Advertisement
  • হোম
  • ধর্ম
  • সারোগেসির মাধ্যমে সন্তান জন্ম দেওয়া জায়েজ?

সারোগেসির মাধ্যমে সন্তান জন্ম দেওয়া জায়েজ?

যুগান্তর

প্রকাশ: ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

24obnd

সন্তান মানুষের জীবনের শ্রেষ্ঠ নিয়ামত। সন্তানহীন দম্পতির হৃদয়ে যে শূন্যতা, তা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না।

চিকিৎসাবিজ্ঞানের অগ্রগতিতে টেস্ট টিউব বেবি কিংবা সারোগেসির মতো পদ্ধতি যখন তাদের কাছে নতুন আশার আলো হয়ে আসে, তখন প্রশ্ন ওঠে—ইসলামে এর স্থান কোথায়?

উত্তর খুঁজতে গেলে শরিয়তের দলিল ও ফিকহবিদদের অভিমত এক অটল সত্য প্রকাশ করে—কিছু পদ্ধতি রয়েছে স্পষ্টভাবে হারাম, আর কিছু সীমিত আকারে জায়েজ।

সারোগেসির মূল ধারণা হলো অন্য নারীর জরায়ু ভাড়া করে সন্তান জন্ম দেওয়া। স্বামী-স্ত্রীর শুক্রাণু ও ডিম্বাণু ব্যবহার করলেও যদি ভ্রূণ অন্য নারীর গর্ভে প্রতিস্থাপন করা হয়, ইসলামে এর কোনো অনুমতি নেই। এ প্রক্রিয়া হারাম।

কুরআনের ভাষায়, তাদেরকে তাদের আসল পিতার নামে ডাকো। এটাই আল্লাহর কাছে অধিক ন্যায়সংগত। (সূরা আহযাব, ৫)

যখন মাতৃত্ব দুই নারীর মাঝে বিভক্ত হয়—একজন জৈবিক, আরেকজন শারীরিক—তখন শিশুর প্রকৃত পরিচয় মিশে যায়। শরিয়ত যাকে রক্ষা করতে এসেছে, সেই বংশ ও পরিচয়ের পবিত্রতা এখানে বিনষ্ট হয়।

রাসুলুল্লাহ (সা.) কঠোর সতর্কবাণী দিয়েছেন, যে ব্যক্তি তার বংশ অন্য কারও সঙ্গে যুক্ত করে, সে জান্নাত থেকে বঞ্চিত হবে। (সহিহ বুখারি, সহিহ মুসলিম)

সারোগেসি সেই অপরাধের আধুনিক রূপ। ফলে আন্তর্জাতিক ইসলামি ফিকহ একাডেমি (OIC), আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, দারুল উলুম দেওবন্দ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের শীর্ষ আলেমরা সর্বসম্মতভাবে ফতোয়া দিয়েছেন—অন্য নারীর গর্ভাশয় ব্যবহার করে সন্তান জন্ম দেওয়া হারাম।

অন্যদিকে যদি কোনো দম্পতি টেস্ট টিউব পদ্ধতিতে শুধুমাত্র নিজেদের শুক্রাণু ও ডিম্বাণু ব্যবহার করেন এবং স্ত্রী নিজেই গর্ভে ভ্রূণ ধারণ করেন, তবে এটি শরিয়তে অনুমোদিত। অর্থাৎ এ পদ্ধতি জায়েজ।

এখানে কোনো তৃতীয় পক্ষ যুক্ত হয় না, বংশ বা পরিচয় বিভ্রান্ত হয় না। তবে এ প্রক্রিয়া কেবল বৈধ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে, সর্বোচ্চ সতর্কতার সাথে সম্পন্ন হতে হবে।

