প্রকাশ: ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

এক সফরে এতকিছুর অভিজ্ঞতা আগে আর হয়নি কখনও! শান্ত নেপালের অশান্ত হয়ে ওঠা, তারুণ্যের শক্তি স্বচক্ষে আরও একবার দেখার রোমাঞ্চ, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, জ্বালাও-পোড়াওয়ের ভয়, শঙ্কা, দেশে ফেরা নিয়ে অনিশ্চয়তা, বিমানবাহিনীর কার্গো বিমানে চেপে জামাল-মিতুলদের সাথে দেশের মাটির স্পর্শ অনুভব করা -আরও কত শত ঘটনার সাক্ষী হলাম ৪ থেকে ১১ সেপ্টেম্বর-এই আট দিনে!
নেপাল ও বাংলাদেশের মধ্যকার দুই প্রীতি ম্যাচ কাভার করতে কাঠমাণ্ডুতে যাওয়া। আগেও চারবার হিমালয়ের দেশটিতে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে, উইমেন্স সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ, এসএ গেমস কাভার করার সুবাদে। মাঠের সাফল্য-ব্যর্থতার ফিরিস্তি লেখা হয়েছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের পাঠকদের জন্য। কিন্তু এবার? লেখাগুলো তো বটেই, দেখা মুহূর্তগুলোও একেবারে আলাদা। যেখানে মাঠের বাইরের ঘটনাই বেশি। ক্রীড়া সাংবাদিকতা থেকে আমরা সবাই যেন হয়ে গেলাম ‘আন্দোলন, দাঙ্গা, বিক্ষোভ, সরকারের পতন’-এসবের প্রতিবেদন লিখিয়ে! ফিরে দেখা সেই আট দিনের যত স্মৃতি পাঠকদের সাথে ভাগাভাগি করে নিতেই এই আয়োজন।

৪ সেপ্টেম্বর- শান্ত নেপাল
প্রীতি ম্যাচ খেলতে কাঠমাণ্ডুতে বাংলাদেশ দল পা রেখেছিল ৩ সেপ্টেম্বর। একদিন পর গেলাম। বাংলাদেশ বিমানে চেপে আকাশ থেকে হিমালয়ের অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করলাম বরাবরের মতো। ত্রিভুবনের রানওয়েতে বিমান অবতরণ করতেই অনুভব করলাম অন্যরকম প্রশান্তি। এ অনুভূতি কেবল আমার একার নয়, সঙ্গী যাত্রীদেরও।
ঢাকায় একটি গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা ইকরামুল হোসেন প্রথমবারের মতো নেপাল ভ্রমণে যাচ্ছিলেন, বিমানেও তার প্রথম ওঠা, ত্রিভুবন এয়ারপোর্ট পৃথিবীর বিপজ্জনক বিমানবন্দরের একটি বলে, অজানা ভয় জেঁকে ধরেছিল এই ভদ্রলোককে। সারাপথ তার সাথে গল্প করলাম তাকে একটু স্বস্তি দিতে। বিমান অবতরণ করার পর ইমিগ্রেশনের আনুষ্ঠানিকতা সেরে সতীর্থদের সাথে তিনি ছুটলেন প্রথম বিদেশ ভ্রমণের রোমাঞ্চ নিয়ে। আমি ছুটলাম আর্মি হেডকোয়ার্টারের দিকে, সেখানে অনুশীলন করছিল বাংলাদেশ দল। প্রস্তুতি নিয়ে কিছু প্রতিবেদন লিখে উঠলাম হোটেলে।
এ দিনের দেখায় নেপাল শান্ত। সন্ধ্যার পর কাঠমাণ্ডুর থামেল যথারীতি আলো ঝলমলে। রাস্তায় নানা দেশের পর্যটকদের আনাগোনা। বার-পাব, হোটেল সবখানে উচ্চস্বরে বাজছে গান। ইন্দ্রযাত্রা ও দিওয়ালির উৎসবের আমেজ চারদিকে। নানা পসরা সাজিয়ে দোকানিরা কাটাচ্ছেন ব্যস্ত সময়। মোড়ে মোড়ে মন্দিরে জ্বলছে প্রদীপ। সুগন্ধী ধোঁয়া উড়ছে প্রদীপ থেকে।
শান্ত নেপালের অশান্ত হয়ে ওঠার কোনো আভাস নেই!
