Advertisement
  • হোম
  • খেলা
  • প্রবাসীরাই কি দেশের ফুটবল মুক্তির পথ? নাকি সাময়িক ...

প্রবাসীরাই কি দেশের ফুটবল মুক্তির পথ? নাকি সাময়িক অক্সিজেন

প্রথম আলো

প্রকাশ: ১৫ জুন, ২০২৫

ভিনদেশ থেকে আসা বাংলাদেশের পাঁচ ফুটবলার (বাঁ থেকে) তারিক কাজী, জামাল ভূঁইয়া, ফাহামিদুল ইসলাম, হামজা চৌধুরী ও কাজেম শাহছবি: বাফুফে
ভিনদেশ থেকে আসা বাংলাদেশের পাঁচ ফুটবলার (বাঁ থেকে) তারিক কাজী, জামাল ভূঁইয়া, ফাহামিদুল ইসলাম, হামজা চৌধুরী ও কাজেম শাহছবি: বাফুফে

ঢাকার জাতীয় স্টেডিয়ামে ৫৫ মাস পর ফিরেছে বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দল। ঝলমলে গ্যালারিতে উড়েছে লাল-সবুজের ঢেউ, গর্জে উঠেছে হাজারো কণ্ঠস্বর। গতকাল সন্ধ্যায় হারিয়ে দেশের ফুটবলতীর্থে জাতীয় দলের প্রত্যাবর্তন যেন পরিণত হয়েছে এক উৎসবে।

এই জয়ের নায়ক ইংল্যান্ডে জন্ম ও বেড়ে ওঠা ফুটবলার হামজা চৌধুরী—ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে খেলার অভিজ্ঞতা রয়েছে যাঁর। বাংলাদেশের হয়ে নিজের দ্বিতীয় ম্যাচেই দুর্দান্ত এক গোল করে তিনি আনন্দের আলো ছড়িয়ে দিয়েছেন সমর্থকদের মধ্যে।

এই আলোয় যেন ফুটবলপাগল জাতি নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। এখন জাতীয় দলে একসঙ্গে ছয়জন প্রবাসী ফুটবলার—জামাল ভূঁইয়া, তারিক কাজী, কাজেম শাহ, হামজা চৌধুরী, ফাহামিদুল ইসলাম ও শমিত সোম।

অপেক্ষমাণ আছেন আরেক তরুণ । তালিকায় আছেন আরও কয়েকজন। অবস্থা এমন যে খুব শিগগির জাতীয় দলের ২৩ জনের স্কোয়াডের অর্ধেকই ভরে যেতে পারে প্রবাসীতে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁদের নিয়ে উচ্ছ্বাসের বন্যা বয়ে যাচ্ছে।

তবে এই আশাজাগানিয়া গল্পের আড়ালেও আছে একটি কঠিন বাস্তবতা। সেই বাস্তবতার নাম—ঘরোয়া ফুটবলের বিবর্ণ দশা। দেশের প্রিমিয়ার লিগে এমন অনেক দল খেলছে, যাদের খেলার মতো পর্যাপ্ত অবকাঠামো নেই। নেই নিজস্ব মাঠ, নেই সমর্থক, নেই পৃষ্ঠপোষকতা। বেশির ভাগ ফুটবলার নিয়মিত পারিশ্রমিক পান না, বারবার ধর্মঘটে যেতে হয় তাঁদের। ক্লাবগুলো দিশাহারা, নিচের দিকের লিগগুলো অনিয়মিত, ঢাকার ঘরোয়া ফুটবল কার্যত মৃত।

এ অব্যবস্থার মধ্যে শুধু প্রবাসী ফুটবলারদের আলোয় জাতীয় দলকে এগিয়ে নেওয়ার স্বপ্ন কতটা বাস্তবসম্মত? মাঝেমধ্যে ম্যাচ জিতে উল্লাসে ভাসে সবাই, কিন্তু কাঠামোগত ব্যর্থতা ঢেকে রাখা যায় না সেই উল্লাসে। ফুটবল এক দিনের খেলা নয়—এটা দীর্ঘমেয়াদি নির্মাণকাজ, যেখানে প্রয়োজন পরিকল্পনা, বিনিয়োগ, ধৈর্য এবং একটি সুদৃঢ় ভিত।

