মহানবী (সা.) তার বাড়িতে স্ত্রী-কন্যাদের এবং বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াতকারী বহু শিশু-কিশোর এবং যুবকদের, যেমন-হজরত আলী, হজরত যায়েদ, হাসান, হোসাইন, উসামা, আনাস, আব্দুল্লাহ বিন উমর এবং আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস প্রমুখদের অত্যন্ত স্নেহ, ভালোবাসা এবং দোয়ার সঙ্গে এমন উন্নত শিক্ষা দিয়েছেন যে, তারা অনাগত প্রজন্মের জন্য আলোকবর্তিকায় পরিণত হয়েছেন।
কিন্তু এ পুরো শিক্ষা-দীক্ষার সময় তিনি (সা.) কখনো কারও গায়ে হাত তোলেননি আর না কখনো রাগ করে বাড়িতে কাউকে বকাঝকা করেছেন। বিশেষভাবে মহিলাদের সম্মান ও ইসলামের উন্নত শিক্ষা দিয়ে এমন পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন যে, কয়েক বছরের মধ্যেই আরব সমাজে মহিলাদের সেই সম্মান অর্জিত হয়। তার কতক মহান সাহাবি কতক জটিল সমস্যার সমাধান করার জন্য সহধর্মিণীদের কাছ থেকে মতামত নিতেন।
মহানবীর অনিন্দ্য সুন্দর নৈতিক গুণ ও নৈতিক চরিত্রের এমনই প্রভাব ছিল যে, তার সহধর্মিণীরা তার বাড়ির সাদামাটা এবং দারিদ্র্যপূর্ণ জীবনের মোকাবিলায় পার্থিব শোভা-সৌন্দর্য ও ধন-সম্পদের সব প্রলোভন বা প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করেছেন।
মহানবীর সর্বোত্তম নৈতিক গুণাবলী এবং ব্যাকুল চিত্তের দোয়া আর অনবরত সহানুভূতিপূর্ণ উপদেশের ফলেই প্রত্যেক হৃদয়ে, পরিবারে আর পরিবেশে পবিত্র পরিবর্তন আসা আরম্ভ হয়ে যেত। তার সুন্দর ব্যবহার এরূপ হৃদয়কাড়া আর এমন আকর্ষণ-আবেদন ছিল আর তাতে এমন জ্যোতি ছিল যা হৃদয়কে মোহাবিষ্ট করত।
মহানবী (সা.)-এর পবিত্র সাহাবারা (রা.) বর্ণনা করেন, তিনি পরম সহানুভূতিশীল, কোমল প্রকৃতি এবং সহিষ্ণু স্বভাবের অধিকারী ছিলেন। প্রত্যেক মুসলমানের সঙ্গে সদয় ব্যবহার করতেন। তিনি (সা.) বলতেন, কোমলতা বিষয়কে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে তোলে। যে বিষয় থেকে নম্রতা বা কোমলতা বের করে দেওয়া হয় তা অসুন্দর হয়ে যায়।
একজন সাহাবি বর্ণনা করেন, একবার এক যুদ্ধের সময় ভিড়ের কারণে আমার পা মহানবী (সা.)-এর পায়ের ওপর পড়ে, আমার শক্ত জুতার কারণে তার প্রচণ্ড কষ্ট হয়, তখন তিনি (সা.) তার লাঠি দিয়ে এ কথা বলে আমার পা সরিয়ে দেন যে, বিসমিল্লাহ! তুমি আমার পা কে ক্ষতবিক্ষত করেছ। এতে আমার খুবই অনুশোচনা হয়। পুরো রাত চিন্তিত থাকি। পরের দিন কেউ আমার নাম ধরে ডেকে বলে, হুজুর (সা.) তোমাকে ডাকছেন। আমি চরম ভীতি নিয়ে এই ভেবে তার সমীপে উপস্থিত হই যে, সম্ভবত এখন শাস্তি পাব।
কিন্তু তিনি পরম স্নেহের সঙ্গে বলেন, গতকাল আমি আমার লাঠি দ্বারা তোমার পা সরিয়ে দিয়েছিলাম এজন্য আমি খুবই লজ্জিত। এর বিনিময়ে এ আশিটি ছাগল উপহার দিচ্ছি, গ্রহণ কর আর এ বিষয়টি মন থেকে বের করে দাও অর্থাৎ ভুলে যাও। (মুসনাদ দারমি, হাদিকাতুস সালেহিন, পৃ. ৫৭)।