৫ সেপ্টেম্বর-ব্যস্ত সময়
সকালে ঘুম থেকে উঠে হোটেলের জানালা দিয়েই উপভোগ করলাম পাহাড়ের সৌন্দর্য। তুলতুলে মেঘ উড়ে-ঘুরে বেড়াচ্ছে পাহাড়ের চারপাশে। পাহাড়ের হাতছানি এড়িয়ে নাস্তা সেরে টিম হোটেলের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করলাম। থামেল থেকে প্রায় ছয় কিলোমিটার দূরে ক্রাউন ইম্পেরিয়াল হোটেলে ছিল নেপাল ও বাংলাদেশ দলের সংবাদ সম্মেলন। ২০২৪ সালে উইমেন’স সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ কাভার করার সময় কাঠমাণ্ডুতে এত যানজট ছিল না, এবার যানজট একটু বেশি। পৌঁছাতে তাই একটু সময় লাগল।
দুই দলের সংবাদ সম্মেলন শেষ করে হোটেলে ফিরে যথারীতি লিখতে বসা। সেখানে নেপাল কোচ ম্যাট রসের বাংলাদেশকে হারাতে মরিয়া থাকার কথা, অধিনায়ক কিরণ চেমজংয়ের জামালদেরকে সমীহ করার বার্তা, বাংলাদেশ কোচ হাভিয়ের কাবরেরা ও অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়ার জয়ের দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষা-সব কথার রেকর্ড নিয়ে ছুটতে হলো দশরথ স্টেডিয়ামের দিকে। সেখানে বাংলাদেশ দলের অনুশীলন দেখে হোটেলে ফিরে প্রতিবেদন লেখায় ডুব দিতে হলো। কাজ শেষ করে রাতে যখন খেতে নামছি, হোটেলের নিচেই এক নেপালির সাথে দেখা এবং তখন থেকেই শুরু ভিন্ন এক ঘটনাপ্রবাহ!
ইত্তেফাকের সহকর্মী কামরান আহমেদের সাথে বাংলায় কথা বলছি শুনে ছেলেটি এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমরা কি বাংলাদেশি?” ‘হ্যাঁ’ উত্তর দিতে সে বলল, “তোমাদের ৫ অগাস্টের মতো আমরা ৮ সেপ্টেম্বর করব।” এতটুকু বলেই সে মুহূর্তেই হাওয়া হয়ে গেল! ছেলেটি ছাত্রই হবে। তবে একজনের কাছ থেকে এমন কথা শুনে সিদ্ধান্তে আসা কঠিন। তাই আমরা কেউ বিষয়টি পাত্তা দিলাম না।
তবে এদিন নেপাল সরকার সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম হোয়াটসঅ্যাপ, ফেইসবুক, ইনস্টাগ্রাম বন্ধ করে দেওয়ায় আঁচ করা যাচ্ছিল, নেপাল ভেতরে ভেতরে ফুঁসছে। স্থানীয় গণমাধ্যমের খবরে গুমোট পরিস্থিতির কিছুটা প্রকাশও পাচ্ছিল। তবে তখনও আতঙ্কিত হওয়ার মতো কিছুর দেখা মেলেনি।
বাংলাদেশ থেকে যাওয়া গণমাধ্যমকর্মীরাও ব্যস্ত সময় কাটান ম্যাচ প্রিভিউ, বিশেষ প্রতিবেদন লিখে।

৬ সেপ্টেম্বর- ড্র ম্যাচের রোমাঞ্চ
২০২২ সালে সবশেষ খেলা প্রীতি ম্যাচে নেপালের বিপক্ষে ৩-১ গোলে হেরেছিল বাংলাদেশ। সেই অতীতের চোখ রাঙানি এবার না জানি ফিরে আসে, সেই ভাবনাই মূলত ছিল বেশি। দশরথ স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা পৌনে ৬টায় শুরু হলো ম্যাচ। নেপালি দর্শকে গ্যালারি ভরল না। খেলাও হলো ম্যাড়মেড়ে। তবে গোলশুন্য ড্রয়ে নেপালকে রুখে দেওয়ার আনন্দ অন্তত এবার সঙ্গী হলো কাবরেরার, তিন বছর আগের সেই হার নিয়ে তিনি ভীষণ হতাশ ছিলেন।
