চাঁদাবাজি-হত্যা রোধে প্রয়োজন নৈতিকতা ও ধর্মীয় শিক্ষা
প্রকাশ: ১৬ জুলাই, ২০২৫

রাজধানীর মিডফোর্ড এলাকায় সম্প্রতি ঘটে যাওয়া এক হৃদয়বিদারক ঘটনা গোটা জাতির বিবেককে নাড়া দিয়েছে। একজন নিরীহ ব্যবসায়ী সোহাগকে পাথর মেরে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। এটা কোনো নাটকের দৃশ্য নয়, বাস্তবতার এক জঘন্য চিত্র।
এই বর্বরতা, এই পাষণ্ডতা সভ্য সমাজে কল্পনাও করা যায় না। অথচ আমরা তা নিজের চোখে দেখছি, সংবাদপত্রের শিরোনামে পড়ছি, ভিডিওচিত্রে প্রত্যক্ষ করছি।
আজ প্রশ্ন জাগে, কোন্ সভ্য সমাজে আমরা বাস করছি? মানুষ কি এতটাই নিষ্ঠুর, এতটাই বেহায়া হয়ে গেছে যে, সামান্য অর্থের বিনিময়ে জীবন কেড়ে নেওয়ার মতো ঘৃণ্য অপরাধ করতে দ্বিধাবোধ করে না? ভাবতেও গা শিউরে ওঠে যে, একটি মানুষের জীবন আজ এতটাই তুচ্ছ যে, সামান্য টাকার জন্যও তা হারাতে হয়! জাহিলিয়াত আজ যেন হার মানিয়েছে এইসব দুর্ধর্ষ হত্যাকাণ্ডের কাছে।
এক সময় মানুষ অন্ধকারে সন্তান কবর দিত, আজ আলোর জগতে মানুষ পাথর দিয়ে অপরাধহীন মানুষকে হত্যা করে। পার্থক্য শুধু কালের, মনোভাবের নয়। সেই জাহিলি মানসিকতা আজও টিকে আছে, বরং আরও ভয়ংকর ও নগ্নভাবে আত্মপ্রকাশ করছে।
আমরা যদি বাস্তবতার মুখোমুখি হই, দেখব- চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, খুন, গুম, ধর্ষণ এগুলো আজ আর বিচ্ছিন্ন কোনো অপরাধ নয়। বরং প্রতিটি অপরাধ একটি পূর্ণাঙ্গ নেটওয়ার্কের অংশ। একটি দুষ্টচক্র, একটি অবৈধ রাজনীতি, একটি অপরাধপুষ্ট প্রশাসনিক শিথিলতা এর পেছনে সক্রিয়। আর সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হলো, এই অপরাধীদের অনেকেই সামাজিক, রাজনৈতিক, এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ছত্রছায়ায় নিরাপদ জীবন যাপন করে যাচ্ছে।
আমরা যদি এখনই সংকটের গভীরতা অনুধাবন না করি, যদি যথাযথ প্রতিরোধ ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা না করি, তবে ভবিষ্যৎ আরো অন্ধকার, আরো রক্তাক্ত হবে।
এই চরম নির্মমতা ও পাশবিকতার পেছনে সবচেয়ে বড় যে কারণ, তা হল- আমাদের নৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়। আমাদের সমাজ থেকে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে নৈতিকতা ও ধর্মীয় জ্ঞান। আজ শিশুদের শিক্ষা শুধু চাকরি পাওয়ার জন্য, চরিত্র গঠনের জন্য নয়। ফলে সমাজে তৈরি হচ্ছে এক শ্রেণির ‘শিক্ষিত বর্বর’, যারা আইন জানে, সমাজ জানে, কিন্তু বিবেকহীন।
একটি সমাজ তখনই নিরাপদ হবে, যখন মানুষ নৈতিকতা ও ধর্মীয় চেতনায় ফিরে আসবে, তাহলে তারা অপরাধ থেকেও দূরে থাকবে। আমাদের পাঠ্যপুস্তকে, মসজিদ-মাদরাসায়, স্কুল-কলেজে খুন, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা সৃষ্টি করতে হবে। মানুষকে আল্লাহভীতি ও মানবিকতা শেখাতে হবে।
ইসলামে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে: ‘যে ব্যক্তি একজন নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করে, সে যেন সমগ্র মানবজাতিকে হত্যা করল’। (সূরা মায়েদা: ৩২)
খুনের ঘটনায় মৃত্যুদণ্ডের বিধান থাকলেও তার বাস্তবায়ন খুবই ধীরগতি। দীর্ঘসূত্রিতার কারণে অপরাধীরা উৎসাহ পায়। এজন্য প্রথম কাজ হল দ্রুত বিচারের আওতায় এনে অপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা। পাথর দিয়ে হত্যার মতো জঘন্য অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড ছাড়া অন্য কোনো শাস্তি যথেষ্ট নয়। আর এই শাস্তি হতে হবে দৃষ্টান্তমূলক, দ্রুত এবং জনসমক্ষে কার্যকর করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে কোনো খুনি এমন কাজ করতে সাহস না পায়। আইন যতদিন পর্যন্ত দুর্বল থেকে যাবে, অপরাধী ততদিন সাহসী হয়ে উঠবে।
চাঁদাবাজি ও অপরাধ দমনে নৈতিক ও শান্তিপ্রিয় মানুষদের সংঘবদ্ধ হতে হবে। প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় অপরাধ প্রতিরোধ কমিটি গঠন করে, সন্দেহভাজনদের উপর নজরদারি চালিয়ে প্রশাসনের সহায়তায় সুশৃঙ্খল সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। সিসিটিভি, আলোকসজ্জা, স্থানীয় নজরদারির মাধ্যমে চাঁদাবাজদের মোকাবিলা করতে হবে। ভয় নয়, সাহসী প্রতিবাদই হতে পারে সমাজ রক্ষার ঢাল।
চাঁদাবাজি একটি পুরোনো সমস্যা। তবে ইদানীং এটি রূপ নিয়েছে সশস্ত্র ও সংঘবদ্ধ অপরাধে। কিছু বখাটে যুবক রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় বেড়ে ওঠা গ্যাং সদস্যরা এখন একেকটি এলাকাকে ‘নিজস্ব এলাকা’ দাবি করে চাঁদা তোলে, ব্যবসায়ীকে হুমকি দেয়, যারা টাকা দিতে অস্বীকার করে, তাদের শাস্তি দেয়।
এই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিরোধ না গড়লে তা মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়বে।
সোহাগের মৃত্যু একটি প্রাণের মৃত্যু নয় কেবল, এটি আমাদের সমাজের বিবেকের মৃত্যু। আমরা যদি আজ জেগে না উঠি, প্রতিবাদ না করি, প্রতিরোধ গড়ে না তুলি, তবে আগামীকাল হয়তো আমাদের কেউ এরকম বর্বরতার শিকার হবে। সেদিন কেবল আফসোস করার মতো কিছুই আর অবশিষ্ট থাকবে না।
লেখক: মুহাদ্দিস, ছারছীনা দারুস্সুন্নাত জামেয়ায়ে নেছারিয়া দীনিয়া, নেছারাবাদ, পিরোজপুর।
আরও পড়ুন