প্রকাশ: ২ জুলাই, ২০২৫

মূল: ড. আতিয়্যাহ আদলান
অনুবাদ: ফয়জুল্লাহ আমান
বিভিন্ন পরাশক্তির প্রকল্প যখন একে অপরকে ঠেলে সামনে আসছে, সেই টানাপড়েনে কখনও যুদ্ধ বাঁধে, কখনও শান্তি ঘোষিত হয়। কোথা থেকে বিমান উঠবে, কখন ক্ষেপণাস্ত্র গর্জে উঠবে—তা যেন ঠিক হয়ে যায় এসব প্রকল্পের ছায়ায়।
এই প্রকল্পগুলোর সংঘর্ষের মাঝে পড়ে রয়েছে আমাদের উম্মাহ—একটা বিশাল দেহের মতো, যার নিথরতা দেখে বোঝা যায় না সে এখনো জীবিত না কি বহু আগেই মৃত।
যেখানে বিভ্রান্ত ও স্বার্থান্বেষী প্রকল্পগুলো একে অপরকে ছিঁড়ে খাচ্ছে, সেখানে ঐশী দিকনির্দেশনার অনুসারী এই জাতি দাঁড়িয়ে আছে দৃষ্টিহীন, লক্ষ্যহীন অবস্থায়।
এটা কি কেবল কাকতালীয়? নাকি কোনো সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র? এমন কি নয় যে, আমাদের এমন করেই দেখতে চায় এই বিশ্বব্যবস্থা—একটি জাতি, যার আছে কিতাব, আছে নবুয়ত, কিন্তু নেই কোনো স্বপ্ন, নেই কোনো লক্ষ্য, নেই কোনো সুচিন্তিত কর্মকৌশল।
আমরা কি ভুলে গেছি, ইসলাম শুধু আবেগ দিয়ে ছড়ায়নি, বরং এর বিস্তার ঘটেছে সুস্পষ্ট লক্ষ্য নিয়ে দূরদর্শী কর্মকৌশল ও পরিকল্পনার মাধ্যমে।
নবিজি (সা.) সাহাবিদের হিজরতের পেছনে কেবল নিপীড়ন নয়—ছিল দূরদর্শী কৌশল। আবিসিনিয়ায় যারা প্রথম হিজরত করেছিলেন, তাদের অনেকেই ছিলেন কোরাইশের অভিজাত শ্রেণির। ওসমান ইবনে আফফান, উম্মে হাবিবা, জাফর ইবন আবি তালিব—তাদের ওপর মক্কার সমাজের হাত এতটা শক্ত ছিল না।
অন্যদিকে, যারা মক্কার অলিগলিতে চরম নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন, তারাও মানসিকভাবে ভেঙে পড়েননি। চাইলে তারা অস্ত্র হাতে প্রতিরোধ গড়তে পারতেন।
কিন্তু তারা মাথা নত করেন এক কালেমার প্রতি, এক আদেশের প্রতি:
كُفُّوا أَيْدِيَكُمْ
তোমরা তোমাদের হাত গুটিয়ে রাখো। (সুরা নিসা: ৭৭)
তারা জানতেন, পথমত সত্যের জন্ম হতে হয় নিরবতা ও গভীর চিন্তার মধ্যে—not through chaos and fire.
নবিজি (সা.) হিজরতের কথা তখনই ভাবলেন, যখন তিনটি স্তম্ভ দাঁড়িয়ে গেল:
১. একটি নৈতিক ও আত্মিক শক্তিতে বলিয়ান কাফেলা গড়ে উঠল, যারা পরবর্তী ইসলামি রাষ্ট্রের ভিত্তি রচনায় সক্ষম।
২. ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস—তাওহিদ, রিসালাত, আখেরাত—সম্পূর্ণরূপে প্রকাশিত হলো।
৩. শিরকভিত্তিক মানসিকতা ও চিন্তাচর্চা এমনভাবে ধ্বংস হলো যে, কাবার ভেতরে থাকা মূর্তিগুলোও তাদের জাতির চোখে মর্যাদা হারালো।
এই মঞ্চ প্রস্তুত হওয়ার পরই নবিজি (সা.) নতুন ভূমির সন্ধানে অগ্রসর হলেন। হজের মৌসুমে বিভিন্ন গোত্রকে আর শুধু ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত নয়, বরং তিনি জিজ্ঞেস করতেন, কে আমাকে আশ্রয় দেবে, যেন আমি আমার রবের বার্তা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারি?”
এটা ছিল দাওয়াতি কাজের রাষ্ট্রীয় রূপান্তরের সূচনা।
হিজরতের সময় নবিজি (সা.) নিশ্চিত ছিলেন আল্লাহর সাহায্য আসবে। তবুও কেন এত কৌশলী হলেন?
–তিনি সরাসরি উত্তরের রাস্তা ধরে মদিনায় যাননি; বরং দক্ষিণে সাওর গুহার দিকে গিয়েছিলেন।
–সাওর গুহায় কাটিয়েছেন তিন দিন।
–একজন অমুসলিম, কিন্তু বিশ্বস্ত গাইড নিয়োগ করেছেন—আবদুল্লাহ ইবন উরাইকিত।
–খাবার সরবরাহের দায়িত্ব দিয়েছেন আবু বকরের (রা.) মেয়ে আসমাকে, আর সংবাদ আনার কাজ দিয়েছিলেন তার ছেলে আব্দুল্লাহকে।
–আলীকে (রা.) নিজের বিছানায় রেখে শত্রুদের বিভ্রান্ত করেছেন।
জাগতিক সব কর্মকৌশল গ্রহণ করার পর তিনি তাওয়াক্কুল করেছেন। শত্রুরা যখন গুহার মুখে এসে দাঁড়িয়েছে, তখন তিনি বলেছেন:
لَا تَحْزَنْ إِنَّ اللَّهَ مَعَنَا
দুঃখ কোরো না, নিশ্চয়ই আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন। (সুরা তাওবা: ৪০)
নবিজির (সা.) এই কর্মপন্থা উম্মতের জন্য শিক্ষা যে, শুধু আবেগ দিয়ে বিজয় অর্জন করা যায় না। প্রকৃত বিজয় আসে বাস্তবসম্মত কর্মকৌশল ও তাওয়াক্কুলের যুগলবন্দীতে।
এই শিক্ষা সামনে রেখে মুসলিম উম্মাহর কর্তব্য জাতিগত জাগরণের জন্য সঠিক কর্মকৌশল গ্রহণ করা, সুপরিকল্পিতভাবে নিজেদের উত্থান ও উন্নতির সিঁড়ি নির্মাণ করা। হিজরতকে শুধু স্মরণ করলেই হবে না; হিজরতের চেতনায় জেগে উঠতে হবে।