ম্যাচ শেষে দশরথ স্টেডিয়ামের পিচের মান, লম্বা ঘাস-এ সব নিয়ে দুই কোচই জানালেন উষ্মা, ক্ষোভ। জমজমাট খেলা না হওয়ার কারণ হিসেবে দুই পক্ষই মাঠকে অভিযুক্ত করলেন। কিছুদিন আগে এএফসি এই মাঠকে কেন নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, তার প্রমাণ মিলল স্বাগতিক, অতিথি দুই দলের কোচ ও খেলোয়াড়দের কথায়। সেগুলো পাঠকদের জানাতেই ল্যাপটপের কিবোর্ডে ব্যস্ত সময় কাটল।
৭ সেপ্টেম্বর-বিশ্রামে জামালরা
প্রথম প্রীতি ম্যাচের ধকল কাটিয়ে উঠতে খেলোয়াড়দের রিকভারির জন্য বিশ্রাম দিলেন কাবরেরা। কিন্তু গণমাধ্যমকর্মীদের তো আর বিশ্রামের ফুসরত নেই। তাই সকালেই টিম হোটেলে যাওয়া। রহমত মিয়া ও আমের খান কথা বললেন রিকভারি, জিমনেশিয়ামে খেলোয়াড়দের সময় কাটানো, ড্র ম্যাচের তৃপ্তি নিয়ে।
দেখা গেল, দুপুরের দিকে নেপাল দল ছুটছে স্টেডিয়ামের উদ্দেশে প্রস্তুতি নিতে। এসব গতানুগতিক বিষয় নিয়েই লিখতে হলো। বাড়তি কিছু লেখার সুযোগ ছিল না বাংলাদেশ কোচ বরাবরের মতো খেলোয়াড়দের কড়া পাহারায় রাখায়। সুমন-রাকিবরা তাই ছিলেন গণমাধ্যমকর্মীদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।
এদিন সন্ধ্যায় অবশ্য ঘরোয়া আলাপে স্থানীয়রা দিতে থাকে বড় কিছু ঘটার আভাস। সরকারের ‘দূর্নীতি’, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ করে দেওয়াসহ নানা বিষয়ে জেন জি’রা ক্ষিপ্ত, সুপ্ত দাবানল যে কোনো মুহূর্তে তেড়েফুঁড়ে সর্বগ্রাসী হয়ে উঠতে পারে, তার ইঙ্গিত মিলে।
৮ সেপ্টেম্বর-দুপুর থেকে অস্থিরতার শুরু
টিম হোটেলে বেলা ১২টায় ছিল সংবাদ সম্মেলন। সকালে সেখানে গিয়ে সংবাদ সম্মেলন থেকে দুই পক্ষের কথাগুলো কুড়িয়ে হোটেলে ফেরার পর থেকে অস্থির হতে থাকে নেপাল। নাম না জানা সেই ছেলেটির ‘তোমাদের ৫ অগাস্টের মতো আমরা ৮ সেপ্টেম্বর করব’ কথাটি কানে বাজতে থাকে। একের পর এক খবর আসতে থাকে স্থানীয় গণমাধ্যমে। জেন জি’রা সরকারের বিরুদ্ধে দলে দলে নেমে এসেছে রাস্তায়। বানেশ্বরের পার্লামেন্ট ভবন, প্রশাসনিক ভবন, পুলিশের হেড কোয়ার্টারে হানা দিয়েছে তারা। ভাঙচুর চালাচ্ছে। বিক্ষোভ চলছে নেপালজুড়ে। পুলিশ গুলি ছুঁড়ছে আন্দোলনকারীদের উপর।
দুপুরেই নেপাল দল অনুশীলন করতে দশরথ স্টেডিয়ামের দিকে রওনা দিয়েছিল। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে মাঝপথ থেকে টিম হোটেলে ফিরে যায় তারা। বাংলাদেশ দল অনুশীলনের জন্য বেরই হতে পারেনি। যেন আচমকা বিস্ফোরণে এলোমেলো সবকিছু।
বিকালের দিকে আসতে থাকে সহিংসতা আর প্রাণহানির খবর। কাঠমাণ্ডু পোস্ট সন্ধ্যায় জানায়, পুলিশের গুলিতে ১৯ জন প্রাণ হারিয়েছে। হাসপাতালে আহতদের ভীড়, রাস্তায়-রাস্তায় সংঘর্ষ, মিছিল, জ্বালাও-পোড়াও, টিয়ারশেল, ইট-পাথর ছোঁড়াছুঁড়ি, ব্যারিকড ভাঙা, সবমিলিয়ে নেপালের অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠার খবর ও ছবি প্রকাশিত হতে থাকে নানা মাধ্যমে।