এখন হামজা চৌধুরীর মতো একজন দুর্দান্ত মিডফিল্ডার, যিনি শিলংয়ে ভারতের বিরুদ্ধে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করেছেন, দ্বিতীয় ম্যাচেই ঢাকায় গোল করে বুঝিয়ে দিলেন, তাঁর আগমন সৌভাগ্যের বার্তা বয়ে আনতে পারে। কিন্তু একজন হামজা দিয়ে একটা ভবিষ্যৎ গড়া যায় না, প্রয়োজন শত শত ঘরোয়া হামজা—তাঁদের খোঁজ কে রাখছে?

বাংলাদেশের কিশোরদের জন্য আজ কোনো কার্যকর লিগ নেই। কোচরা অবহেলিত, রেফারিরা বঞ্চিত, শুধু কি তা–ই? কদিন পরপর রেফারিরা পারিশ্রমিকর জন্য ধর্মঘটে যান। অথচ বাফুফে সব মনোযোগ জাতীয় দলকে ঘিরে। যেন ওপরের ঝলমলে একটি বাতি জ্বালিয়ে নিচের ভাঙা ঘরটাকে আড়াল করার চেষ্টা চলছে। এই বাস্তবতা অস্বীকার করলে চলবে না। বাংলাদেশের ক্লাব ফুটবলের বাস্তবতা ভয়াবহ।

গত বছর ৫ আগস্ট সরকার বদলের পর দুটি ক্লাব প্রিমিয়ার লিগ থেকে বিদায় নিয়েছে। বেশির ভাগ ক্লাবের নেই নিজস্ব মাঠ, নেই একাডেমি। যে কাঠামো থেকে জাতীয় দল উঠে আসার কথা, সেই কাঠামোই আজ ঝুরঝুরে। সুশৃঙ্খল ঘরোয়া কাঠামো ছাড়া ফুটবলের ভবিষ্যৎ নেই।

এখন যেসব ক্লাব প্রিমিয়ার লিগে খেলছে, তাদের অনেকেরই পেশাদার মানের ফুটবল উপস্থাপন করার সক্ষমতা নেই। দেশের প্রিমিয়ার লিগে খেলার জন্য যে প্রস্তুতি, অবকাঠামো ও সংস্থান দরকার, তার ছিটেফোঁটাও অনেক ক্লাবের নেই। এত দিন বলা হতো, তৃণমূল অবহেলিত। এখন প্রিমিয়ার লিগও অনেক জায়গায় অবহেলার শিকার।

ভুটানের অধিনায়ক লিমার ভাষ্যে ‘বাংলাদেশ এখন দক্ষিণ এশিয়ার সেরা দল’। হয়তো এই মন্তব্য শুনে আপ্লুত হন বাংলাদেশের ফুটবল সমর্থকেরা। কিন্তু বাস্তবতা কি সত্যিই এমন? নাকি এটা একটু ভালো খেলার আলোয় তৈরি হওয়া এক ক্ষণিকের মায়া?

হামজাদের মতো ফুটবলারদের অর্জন নিঃসন্দেহে গর্বের, কিন্তু তাঁদের আলোতেই বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবলের বিবর্ণতা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ইংল্যান্ড, ডেনমার্ক, কানাডা, ইতালিতে বড় হয়ে ওঠা প্রতিভারা দলকে শক্তি দিচ্ছেন, কিন্তু পায়ের তলায় মাটি কি তৈরি করতে পারছে বাংলাদেশের ফুটবল?

