কোহলি, আপনি শুধু বাণিজ্যিক নন, আর্ট ফিল্মেরও নায়ক
প্রকাশ: ৯ জুন, ২০২৫

আইপিএলের ফাইনালে মাঠে বিরাট কোহলিকে অশ্রুসজল দেখা গেল। আবেগ ভর করেছিল তাঁর শরীর ও মন জুড়ে। এই কোহলিকে দেখে অনেকের স্মৃতির অ্যালবাম থেকে বেরিয়ে আসতে পারে অনেক পাতা। সেসব পাতায় অনুচ্চারে লেখা কথাগুলোই বলার চেষ্টা করা হলো—
জানি কথাটা আক্ষরিক অর্থে বলেননি। এখন শান্তিতে ঘুমাতে পারবেন, এটাই অন্তর্নিহিত অর্থ। তবে একটা মানুষ কখন বলেন—‘এখন আমি শিশুর মতো ঘুমাতে পারব?’ বুঝি, বুঝি! খুব সহজে কি ত্রিশোর্ধ্ব পুরুষের চোখ লাল হয় নাকি! মনের ভেতরে উত্তাল-পাতাল সাগরে জলোচ্ছ্বাস তৈরি হলেই কেবল চোখ ছলছল করে।
যেমনটা আপনাকে দেখা গেল কাল রাতে। সে অশ্রুর বয়স ১৮ বছর, সে টলটল চোখের ভাষায় বর্ণহীন শব্দে যে পরিতৃপ্তির মোড়ক—আসল কথাটা লুকিয়ে তার ভেতরে। কতটা শান্তি পেলে ক্রিকেটের সব ঘাটের জল খাওয়া একটা মানুষ শিশুর মতো হয়ে উঠতে পারে!
প্রিয় কোচ রবি শাস্ত্রীকে কাছে পেয়ে যেভাবে তাঁর বুকে কোহলি আশ্রয় নিলেন, ওটা তো শিশু-কিশোরদেরই কাজ! দীর্ঘ ১৮ বছর অপেক্ষার পর যা পেলেন, আপনার আসলেই একটা ঘুম প্রয়োজন। সে ঘুম হোক জোসনালোকের মতোই প্রশান্তিময়, মায়ের মতোই আপন।
১৮ বছর বয়সে বেঙ্গালুরু দলে যোগ দিয়েছেন। এখন চলে ৩৬। এই কোহলি ও সেই কোহলির পার্থক্য স্পষ্ট। আগ্রাসী ভাবটা আগের মতোই আছে। কিন্তু ঝাঁজটা কমে অভিজ্ঞতা বেড়েছে।
আঠারোর সেই কৈশোর পাড়ি দেওয়া দেওয়া সময়ে চুল ছিল তাঁর অনেক প্রিয়। বন্ধুরা মজা করে চুলে হাত দিলে কতটা বিরক্ত হতেন, তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ভাইরাল হয়েছে। কিন্তু জীবন এখন তাঁকে নতুন এক সুর গেঁথে দিয়েছে, যেটার তাল–লয় স্থিতধী। এখন মাঠে থেকেই খোঁজ নেন গ্যালারিতে বসে থাকা স্ত্রী খেয়েছেন কি না।
কোহলি, মানুষ বদলায়, আপনিও বদলেছেন। তবে মানুষের সবকিছু পাল্টে গেলেও শেকড়টা থাকে। বেঙ্গালুরু শহরটা, এই শহরের এই ফ্র্যাঞ্চাইজিটি কোহলির সেই শেকড়। সেখান থেকে গজানো চারা গাছ কৈশোর ও তারুণ্য পেরিয়ে এখন পরিণত ‘মহীরুহ’—এসবটাই বেঙ্গালুরুর হাওয়া–জলের অবদান। আর এই শহর, এই ফ্র্যাঞ্চাইজির জন্য কোহলির অবদান? শুধু নামটাই তাঁর বিরাট কোহলি—জাতীয় দল বাদে বাকি সবটাই তো রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর জন্য!