থামেল তখনও বিস্ময়করভাবে শান্ত। এই এলাকা বিদেশি পর্যটকদের আনাগোনা বেশি বলে হয়ত বিক্ষোভকারীরা হানা দেয়নি। রাতের দিকে খবর এলো অল নেপাল ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (আনফা) ৯ সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় প্রীতি ম্যাচটি স্থগিত করে দিয়েছে। অজানা শঙ্কা নিয়ে থামেলের মুসলিম চকে একত্রিত হলাম বাংলাদেশ থেকে এই সিরিজ কাভার করতে যাওয়া গণমাধ্যমকর্মীরা। ‘নেপাল ক্রাইসিস’ নামে গ্রুপ খোলা হলো।
দেশ রুপান্তরের সুদীপ্ত আনন্দ, যুগান্তরের ওমর ফারুক রুবেল, মানবজমিনের সামন হোসেন, টিস্পোর্টসের মমিন রোহন, স্টার নিউজের শেখ আশিক, ফ্রিল্যান্সার মজিবুর রহমান, ডেইলি স্টারের আব্দুল্লাহ আল মেহেদী, বিডিস্পোর্টসটাইমের মোহাম্মদ রাজন, আমাদের সময়ের গাজী ফয়সাল তনু, একাত্তর টিভির হাসান সজিবসহ বাকিরাও যোগ হলেন গ্রুপে, যাতে এই দুঃসময়ে প্রয়োজনে এগিয়ে আসা যায়। নেপাল স্পোর্টস জার্নালিস্ট ফোরামের (এনএসজেএফ) সহ-সভাপতি প্রজ্জ্বল ওলি নিয়মিত যোগাযোগ রাখছিলেন, এই সংকটময় সময়েও তিনি ঝুঁকি নিয়ে বিকালের দিকে হঠাৎ রুমে এসে হাজির, ঠিকঠাক আছি কিনা, স্বচক্ষে দেখতে!
আন্দোলন চলছিল থামেল থেকে বেশ দূরে, এ নিয়ে বিশেষ কিছু লেখার, লাইভ দেওয়ার সুযোগ তাই একেবারেই ছিল না। জামালদের টিম হোটেলে ‘বন্দী’ থাকার খবর লিখেই পার করতে হলো দিনটি।
৯ সেপ্টেম্বর- দুয়ারে বিক্ষোভ
আগের দিনের শঙ্কা ভয়ে রূপ নেওয়ার শুরু সকাল থেকে। হোটেলের ছাদে উঠে দেখা গেল কাঠমাণ্ডুর বিভিন্ন স্থানে কালো ধোঁয়া উড়তে। বুঝতে বাকি রইল না জ্বালাও-পোড়াও শুরু হয়ে গেছে। শ্লোগান-মিছিলের আওয়াজ কানে আসতে বাইরে বের হলাম ক্যামেরা নিয়ে।
মুসলিম চকের ৫০-৬০ গজের মধ্যেই মোড়টি, তারই এক কোণে থানা। গিয়ে দেখি, হাজারো মানুষের ভিড়। মোড়ে টায়ার জ্বালিয়ে রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। থানার মধ্যে পুলিশ জুবুথুবু অবস্থায়। তাদের দিকে ক্রমাগত ইট-পাটকেল ছুঁড়ে চলেছে বিক্ষোভকারীরা। থানার জানালার কাচঁগুলো ভেঙে চৌচির। নেপালি ভাষায় পুলিশের দিকে ক্ষোভ উগরে দিচ্ছে আন্দোলনকারীরা। মাঝেমধ্যে পাঁচ-দশটির মোটরবাইকের দল ছুটছে সরকারবিরোধী শ্লোগান দিতে দিতে। নিরাপদ দুরত্বে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে থাকি, ভিডিও করতে থাকি; অফিসের প্রয়োজন মেটাতে। আন্দোলনের উত্তাপ বুঝতে বাকি রইল না।
দুপুরের পর আবারও যাই সেই মোড়ে। এবারের দৃশ্য আরও ভয় জাগানিয়া। থানার সামনে থাকা পুলিশের গাড়িগুলো পুড়িয়ে স্তুপ করা হয়েছে। সেখানে আর কোনো পুলিশের দেখা নেই। কোথাও কোথাও রক্তের ছোপ-ছোপ দাগ। শুনেছি, তাদের বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিয়েছে বিক্ষোভকারীরা। রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ইট-পাথর, বোতল। তখনও কিছু গাড়িতে, টায়ারে আগুন জ্বলছে। জ্বলন্ত গাড়িতে রড, লাঠি দিয়ে স্বজোরে আঘাত করে ক্ষোভ ঢালছে ক্ষুব্ধ মানুষগুলো।