কিন্তু যদি অন্য পুরুষের শুক্রাণু বা অন্য নারীর ডিম্বাণু ব্যবহার করা হয়, তবে এর বিধান নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। এটি ব্যভিচারের সমতুল্য, সরাসরি হারাম। এখানে সন্তান বৈধ দাম্পত্যের ফসল নয়, বরং ভিন্ন দুটি বংশের অবৈধ সংমিশ্রণ।

ফলে ইসলামের অবস্থান পরিষ্কার।

স্বামী-স্ত্রীর শুক্রাণু ও ডিম্বাণু, এবং স্ত্রী নিজেই গর্ভে ধারণ করলে তা জায়েজ।

অন্য নারীর গর্ভাশয় ব্যবহার করলে তা হারাম।

অন্য কারও শুক্রাণু বা ডিম্বাণু ব্যবহার করলে তা হারাম।

এই রায় শুধু ধর্মীয় গ্রন্থে সীমাবদ্ধ নয়, সামাজিক বাস্তবতাও এর সাক্ষী। ভারতে সারোগেসি একসময় ভয়াবহ ব্যবসায় পরিণত হয়েছিল। দারিদ্র্যপীড়িত নারীরা অর্থের লোভে নয়, বরং চাপে পড়ে নিজেদের মাতৃত্ব বিক্রি করতে বাধ্য হতেন। যে মাতৃত্বকে কুরআন ও হাদিস শ্রেষ্ঠ সম্মান দিয়েছে, তাকে যখন বাজারে নামানো হয়, তখন তা মানবমর্যাদার চরম অবমাননা।

এই শোষণ প্রতিরোধেই ভারত সরকার ২০২১ সালে সারোগেসি (রেগুলেশন) আইন পাশ করে। ইসলামের দৃষ্টিতে মাতৃত্বের এ বাণিজ্য কেবল সমাজের জন্য ক্ষতিকর নয়, বরং শরিয়তের সীমা ভাঙার সুস্পষ্ট উদাহরণ।

কুরআন স্মরণ করিয়ে দিয়েছে, “আল্লাহ যাকে ইচ্ছা কন্যা সন্তান দান করেন, যাকে ইচ্ছা পুত্র সন্তান দান করেন, অথবা যাকে ইচ্ছা উভয়ই দান করেন, আর যাকে ইচ্ছা বন্ধ্যা করে দেন”। (সূরা আশ-শূরা, ৪৯-৫০)

সন্তান আল্লাহর দান, মানুষের হাতে তৈরি কোনো বস্তু নয়। তাই সন্তান লাভের চেষ্টা বৈধ হলেও, তা হতে হবে শরিয়তের অনুমোদিত পথে। আল্লাহর বিধান অমান্য করে বিজ্ঞানের সাহায্যে সন্তান পেতে চাইলে সেই সন্তান সুখের আলো নয়, বরং বিভ্রান্তির ছায়া হয়ে দেখা দিতে পারে।

আজকের মুসলিম সমাজের সামনে চ্যালেঞ্জ হলো—বিজ্ঞানের আলোর সঙ্গে শরিয়তের সীমারেখাকে কিভাবে মিলিয়ে নেওয়া যায়। এ আলো যদি শরিয়তের বাগিচায় জ্বলে, তবে তা সত্যিকারের আশীর্বাদ। কিন্তু যদি এ আলো শরিয়তের সীমা ভেঙে আসে, তবে তা অভিশাপে রূপান্তরিত হবে।

সারোগেসি প্রশ্নে শরিয়তের রায় তাই দ্ব্যর্থহীন, অন্য নারীর গর্ভাশয় বা অন্যের শুক্রাণু-ডিম্বাণু ব্যবহার করে সন্তান জন্ম দেওয়া চিরকালই হারাম। আর বৈধ উপায়ে, নিজের স্ত্রীই গর্ভে ধারণ করলে তা জায়েজ। এ সত্য অস্বীকার করার কোনো অবকাশ নেই।

লেখক: শিক্ষার্থী, আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, কায়রো, মিশর

Lading . . .