একটি ফুটবল দল যেমন শুধু তার ফরোয়ার্ডের ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না, তেমনি একটি দেশের ফুটবল কাঠামোও দাঁড়াতে পারে না শুধু প্রবাসীদের কাঁধে ভর করে। দরকার শক্ত ভিত—যেখানে থাকবে কিশোর লিগ, অঞ্চলভিত্তিক প্রতিযোগিতা, উন্নত কোচিং, ভালো রেফারিং, রেফারিদের জন্য ভালো প্রণোদনা ও ক্লাব সংস্কৃতির নবজাগরণ। এই ভিত গড়ে তুলতে হবে দেশের ভেতর থেকেই।

প্রবাসীরা বাংলাদেশের ফুটবলে গর্ব—তাঁরা সম্মানের প্রতীকও। কিন্তু জাতীয় ফুটবলের টেকসই ভবিষ্যৎ গড়ে উঠবে দেশের মাটিতে, দেশের মানুষের হাতে। আলো চাইলে দরকার শক্ত ভিত। দরকার সত্যিকারের পরিবর্তনের সম্মিলিত সদিচ্ছা।

জাতীয় দলে একটি বা দুটি ম্যাচ জয় মানেই জাতীয় ফুটবলের পুনর্জাগরণ নয়। সেটি শুরু হবে নিচ থেকে—একটি শিশু যখন প্রতিদিন মাঠে খেলবে, একজন কোচ যখন সম্মান নিয়ে কাজ করবে, একদল ক্লাব কর্মকর্তার যখন থাকবে স্বচ্ছতা ও পেশাদারিত্ব। ফুটবল তখনই সত্যিকার অর্থে আলোকিত হবে।

বাংলাদেশের রেফারিরা সময়মতো পারিশ্রমিক পান না। প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হন। তাঁদের পেশাদার মর্যাদা নেই। ম্যাচ পরিচালনার মতো আধুনিক অবকাঠামো নেই। এ–ই যদি হয় অবস্থা, তাহলে মাঠের ন্যায্যতা কোথা থেকে আসবে?

জাতীয় দলে হামজারা গোল করলে হাততালির বন্যা বয়ে যায়, কিন্তু যদি ঢাকার কোনো ক্লাব দুই তিন মাস ধরে খেলোয়াড়দের বেতন না দেয়—তখন সেই খোঁজ কেউ রাখে? প্রবাসীদের আলোয় মোহিত হয়ে যদি সবাই অন্ধ হয়ে যায়, যদি শুধু জাতীয় দলের দিকে তাকিয়ে থাকে, তবে দেশের ফুটবলের শরীরে জমে থাকা অজস্র ফোসকা, ক্ষত আর ভাঙন চোখে পড়বে না। ফুটবল শুধু জাতীয় দলে সীমাবদ্ধ নয়, তার মূল প্রাণশক্তি থাকে ঘরোয়া লিগ, ক্লাব ও প্রান্তিক কাঠামোয়।

ফুটবলের ভিত গড়ার এই দায়িত্ব শুধু ফুটবলারদের নয়, বাফুফে, রাষ্ট্রসহ সবার। তা না হলে ঝাড়বাতির নিচের অন্ধকারই থেকে যাবে বাংলাদেশের ফুটবলের আসল পরিচয়। ফুটবলের আলো প্রবাস থেকে আসুক, কিন্তু ভিত্তি থাকুক এ দেশের মাটিতেই।

আজকের বাংলাদেশ ফুটবলে জাতীয় দল যেন এক রাজহাঁস। আমরা তার দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হচ্ছি। কিন্তু যে পুকুরে সে ভাসে—অর্থাৎ ঘরোয়া লিগ, ক্লাব, মাঠ, প্রশাসন—সেই পুকুরে পানি নেই। রাজহাঁস একদিন শুকিয়ে মরবে, যদি পুকুরের পানি ফিরিয়ে না আনা যায়।

ফুটবল ফেডারেশন যেন এক কল্পনার স্বর্গে বাস করছে। জাতীয় দলের ম্যাচ মানেই ফ্ল্যাশ, গান, উৎসব, চাকচিক্য, খেলোয়াড়দের ফুলেল সংবর্ধনা—সবকিছুতেই আছে বাহ্যিক চমক। কিন্তু ভেতরের হাল?