বাংলাদেশি সাংবাদিক শুনে বিক্ষোভকারীরা খুশি হয়। একজন বলেও দেয়, “তোমাদের দেশের মতো আমরাও সরকার বদলে দিয়েছি।” এরই মধ্যে খবর এসে যায় নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি ওলি শর্মা পদত্যাগ করেছেন। তাতে কিছুটা আশা জাগে, দ্রুতই বোধহয় শান্ত হয়ে উঠবে নেপাল, কিন্তু না। পথে-ঘাটে মন্ত্রী, পুলিশদের টেনে-হিঁচড়ে এনে পেটানোর ছবিতে সয়লাব হয়ে যায় সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম। মনের গহীন দানা বাধতে থাকে নতুন ভয়।
খবর আসে, বাংলাদেশের টিম হোটেলে হানা দিয়েছে বিক্ষোভকারীরা। ভাগ্য ভালো যে, সেখানে কোনো সরকারঘনিষ্ট বা ভিআইপিদের কেউ ছিল না সেখানে। এটা নিশ্চিত হওয়ার পর আন্দোলনকারীরা হোটেল ছাড়ে। তবে হোটেলের পাশে এক রাজনীতিকের বাড়ি, হোটেল থেকে দাউ দাউ করে জ্বলতে দেখে ভীত হয়ে পড়েন জামাল-সাদরাও। দ্বিতীয় ম্যাচ স্থগিত হয়ে যাওয়ায় এ দিনই দেশে ফেরার কথা ছিল দলের। কিন্তু এরই মধ্যে ত্রিভুবন বিমানবন্দরের দখল নেয় আন্দোলনকারীরা, যাতে দুর্নীতিগ্রস্থ কেউ পালাতে না পারে। তাতে করে সব ফ্লাইট বাতিল হয়ে যায়। কাজেম-তারিকদের দেশে ফেরার পথটাও হয়ে যায় রুদ্ধ। রাজ্যের আতংক তখন ভর করে চারদিকে।
নেপালের বাংলাদেশ দূতাবাস, পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়, সেনা ও বিমানবাহিনী, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের কর্মকর্তাদের ছোটাছুটি শুরু হয়ে যায় কীভাবে দলকে দেশে ফিরিয়ে আনা হবে, তা ঠাহর করতে। দূতাবাস থেকে নির্দেশনা জারি করা হয়, নেপালে থাকা বাংলাদেশি কেউ যেন বাইরে না বের হয়। ‘মবের’ ভয়ে হোটেল থেকেও দেওয়া হয় একই বার্তা। খেলোয়াড়দের মতো গণমাধ্যমকর্মীরাও কার্যত বন্দী হয়ে পড়েন হোটেলে। রাতে খাবারের সন্ধানে নেমে থামেলের শ্মশানের মতো সুনসান নিস্তব্ধ রাস্তায় হাঁটতেও শিউরে ওঠে গা। এই এলাকাটি যে এমন কোলাহলহীন, জনশূন্য দেখা হয়নি অতীতে কখনই। ফোনের যোগাযোগ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের একমাত্র পথ হয়ে ওঠে।
১০ সেপ্টেম্বর-অনিশ্চয়তার ভরা সময়
মোবাইল নেটওয়ার্ক, হোয়াটসঅ্যাপ, ফেইসবুকে যোগাযোগ রাখার পথটা খোলা থাকায় বাঁধে আরেক বিপত্তি! ফোন, মিসড-কলে ভরে যায় খেলোয়াড়, গণমাধ্যমকর্মীদের কললিস্ট। পরিবার-পরিজন, বন্ধু, শুভাকাঙ্ক্ষী, সহকর্মীদের শঙ্কামিশ্রিত হাজারো প্রশ্ন-কেমন আছো?, দেশে কবে ফিরবে?, নেপালের অবস্থা এখন কেমন?’। ‘ভালো আছি’, ‘দ্রুতই ফিরব’- এগুলো বলেই শান্ত রাখতে হয় তাদের। চারদিকের নাজুক পরিস্থিতি, মানসিক টানাপোড়েন থেকে মুক্ত হতে ফুটবলাররা টিম হোটেলের ফিটনেস সেন্টার ঘাম ঝরান।