লটারিতে আপনি জেতেননি। আপনি লড়াকু, প্রতিবার হোঁচট খেয়ে আবারও উঠে দাঁড়িয়েছেন, আবারও কোমর বেঁধে লড়াই করেছেন। ২০২১ সালে যখন অধিনায়কত্ব ছেড়ে দিলেন, সেদিনই ঘোষণা দিয়েছিলেন আইপিএলে নিজের শেষ ম্যাচটিও বেঙ্গালুরুর হয়ে খেলবেন। সেগুলো শুধু কথার কথা নয়, সবার জন্য বার্তাও।
কারণ, ধারাবাহিক ব্যর্থতায় বেঙ্গালুরু তখন পথহারা দল। আপনি সেই দলের অধিনায়কত্ব ছাড়লেন ঠিকই কিন্তু ফিরলেন আরও বড় নেতা হয়ে। চাইলেই যেকোনো দলে যেতে পারতেন। আইপিএলে নিশ্চয়ই আপনার দলের অভাব হতো না!
কিন্তু বেঙ্গালুরু নামে যে ‘শেকড়’ এর কথা বলা হলো, শুধু শিরোপা জিততে না পারায় সেই বন্ধন ছিন্ন করে অন্য কোথাও গেলে সেটা জাত লড়াকুর পরিচয় হতো না। জাত লড়াকু হলেন তাঁরাই—মনটা যে ‘ভূমি’র জন্য তাঁরা সমর্পণ করেন, লড়াইটাও আমৃত্যু তাঁদের হয়েই।
কোহলি, আপনি তেমন এক লড়াকু, যে আইপিএল নামের সুমদ্র–মন্থনে নেমে বার বার ডুবেও চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞায় বার বার ভেসে শেষ পর্যন্ত এবার বেঙ্গালুরুর জন্য তুলে আনতে পারলেন ‘সাত–সাতটি নীল পদ্ম’। কোহলি আবেগ তো আপনাকে এখন ছেঁকে ধরেছে, তাই সহজ কথাটাও নাও বুঝতে পারেন। আনুশকা শর্মাকে জিজ্ঞাসা করতে পারেন। তিনি অবশ্যই বলবেন, এটা ভাগ্য নয়, এটাকে নিজ হাতে ভাগ্যগড়া বলে!
আইপিএলে আপনার সেরা মৌসুম কোনটি? চোখ বুঝে ২০১৬ সাল বেছে নেওয়া যায়। চার সেঞ্চুরিতে এক মৌসুমে ৯৭৩ রান অবিশ্বাস্য বললেও কম বলা হয়! কথায় আছে, একবার শিখরে উঠলে ধীরে ধীরে নাকি নেমে যেতে হয়। আপনাকে দেখলে কথাটা মিথ্যা মনে হয়। ২০১৬ সালের পর কোহলি ৪০০ বা এর বেশি রান করেছেন সাতবার।
গত তিন মৌসুমেই করেছেন ৬০০–এর বেশি রান। এ সময়ে আপনারই সমবয়সী অনেক ক্রিকেটারদের পারফরম্যান্সের গ্রাফ নিম্নমুখী হলেও আপনি কোন ধাতুতে গড়া কে জানে! এবারও তো আট ম্যাচে ফিফটি। আপনার খুদে ভক্তরা নিশ্চয়ই এসব জানে। তবে এই নিবেদনের ভেতরের বার্তাটা তাঁরা ধরতে পারছে কি না, সেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—মানুষের সক্ষমতার আসলে কোনো সীমা নেই।
শুধু ইচ্ছা ও চেষ্টায় সৎ থাকতে হয়। তাহলে প্রতিনিয়ত নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়া সম্ভব। আপনাকে দেখে আপনারই সমবয়সী কোনো ভগ্নহৃদয়ের মানুষ কিংবা হতাশায় ডুবে যাওয়া কোনো কিশোর যদি আবারও মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ান, তবে সেটার মূল্য নিশ্চয়ই এই খেলা–টেলার চেয়েও বেশি। কোহলি আপনি নিশ্চিত থাকুন, আপনাদের দেশে এমন মানুষ প্রচুর। কাল বেঙ্গালুরুর জয়ের পর তাদের আওয়াজটা নিশ্চয়ই শুনেছেন!