কত না সাদাসিধে জীবন ছিল বিশ্বনবীর। আসাদ গোত্রীয় এক ব্যক্তির কাছ থেকে আ’তা ইবনু ইয়াসার (রহ.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, আমি ও আমার পরিবার বকীউল-গরকদে (মদিনার প্রসিদ্ধ কবরস্থান) অবস্থান করলাম। আমার স্ত্রী আমাকে বলল, রাসূল (সা.)-এর কাছে গিয়ে আমাদের খাওয়ার জন্য কিছু চেয়ে আন এবং আমাদের দৈন্যের কথা বর্ণনা কর। অতঃপর আমি রাসূল (সা.)-এর কাছে গিয়ে দেখি, এক ব্যক্তি মহানবীর কাছে কিছু ভিক্ষা চাচ্ছে এবং রাসূল (সা.) বলছেন, আমার কাছে এমন কিছু নেই যে, আমি তোমাকে দিতে পারি। (এটা শুনে) লোকটি ক্রোধান্বিত হয়ে এই বলতে বলতে ফিরে গেল, আমার জীবনের কসম! তুমি যাকে দিতে চাও তাকেই দাও।
রাসূল (সা.) বললেন, এ লোকটি আমার ওপর এজন্য রাগ করে চলে গেল যে, তাকে কিছু দেওয়ার মতো আমার কাছে নেই। আসাদ গোত্রের লোকটি বলল, আমি রাসূল (সা.)-এর কাছে কিছু না চেয়ে প্রত্যাবর্তন করলাম। এরপর রাসূল (সা.)-এর কাছে যব ও শুকনা আঙুর এলো এবং তিনি আমাদের সেগুলো থেকে দিলেন, এমনকি শেষ পর্যন্ত আল্লাহতায়ালা আমাদের ধনী করে দিলেন। (আবু দাউদ ও নাসাঈ)।
মহানবী (সা.)-এর সুন্দর আচার-ব্যবহারের সুখ্যাতি শুনে দূরদূরান্ত থেকে মানুষ, বিশেষ করে যুবক শ্রেণি বিভিন্ন অঞ্চল থেকে দলে দলে এসে দিনের পর দিন মদিনায় অবস্থান করত আর তার সঙ্গে নামাজ পড়ত এবং পবিত্র কুরআন আর জ্ঞান ও প্রজ্ঞা শিখত। তারা সবাই এ কথাই বলত, তিনি অত্যন্ত কোমলমতি ও নরম হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন আর পরম স্নেহের সঙ্গে তাদের ধর্মের শিক্ষা দিতেন। মহানবীর কথায় এমন প্রভাব ছিল যে, সাহাবিরা তার ভালোবাসা, সন্তুষ্টি এবং দোয়া লাভের জন্য ছিলেন পাগলপারা আর তার প্রতিটি কথার ওপর আমল করার জন্য তারা থাকতেন সদা ব্যাকুল। তারা নামাজ পড়ার ও রোজা রাখার ক্ষেত্রে পরস্পর প্রতিযোগিতা করতেন।
অনেক সময় মহানবী (সা.)কে তাদের এ কথাও বুঝাতে হতো যে, মধ্যমপন্থা অবলম্বন কর, তোমাদের দেহেরও তোমাদের ওপর অধিকার আছে। তোমাদের চোখেরও তোমাদের ওপর অধিকার আছে। তোমাদের স্ত্রী এবং পরিবার-পরিজনেরও তোমাদের ওপর অধিকার আছে। তোমাদের বাড়িতে আগত অতিথিরও তোমাদের ওপর প্রাপ্য আছে। (সহিহ বুখারি, কিতাবুন নিকাহ।) কতই না চমৎকার শিক্ষা ছিল তার।
তাই তো নবীর প্রেমে কবি লিখেছেন-‘নবী মোর পরশমণি/নবী মোর সোনার খনি/নবী নাম জপে যে জন/সেই তো দোজাহানের ধনী’।
মহানবী (সা.)-এর প্রেম-ভালোবাসা, দয়া এবং তার পবিত্রকরণ শক্তির প্রভাবে মানব হৃদয়কে জয় করেছিল এবং সমগ্র বিশ্বে এক মহান-বিপ্লব সংঘটিত করেছিলেন। আমাদেরও তার আদর্শের প্রতিফলন নিজ জীবনে বাস্তবায়ন করে মানুষের মন জয় করতে হবে আর জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবাইকে সম্প্রীতির বাঁধনে আবদ্ধ করতে হবে। তাই আসুন, মহানবীর উম্মত হিসাবে তার ভালোবাসায় পবিত্র এ মাসে আমরা অঙ্গীকার করি মহানবী (সা.)-এর আদর্শ গ্রহণে কুরআনের নির্দেশনা অনুযায়ী জীবন পরিচালনার। আল্লাহতায়ালা আমাদের তৌফিক দান করুন, আমিন।
লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট
masumon83@yahoo.com
আরও পড়ুন