টিম ম্যানেজার আমের খান, মিডিয়া ম্যানেজার সাদমান সাকিব, বাফুফে সভাপতি তাবিথ আউয়াল, সাধারণ সম্পাদক ইমরান তুষার, বাংলাদেশ দূতাবাসের হাইকমিশনার শফিকুর রহমান, কাউন্সিলর (পলিটিক্যাল) শোয়েব মাহমুদ ও ফার্স্ট সেক্রেটারি হুমায়ুন কবির নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন সবার সাথে। বিমানবাহিনীর বিশেষ ফ্লাইট বাংলাদেশের দল ও সাংবাদিকদের নিতে আসবে-এমন উদ্যোগের খবর আশা জাগায় সবার মনে। তবে আতঙ্ক তখনও কাটেনি পুরোপুরি।
এরই মধ্যে সেনাবাহিনী নেমে আসে নেপালের রাস্তায়। কারফিউ জারি থাকায় দোকানপাট সব বন্ধ হয়ে যায়। জ্বালাও-পোড়াওয়ের কারণে কিছু জায়গা হয়ে পড়ে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন। এর মধ্যেও অলিগলিতে মাঝেমধ্যে মিছিলের দেখা মেলে। চারদিকে তখন থমথমে পরিস্থিতি।
রাতে আসে সুখবর। দূতাবাস থেকে নিশ্চিত করা হয়, বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর বিশেষ ফ্লাইট বৃহস্পতিবার সকালে ত্রিভুবন এয়ারপোর্টে আসবে সবাইকে নিতে। কিন্তু এই রাত যেন পার হতে চায় না! এত দীর্ঘ! নির্ঘুম রাত কাটে আমাদের।

১১ সেপ্টেম্বর-স্বস্তির ফেরা
বৃষ্টিস্নাত সকাল। কালো মেঘে ছেঁয়ে আছে আকাশ। আটটার দিকে থামেলে তিনটি গাড়ি নিয়ে হাজির দূতাবাসের কাউন্সিলর (পলিটিক্যাল) শোয়েব মাহমুদ। গণমাধ্যমকর্মীরা তার সাথে রওনা হলেন বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে। ১০টার দিকে ত্রিভুবন বিমানবন্দরে এলো টিম বাস। এয়ারপোর্টের বাইরে বিদেশি অনেককে দেখা গেল।
বিশেষ ব্যবস্থায় দ্রুত ইমিগ্রেশন শেষ করে খেলোয়াড়, গণমাধ্যমকর্মী সবাই অপেক্ষা করতে লাগলেন লাউঞ্জে। তখনও বিশেষ বিমান এসে পৌঁছায়নি। উদ্বেগ- উৎকণ্ঠাও তাই কাটেনি। লাউঞ্জেই খাওয়া-দাওয়া সেরে নিতে হলো সবাইকে। দূতাবাসের কর্মকর্তাদের ছোটাছুটি তখনও চলছে। এরপর সবুজ সংকেত মিলতে সম্পন্ন হলো ফাইনাল চেকিং।
বিমানবাহিনীর ঢাউস কার্গো বিমানের দেখা মিলল রানওয়েতে। কোচ হাভিয়ের কাবরেরাও বিমানের ছবি তুললেন মোবাইলে। এতক্ষণের শঙ্কা, অনিশ্চয়তায় অপেক্ষার ক্ষণ গুণতে গুণতে ক্লান্ত, আশাহীন হয়ে পড়া মুখগুলোয় একটু একটু করে ফুটতে শুরু করল হাসি। এলো বিমানে ওঠার নির্দেশনা। বিমানের কাছাকাছি পৌঁছে সবার বুক থেকে এতক্ষণ জমে থাকা পাথরটা যেন সরে গেল নিমিষেই। সেলফি তুলতে, স্মরণীয় সফর ফ্রেমবন্দী করে রাখতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন সবাই। বিমানের দায়িত্বশীলরা তাগাদা দিতে লাগলেন, দ্রুত উঠতে। কোচ, খেলোয়াড়দের পর আমরাও উঠে পড়লাম। ভেতরে গিয়ে সবাই অবাক। বিস্মিত। এমন বিমানে যে ভ্রমণ করার অভিজ্ঞতা আমাদের সবারই প্রথম!
