প্রকাশ: ১৮ আগস্ট, ২০২৫

বিশ বছর আগে, ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট, হাঙ্গেরির বিপক্ষে এক প্রীতি ম্যাচে দ্বিতীয়ার্ধে বদলি খেলোয়াড় হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল ‘রোসারিওর সেই ছোট্ট ছেলেটি’। এর পরের দুই দশক লিওনেল মেসিকে নিয়ে গেছে হতাশা থেকে জয়ে, বিতর্ক থেকে অধিনায়কত্বে, অবসর থেকে ফুটবলের শিখরে।
ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে অসাধারণ আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারগুলোর একটির মাইলফলক ও সেরা মুহূর্তগুলো ফিফার সৌজন্যে এখানে উপস্থাপন করা হলো।
ভবিষ্যতের ইঙ্গিত
সিনিয়র দলে অভিষেকের মাত্র এক মাস আগে, মেসি নেদারল্যান্ডসে অনুষ্ঠিত ২০০৫ ফিফা অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপজয়ী দলের মূল চালিকাশক্তি ছিলেন। নাইজেরিয়ার বিপক্ষে ২-১ ফাইনাল জয়ে দুটি গোলসহ টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ ছয় গোল করে তিনি এডিডাস গোল্ডেন বুট ও গোল্ডেন বল জিতে নেন।
অভিষেকের দুঃসহ স্মৃতি
আগস্ট ২০০৫-এ, দিয়েগো ম্যারাডোনার ১৯৭৭ সালের মতোই হাঙ্গেরির বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচে মেসির প্রথম ডাক পড়ে। ঢিলেঢালা জার্সি আর তার চেয়েও বড় শর্টস পরা ১৮ বছরের কিশোর ৬৩তম মিনিটে লিসান্দ্রো লোপেজের বদলি হিসেবে মাঠে নামেন। মাত্র ৪৭ সেকেন্ড পর, বল পেয়ে ভিলমোস ভ্যানচাককে পেছনে ফেরার চেষ্টা করলে টেনে ধরেন হাঙ্গেরিয়ান ডিফেন্ডার। প্রতিক্রিয়ায় এলোমেলোভাবে কনুই তুলতেই লাল কার্ড দেখেন মেসি। ২০২২ সালে দি অ্যাথলেটিককে ভ্যানচাক বলেছিলেন: ‘আমরা জানতাম আর্জেন্টিনা দল শক্তিশালী, কিন্তু এই খেলোয়াড়টিকে দেখতে চেয়েছিলাম—সবাই তাকে ভবিষ্যতের তারকা বলছিল। সম্ভবত তার ক্যারিয়ার আমিই শুরু করেছিলাম!’
অসংখ্য গোলের সূচনা
ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে মার্চ ২০০৬-এর প্রীতি ম্যাচে (ক্যারিয়ারের ষষ্ঠ আন্তর্জাতিক ম্যাচে) মেসি জালে ফেলেন প্রথম আন্তর্জাতিক গোল। কার্লোস তেভেজের সমতাসূচক গোলে অ্যাসিস্ট দেওয়ার পর, স্টেপান টমাসের ভুল পাস ধরে ফেলেন তিনি। তারপর বাঁ পায়ে কাটছাঁট করে জালের কোণায় জাদুকরি শটে গোলটি করেন—খেলার প্রথম ৬ মিনিটের চাঞ্চল্যকর সমাপ্তি ঘটান এভাবে।
বিশ্বমঞ্চে পদার্পণ