জাতীয় দলে হামজা, জামাল, তারিকরা আলোর রেখা আনছেন; সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই আলো কি পৌঁছায় টংদোকানে চা বিক্রি করা সেই তরুণটির পায়ে, যে বিকেলে স্থানীয় মাঠে খেলে বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখে? ‘দেশে ফুটবল বাঁচে ক্লাবে’—এই সত্যকে ভুলে গেলে চলবে না। বাংলাদেশে ফুটবল ক্লাবকেন্দ্রিক ছিল, আছে, থাকবেও। কিন্তু আজকে প্রিমিয়ার লিগের ক্লাবগুলোর অভ্যন্তরীণ হালচাল শুনলে ফুটবলের ভেতরের দৈন্য বড্ড বেশি চোখে পড়ে।

ফুটবল বাঁচাতে হলে মাঠে ফিরতে হবে দেশকে। এখন সময়, প্রবাসী-দেশি নয়, দেশি-প্রবাসী মিলিয়ে একটি টেকসই পথনকশা তৈরি করার। ঢাকাসহ দেশের সব জেলায় নিয়মিত লিগ চালু করতে হবে। বাফুফের দায়িত্বশীলতা নিশ্চিত করা জরুরি। জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে মাঠ সংস্কার ও কোচিং অবকাঠামো উন্নয়ন জরুরি। ক্লাবগুলোর জন্য পেশাদার লাইসেন্সিং আরও কঠোর করতে হবে। রেফারি, কোচ, সংগঠকদের জন্য যথাযথ সম্মান ও পারিশ্রমিক নিশ্চিত করা সময়ের দাবি। ফুটবলের গ্ল্যামারের বাইরের অন্ধকারেও চোখ ফেলতে হবে।

আলো না ছড়ালে আঁধার ঘনীভূত হয়। এই মুহূর্তে দেশের ঘরোয়া ফুটবলের দশা এমন। অনেক জেলার ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনই নিষ্ক্রিয়। মাঠ নেই, খেলা নেই, তদারকি নেই। লিগ মানে শুধু নামমাত্র আয়োজন, কোনো প্রতিযোগিতা বা মান নেই। যুব লিগ, অনূর্ধ্ব-১৪ বা ১৬ লিগ পুরোপুরি অনিয়মিত।

বাংলাদেশ ফুটবলের সম্ভাবনা বিশাল। হামজারা সেই সম্ভাবনার ঝলক দেখিয়েছেন মাত্র। কিন্তু যদি ভিত শক্ত না হয়, তাহলে এই আলোও হবে সাময়িক, আরেকটি ভেসে যাওয়া বিস্ময়।

আপনারা জানেন কি, দেশের ফুটবল রেফারিরা এখন নিয়মিত ধর্মঘট করছেন? সময়মতো পারিশ্রমিক পান না। প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হন। তাঁদের পেশাদার মর্যাদা নেই। ম্যাচ পরিচালনার মতো আধুনিক অবকাঠামো নেই। এ–ই যদি হয় অবস্থা, তাহলে মাঠের ন্যায্যতা কোথা থেকে আসবে?

বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন যেন এক আত্মসন্তুষ্ট রাজ্য! বড় ম্যাচ এলেই পোস্টার, ব্যানার, সামাজিক প্রচারণা। কিন্তু মাঠের নিচে ফুটবলের শরীরটা ক্রমেই নিস্তেজ।
এর মধ্যেই যখন প্রবাসীদের জয়জয়কার হয়, তখন ভয় লাগে—আমরা কি এক মরীচিকার পেছনে ছুটছি না? যাতে জাতীয় দলের সাময়িক উন্মাদনার পেছনে লুকানো ঘরোয়া ফুটবলের দুঃসহ সংকট সামনে আসে।

বাংলাদেশ ফুটবলের সম্ভাবনা বিশাল। হামজারা সেই সম্ভাবনার ঝলক দেখিয়েছেন মাত্র। কিন্তু যদি ভিত শক্ত না হয়, তাহলে এই আলোও হবে সাময়িক, আরেকটি ভেসে যাওয়া বিস্ময়। ফুটবলের ভবিষ্যৎ গড়ে উঠবে মাঠে, প্রক্রিয়ায়, কাঠামোতে—স্ট্যাটাস আর সেলফিতে নয়।

এই সত্য যত দ্রুত বুঝি, ততই ভালো।

Lading . . .