বাণিজ্যিক ফ্লাইটের মতো সিট নয়। কোনমতো চার সারিতে সিট বসানো হয়েছে। মাঝে শক্ত ফিতা দিয়ে জালের মতো রাখা, যাতে আঁকড়ে ধরা যায় প্রয়োজনে। এসি থাকলেও ভেতরটা বেশ গরম। কিন্তু এসব তখন কে ভাবে? স্থানীয় সময় ২টা ৫৫ মিনিটে উড়াল দিল বিমানটি। স্বস্তির শ্বাসে মুখরিত হয়ে উঠল কার্গো বিমানের ভেতরটা। কাঠমাণ্ডুর আকাশ তখন বেশ পরিষ্কার হয়ে গেছে। চারদিক রোদেলা।
জামাল-ফাহিম-হৃদয়রা উড়ানে চেপে লুডু খেলায় মজলেন। কেউ ঘুমালেন। কেউ খোশ-গল্পে মাতিয়ে রাখলেন চারপাশ। ভাবুক চিত্তে এককোণের সিটে বসে সারাক্ষণই কী যেন ভাবতে থাকলেন কাবরেরা। তখনও গণমাধ্যমকর্মীরা পেশার প্রয়োজনে ব্যস্ত ছবি তুলতে, ভিডিও করতে, পাঠক-দর্শককে যে জানাতে হবে সফরের খুটিনাটি সবকিছু। বিমানে দেওয়া হলো কেক, খেজুর, চকলেট, আপেল ও পানি। তৃপ্তিভরে সবাই সেগুলো খেলেন। ঢাকায় পা রাখার ক্ষণ গোনাও চলতে থাকল মনে মনে।
বাংলাদেশ সময় ৪টা ৩৬ থেকে ৪০ মিনিট। এই সময়ের মধ্যে কুর্মিটোলার এ কে খন্দকার এয়ার বেসের রানওয়ে স্পর্শ করল বিমানটি। শঙ্কার সাত সমুদ্র পেরিয়ে দেশের মাটিতে পা রাখার সীমাহীন আনন্দে, উচ্ছ্বাসে-উল্লাসে ফেটে পড়ল সবাই। কেউ আকাশের দিকে তাকিয়ে বুকভরে শ্বাস নিলেন। সৃষ্টিকর্তাকে কৃতজ্ঞতা জানালেন। কেউ ফোনে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন কদিন ধরে ভয়ঙ্কর আতংকে থাকা পরিবার-পরিজনের সাথে কথা বলতে।
এরপর বিশেষ আয়োজনে (সাধারণত ইমিগ্রেশন সারা হয় হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরে) ইমিগ্রেশনের আনুষ্ঠানিকতা সারা হলো। সেনা ও বিমানবাহিনীর পক্ষ থেকে মিষ্টিমুখ করানো হলো। গণমাধ্যমকর্মী, কোচ, ফুটবলার, বাফুফে কর্মকর্তারাও কৃতজ্ঞতার বাঁধনে বাঁধলেন পুরো প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত সরকার, বিভিন্ন বাহিনীসহ সবাইকে।
এলো ঘরে ফেরার পালা। বেস ক্যাম্প থেকে বনশ্রী ফেরার পথে বিপন্ন, বিধ্বস্ত নেপালের কথা ভেবে বিষন্ন হয় মনটা। ভাবছি, নেপালের এই ক্ষতও হয়ত সেরে উঠবে একদিন, আবারও হিমালয় কন্যার সাথে দেখা হবে। সেদিন উৎসবমুখর থাকবে থামেল। মাঠে ফুটবল থাকবে। মনের আনন্দে আমরা লিখব খেলার খবর। এবারের নেপাল সফরে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠায় কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত হয়ত তখন পুরোপুরি মনে থাকবে না। সময়ের স্রোতে হারিয়ে যাবে অনেক কিছু। কিন্তু একটা স্মৃতি অমলিন থাকবে চিরদিন-এ ফ্লাইট টু রিমেম্বার, ফ্লাইট নাম্বার-১৩০বি।।