২০০৬ জার্মানি বিশ্বকাপে হোসে পেকারম্যানের নেতৃত্বে তেভেজ, হাভিয়ের সাভিওলা, হার্নান ক্রেস্পোদের মতো ভারী ফরোয়ার্ড লাইনের মাঝেই জায়গা পান মেসি। আইভরিকস্টের বিপক্ষে ২-১ জয়ে তিনি বেঞ্চে কাটান। পরে সার্বিয়া ও মন্টিনিগ্রোর বিপক্ষে ৩-০ এগিয়ে থাকা অবস্থায় ৭৪তম মিনিটে তাকে মাঠে নামানো হয়। মাত্র চার মিনিটের মাথায় বক্সে ঢুকে ক্রেস্পোকে ট্যাপ-ইন করান। আরও দশ মিনিট পর তেভেজের পাসে প্রথম বিশ্বকাপ গোল করেন তিনি।
ফাইনালে হৃদয়ভাঙা পরাজয়
২০০৭ নাগাদ মেসি আর্জেন্টিনার অপরিহার্য অংশে পরিণত হন। ভেনিজুয়েলায় কোপা আমেরিকার ফাইনালে পৌঁছাতে তার ঝলকানি ছিল চোখে পড়ার মতো। কিন্তু হুলিও বাপতিস্তার নেতৃত্বে ব্রাজিলের কাছে মারাকাইবো ফাইনালে ৩-০ ব্যবধানে হেরে শিরোপা হাতছাড়া হয়।
স্বর্ণালি মুহূর্ত
২০০৮ বেইজিং অলিম্পিকে আর্জেন্টিনার টানা দ্বিতীয় স্বর্ণপদক জয়ে অবদান রাখেন তিনি। ম্যাজিকাল টুর্নামেন্টের ফাইনালে নাইজেরিয়ার বিপক্ষে আনহেল দি মারিয়াকে বাঁ দিক দিয়ে বল পাঠিয়ে একমাত্র গোলটি করান।
১০ নম্বর জার্সি
২০০৯-এ হুয়ান রোমান রিকেলমের অবসরের পর, নতুন কোচ ও এই জার্সির সবচেয়ে বিখ্যাত মালিক দিয়েগো ম্যারাডোনা মেসিকে দলের ঐতিহ্যবাহী ১০ নম্বর জার্সি দেন। এই জার্সিতে প্রথম ম্যাচেই ভেনেজুয়েলার বিপক্ষে ৪-০ গোলে জয়ে গোল ও অ্যাসিস্ট করেন মেসি। ম্যাচের পর টিওয়াইসি স্পোর্টসকে বলেছিলেন, ‘ম্যারাডোনা আমাকে বলেছিলেন, তিনি তার পরা জার্সিটা আমাকে দিতে চান। তিনি মনে করেন আমি এটা পরার জন্য প্রস্তুত, এখনই সময়। ’
অসাধারণ অধিনায়ক
ম্যারাডোনার কোচিংয়ে আর্জেন্টিনা ২০১০ বিশ্বকাপে খেলে। গ্রুপ পর্বের গ্রিসের বিপক্ষে খেলায় হাভিয়ের মাচেরানোকে বেঞ্চে রেখে মেসিকে প্রথমবার অধিনায়কত্ব দেওয়া হয়। সেদিন ২-০ জয়ে ভূমিকা রাখলেও কোয়ার্টার ফাইনালে জার্মানির কাছে ৪-০ গোলে হেরে বিদায় নেন তারা। পরের বছর কোপা আমেরিকায়ও দ্রুত বিদায়ের পর, নতুন কোচ আলেহান্দ্রো সাবেল্লা ২৪ বছর বয়সে মেসিকে স্থায়ী অধিনায়ক বানান।
আবারও জার্মানির কাছে স্বপ্নভঙ্গ
২০১৪ ব্রাজিল বিশ্বকাপে অধিনায়ক হিসেবে মেসির নেতৃত্বে উজ্জ্বল পারফরম্যান্স আসে। বসনিয়া ও ইরানের বিপক্ষে একক নৈপুণ্যে গোল করেন তিনি। নাইজেরিয়ার বিপক্ষে আরও দুটি গোল (একটি চমৎকার ফ্রি-কিক) করেন। সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে দি মারিয়ার জয়সূচক গোলে অ্যাসিস্ট দেন, বেলজিয়াম ও নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষেও দাপুটে নেতৃত্ব দেন। কিন্তু ফাইনালে গিয়ে মারিও গোটশের অতিরিক্ত সময়ের গোলে জার্মানির কাছে ১-০ ব্যবধানে হেরে শিরোপা হাতছাড়া হয়। ট্রফি না পেলেও টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় হিসেবে এডিডাস গোল্ডেন বল জেতেন মেসি।