ফাইনাল শেষে ক্রিস গেইল ও এবি ডি ভিলিয়ার্সকে মাঠে দেখা গেল। আবেগ কোহলির চেয়ে তাদেরও কম না। এমনটাই তো হওয়ার কথা! তারাও তো বেঙ্গালুরুর। ২০১১ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত গেইল বেঙ্গালুরুতে খেলেছেন। সারা দুনিয়ায় যে গেইল–ভীতি, সেটা মূলত এই বেঙ্গালুরুর গেইলের কারণেই।
ডি ভিলিয়ার্স বেঙ্গালুরুতে খেলেছেন ১০ বছর। তিন কিংবদন্তি থাকার পরও বেঙ্গালুরু কেন শিরোপা জেতেনি, সেটা গবেষণার বিষয় হতে পারে। তবে ফাইনালের জন্য এ দুজনকে ভারতে নিয়ে আসা আর ফাইনাল জিতে ‘এ শিরোপা আমার জন্য যতটা প্রাপ্য তাদেরও ততটাই’—কথাটা বলা তো সবাই পারে না।
সাবেকদের যে এভাবে ভালোবাসা যায়, পূর্বতন সব অবদানের জন্য বিজয় মঞ্চটা যে তাদেরও প্রাপ্য, এভাবে ভাবতে পারাও তো ভক্তদের একটি বিষয় শিখিয়ে দেয়—পেছনে ফেলে আসা পথে অমন সঙ্গীরা ছিলেন বলেই আজ আপনি এতটা সামনে। এই যে স্বীকৃতি সেটা আপনার কাভার ড্রাইভের মতোই শিক্ষণীয়।
কোহলি, আপনি যে শুধু আইপিএলেরই বড় তারকা তা তো নয়, টেস্ট ছাড়লেও এই সংস্করণের একজন বড় মাপের দূত। আর এই অনুভূতিটা যে আপনি চাইলেও এড়াতে পারেন না, সেটা তো বোঝা গেল ফাইনাল শেষেই। সম্প্রচারকদের বলেছেন, ‘এই মুহূর্তটি (আইপিএল জয়) ক্যারিয়ারের সেরা মুহূর্তগুলোর একটি। কিন্তু তারপরও এটা টেস্ট ক্রিকেট থেকে পাঁচ স্তর নিচে। টেস্ট ক্রিকেটকে আমি এতটাই মূল্য দিই, এতটাই ভালোবাসি।’
আসলে এই ‘সাদা’ ভালোবাসাটুকুই আপনার ভেতরকার সারবস্তু। বাকি সব অলংকার। চাইলে সিনেমার সঙ্গেও মিলিয়ে নিতে পারেন। টি–টোয়েন্টিকে যদি বাণিজ্যিক সিনেমা ধরা হয় টেস্ট তবে আর্ট ফিল্ম। রুপালি পর্দায় যাঁরা সত্যিকারের কিংবদন্তি, যাঁরা চিরকালীন, তাঁদের বেশির ভাগই কিন্তু বাণিজ্যিক সিনেমার পাশাপাশি আর্ট ফিল্মেও অভিনয় করেছেন একই মনোসংযোগে।
শুধু অভিনয় কেন, এ দুই ভুবনেই যাঁরা কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে উঠতে পেরেছেন, ক্রিকেটের ভুবনে আপনি তো তাঁদেরই এক প্রতিনিধি। যে কি না টি–টোয়েন্টিতে ঝড় তোলার পরও হয়তো বলবেন, আহা, টেস্টে দুই–আড়াই সেশন নদীর শান্ত স্রোতের মতো ব্যাটিং করার অনুভূতির সঙ্গে কোনো কিছুর তুলনা চলে না।