চিলির দুঃস্বপ্ন
২০১৫ কোপা আমেরিকা ও ২০১৬-র শতবার্ষিকী সংস্করণে আর্জেন্টিনার দুটি সুযোগ ছিল ১৯৯৩-পরবর্তী প্রথম মহাদেশীয় শিরোপা জেতার। দুটি ফাইনালেই মেসি ঝলমলে ফর্মে ছিলেন—২০১৬-তে গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতাকে পেছনে ফেলে দেশের সর্বকালের সেরা গোলদাতা হন। কিন্তু দুটি ফাইনালেই চিলির বিপক্ষে পেনাল্টি শুটআউটে হেরে যান। দ্বিতীয় হারটির পর ২৯ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে অবসর নেওয়ার ঘোষণা দেন, তবে এক মাসের মধ্যেই সিদ্ধান্ত বদলান। তার ভাষায়, 'ভেতর থেকে সমস্যা ঠিক করতে' চেয়েছিলেন।
রাশিয়া ২০১৮
মেসি সিদ্ধান্ত না বদলালে হয়তো আর্জেন্টিনা ২০১৮ বিশ্বকাপে খেলতেই পারতো না। কোয়ালিফায়ারে ইকুয়েডরের বিপক্ষে শেষ ম্যাচে হ্যাটট্রিক করে ১৯৭০ থেকে ধারাবাহিকভাবে বিশ্বকাপ খেলার রেকর্ড বাঁচান। বিশ্বকাপে নাইজেরিয়ার বিপক্ষে চমকপ্রদ গোল করে গ্রুপ পর্ব পার করেন। ফ্রান্সের বিপক্ষে উত্তাল প্রাক-কোয়ার্টার ফাইনালে দুটি অ্যাসিস্ট দিলেও ৪-৩ ব্যবধানে হেরে বিদায় নেন।
চেনা অনুভূতির পুনরাবৃত্তি
রাশিয়া বিশ্বকাপের পর লিওনেল স্কালোনির কোচিংয়ে মেসি প্রায় ৯ মাস দলে অনুপস্থিত ছিলেন। ২০১৯ কোপা আমেরিকায় ফিরে চিলির বিপক্ষে তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় লাল কার্ড দেখেন।
দশম চেষ্টায় সাফল্য
২০২১ কোপা আমেরিকা কলম্বিয়া-আর্জেন্টিনায় হওয়ার কথা থাকলেও করোনা মহামারির কারণে ব্রাজিলে সরিয়ে নেওয়া হয়। এবার আর হারেননি "লা পালগা"। ফাইনালে পৌঁছাতে চার গোল ও পাঁচ অ্যাসিস্ট দেন—একই সঙ্গে ১৪৮ ম্যাচে মাচেরানোকে পেছনে ফেলে সর্বাধিক ম্যাচ খেলা আর্জেন্টাইন ফুটবলার হন। ব্রাজিলের বিপক্ষে মারাকানার ফাইনালে নিজের সেরা ফর্মে না থাকলেও দি মারিয়ার প্রথমার্ধের গোলে দশম চেষ্টায় প্রথম সিনিয়র আন্তর্জাতিক শিরোপা জেতেন।
ওয়েম্বলিতেই আবারও মেসি-জাদু
রিও জয়ের পর কোপা আমেরিকা ও ইউরো চ্যাম্পিয়ন ইতালির বিরুদ্ধে ফাইনালিসিমা খেলার সুযোগ পায় আর্জেন্টিনা। ওয়েম্বলিতে মেসি দুটি অ্যাসিস্ট দিয়ে দাপুটে ৩-০ জয় নিশ্চিত করেন।
লুসাইলের রোমাঞ্চকর ফাইনালে রাজমুকুট
কাতার বিশ্বকাপ নিশ্চিতভাবেই তার শেষ হবে বলেছিলেন মেসি—লক্ষ্যভেদের শেষ সুযোগ। শেষই যদি হয়, তবে তা তিনি অবিস্মরণীয় করে রাখতে চেয়েছিলেন। সৌদি আরবের বিপক্ষে উদ্বোধনী ম্যাচে হারের পর একাই দলের হাল ধরেন। পরের ম্যাচে একক প্রচেষ্টায় মেক্সিকোকে হারান। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে গোল করে দলকে শেষ ১৬-তে পাঠান। নেদারল্যান্ডস ও ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে গোল ও অ্যাসিস্ট দিয়ে দলকে ফাইনালে পৌঁছে দেন। ফ্রান্সের বিপক্ষে রোমাঞ্চকর ৩-৩ ড্রতে দুটি গোল করেন। এরপর চাপের মুখেও পেনাল্টি শুটআউটে গোল করে জিতে নেন ফুটবলের সর্বোচ্চ সম্মান।
শত গোলের মাইলফলক
২০২৩-এর মার্চে পানামা ও কুরাকাওর প্রীতি ম্যাচে ঘরে ফেরে উৎসবমুখর আর্জেন্টিনা দল। কিন্তু মেসির নজর রেকর্ডে। পানামার বিপক্ষে এক গোল করে আন্তর্জাতিক গোলসংখ্যা ৯৯-এ নিয়ে যান। কুরাকাওর বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো ও আলী দাইয়ের পর তৃতীয় পুরুষ ফুটবলার হিসেবে শত গোলের ক্লাবে নাম লেখেন।
ঘরেই শিরোপার স্বাদ
ইন্টার মায়ামিতে যোগ দেওয়ার এক বছর পর, ২০২৪ কোপা আমেরিকা ফাইনালে মায়ামিতে কলম্বিয়ার মুখোমুখি হয় আর্জেন্টিনা। গোলশূন্য ম্যাচে অধিনায়ক মেসি এক ঘণ্টার মাথায় আঘাত নিয়ে মাঠ ছাড়লেও স্কালোনির দল লড়ে যায়। অতিরিক্ত সময়ে লাউতারো মার্তিনেজের গোলে রেকর্ড ১৬তম শিরোপা জিতে নেয় তারা।
আর্জেন্টিনার জার্সিতে মেসির রেকর্ডসমূহ
-সর্বাধিক ম্যাচ: ১৯৩
-সর্বাধিক গোল: ১১২
-ফিফা বিশ্বকাপে সর্বাধিক গোল: ১৩
-এক ক্যালেন্ডার বছরে সর্বাধিক গোল: ১৮ (২০২২-এ ১৪ ম্যাচে)
-সর্বাধিক হ্যাটট্রিক: ১০
-বিশ্বকাপের ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ অধিনায়ক: ২২ বছর ৩৬৩ দিন
মেসির বিশ্বকাপ রেকর্ড
-সর্বাধিক ম্যাচ: ২৬
-অধিনায়ক হিসেবে সর্বাধিক ম্যাচ: ১৯
-সর্বাধিক মিনিট খেলা: ২,৩১৪
-নকআউট পর্বে সর্বাধিক অ্যাসিস্ট: ৬ (পেলের সাথে যৌথভাবে)
-সর্বাধিক বিশ্বকাপে অ্যাসিস্ট দেওয়া: ৫টি টুর্নামেন্ট
-সর্বাধিক ম্যাচসেরা খেলোয়াড়: ১১ বার
-একক বিশ্বকাপে প্রতিটি নকআউট রাউন্ডে গোল করা একমাত্র খেলোয়াড় (কাতার ২০২২: গ্রুপ পর্ব, রাউন্ড অফ ১৬, কোয়ার্টার, সেমি, ফাইনাল)
-প্রথম ও সর্বশেষ বিশ্বকাপ গোলের মধ্যে দীর্ঘতম ব্যবধান: ১৬ বছর ১৮৪ দিন
-একমাত্র খেলোয়াড় যিনি দুবার এডিডাস গোল্ডেন বল জিতেছেন
-কনমেবল বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে সর্বাধিক গোল: ৩৪
-একমাত্র খেলোয়াড় যিনি কৈশোর, যৌবন ও ৩০-এ বিশ্বকাপে গোল করেছেন
মেসির কোপা আমেরিকা রেকর্ড
-সর্বাধিক ম্যাচ: ৩৯
-সর্বাধিক জয়: ২৫
-সর্বাধিক অ্যাসিস্ট: ১৮
-সাতটি টুর্নামেন্টে গোল করা প্রথম আর্জেন্টাইন
-পাঁচটি ফাইনালে খেলা প্রথম খেলোয়াড়
এমএইচএম
আরও পড়ুন