Advertisement

ঐকমত্যে পাথর লুটে প্রশাসন পাহারাদার

কালবেলা

প্রকাশ: ১৮ আগস্ট, ২০২৫

ঐকমত্যে পাথর লুটে প্রশাসন পাহারাদার
ঐকমত্যে পাথর লুটে প্রশাসন পাহারাদার

স্বচ্ছ নীলাভ জল, নদীর তলদেশজুড়ে সাদা-ধূসর পাথরের বিছানা আর চারপাশের ঘন সবুজ পাহাড় মিলে মনোমুগ্ধকর দৃশ্যপট। সিলেটের সীমান্তবর্তী নদ ধলাইয়ের তীরে, মেঘালয়ের পাদদেশে প্রকৃতির এক অপার সৌন্দর্যের ঠিকানা সাদাপাথর শত শত বছর ধরে ভ্রমণপিপাসুদের কাছে অন্যতম আকর্ষণ। স্বচ্ছ জলে ডুবে থাকা সাদাপাথরের ঢিবি, যা সূর্যের আলোয় চিকচিক করে ওঠে, সঙ্গে পাহাড়ি পটভূমি তীব্রভাবে টানে ভ্রমণপিপাসুদের। এ ছাড়া এখানে অপূর্ব মিলন ঘটেছে নদী, পাহাড় আর পাথরের। দূরের মেঘে ঢাকা পাহাড় আর নদীর মাঝে ছড়িয়ে থাকা সাদা পাথর সৃষ্টি করে হৃদয়ে আলোড়ন তোলা দৃশ্য। তবে পাথর মাফিয়া দুর্বৃত্তদের আগ্রাসনে সম্প্রতি প্রকৃতির এই অপার সৌন্দর্য ম্লান হয়ে গেছে। সব রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতাদের ঐক্যবদ্ধ লুটপাটে ‘প্রকৃতির স্বর্গ’ রূপ নেয় ধু-ধু বালুচরে। এ ছাড়া বালু-পাথর লুটপাটে বিলীনের পথে জাফলং, বিছনাকান্দি, উৎমাছড়া পর্যটনকেন্দ্র এবং সুনামগঞ্জের নিলাদ্রী লেকের লাকমাছড়ার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও।

সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারি থেকে সম্প্রতি কোটি কোটি টাকার সাদা পাথর লুটপাটে নাম আসে বিএনপি, আওয়ামী লীগ (বর্তমানে কার্যক্রম নিষিদ্ধ), জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), ইসলামী আন্দোলন এবং গণঅধিকার পরিষদের নেতাকর্মীদের। পাথরের নৌকা থেকে চাঁদা নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে, পাশের বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) ক্যাম্প ও থানা পুলিশের বিরুদ্ধেও। ভাগবাটোয়ারার অংশবিশেষ যেত জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) অফিসেও। যে কারণে লুটপাটের পুরো সময় ধরে নীরব দর্শক ছিল স্থানীয় প্রশাসন। এ নিয়ে শুরু থেকেই প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছিল দৈনিক কালবেলা। তবে তাতে কেউ কর্ণপাত করেনি। যেন গভীর নিদ্রায় ছিল স্থানীয় প্রশাসন। অবশ্য গত ১২ আগস্ট রাতে কালবেলা অনলাইনে শত শত ট্রাকে করে পাথর সরিয়ে নেওয়ার এক্সক্লুসিভ ভিডিও প্রকাশের পর শেষমেশ টনক নড়ে প্রশাসনের। পরদিন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সিলেট সমন্বিত কার্যালয় অভিযান চালানোর পর সন্ধ্যায় জরুরি সভায় বসে জেলা প্রশাসন। রাত থেকেই পাথর উদ্ধারে শুরু হয় যৌথ বাহিনীর অভিযান। তবে তার আগেই সব শেষ, যা ক্ষতি হওয়ার তা হয়ে গেছে। স্থানীয়রা বলছেন, লুটপাট শেষে এখন আইওয়াশ (লোক দেখানো) অভিযান পরিচালনা করছে প্রশাসন।

জানা গেছে, প্রায় ৪ কোটি ঘনফুট পাথর লুট হলেও অভিযানে এখন পর্যন্ত মাত্র সাড়ে ৪ লাখ ঘনফুট উদ্ধার হয়েছে, যা প্রতিস্থাপনের কাজ চলছে।

সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় ভারত সীমান্তবর্তী মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থান সাদাপাথর পর্যটন কেন্দ্রের। এখানকার জলের স্বচ্ছতা, চারপাশের সবুজ পাহাড় এবং নদীর তলদেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা সাদা-ধূসর পাথরের জন্যই জায়গাটির নাম ‘সাদাপাথর’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। ইতিহাসবিদদের ভাষ্য অনুযায়ী, হাজার বছর আগে হিমালয় ও মেঘালয় মালভূমির ভূকম্পনজনিত পরিবর্তনে এই অঞ্চলের নদীপথ গড়ে ওঠে। পিয়াইন নদী, ডাউকি নদী ও ধলাই নদের মাধ্যমে এই এলাকায় পণ্য আসা-যাওয়া হতো। নদীর স্রোতের সঙ্গে ভেসে আসত পাথরও। ব্রিটিশ শাসনামলেও এই সাদাপাথর ও জাফলং ছিল ব্রিটিশ ভ্রমণপিপাসুদের ভ্রমণের প্রিয় জায়গা। তারা এটিকে ‘প্যারাডাইস অব ন্যাচার’ বলে অভিহিত করতেন। নদীর সাদা পাথর ও বালুকে কেন্দ্র করে চলে এখানকার মানুষের জীবন-জীবিকা। বেশিরভাগ মানুষ নদীর স্রোতে ভেসে আসা লাল বালু ও পাথর উত্তোলন করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করেন। কয়েক বছর আগেও জেলা প্রশাসন পাথরের কোয়ারি ইজারা দিত। তবে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদনের পর প্রকাশ্যে উত্তোলন বন্ধ হয়ে যায়। বিগত সময়ে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীদের ছত্রছায়ায় রাতের আঁধারে স্বল্প পরিসরে চলত পাথর উত্তোলন।

গত বছরের ৫ আগস্ট রাষ্ট্রক্ষমতার পটপরিবর্তনের পরপরই আওয়ামী লীগের পাশাপাশি লুটপাটে যোগ দেন সব রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতাকর্মীরা। তবে চলতি বছরের আগস্টে লুটপাট ভয়ানক আকার ধারণ করে। আগস্টের প্রথম দশ দিনেই সংঘবদ্ধ লুটপাটে সিলেটের সব পর্যটনকেন্দ্র প্রায় পাথরশূন্য হয়ে পড়ে। এ সময় গোয়াইনঘাটের জাফলং, বিছনাকান্দি; কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারি, শাহ আরেফিন টিলা, সংরক্ষিত বাঙ্কার (রেলওয়ের পুরোনো স্থাপনা) এলাকা ও উৎমাছড়া এবং কানাইঘাটের লোভাছড়ার পাথর লুটপাট করা হয়। এরপরও দুর্বৃত্তদের চোখ পড়ে সাদাপাথর পর্যটনকেন্দ্রে। পাশের বেশ কয়েকটি উপজেলা থেকে হাজার হাজার শ্রমিক ভাড়ায় এনে চলে লুটপাট। এমনও হয়েছে যে, কোনো পর্যটক পাথরের ওপর বসে থাকলেও তাকে সরিয়ে তা তুলে নেওয়া হয়েছে।

সংরক্ষিত বাঙ্কারের পাশে উঁচু একটি জায়গায় ত্রিপল টানিয়ে চা বিক্রি করেন মোশারফ আলী। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই বাঙ্কার ভর্তি পাথর ছিল। সব লুট করে নিয়ে গেছে। অপরিচিত হাজার হাজার মানুষ এখানে এসে পাথর তুলে নিয়ে গেছে। বাঙ্কারে ৩০ ফুটেরও বেশি শত শত গর্ত খোঁড়া হয়েছে। এখন কিছুই আর অবশিষ্ট নেই।’

শামসুল হক নামে স্থানীয় আরেক বাসিন্দা বলেন, ‘দিনদুপুরে প্রকাশ্যে সবকিছু লুটপাট করে নিয়ে গেছে। পাশে বিজিবির ক্যাম্প থাকলেও তারা কোনো কিছুই বলেনি। শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছে।’

সিলেটের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সরকারি দপ্তর ঘুরে জানা যায়, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) মামলার কারণে পাথর কোয়ারির ইজারা চার বছর স্থগিত থাকে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ ২০২০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি দেশের সব কোয়ারি থেকে পাথর উত্তোলন স্থগিতের নির্দেশ দেয়। তবে চলতি বছরের ১৩ জানুয়ারি খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় ওই স্থগিতাদেশ বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়। এতে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় উদ্বেগ প্রকাশ করে। গত ২৭ এপ্রিল বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ে এক সভায় পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান পর্যটন আকর্ষণ বিবেচনায় সিলেটের কোয়ারি থেকে পাথর তোলার ক্ষতিকর দিক উপস্থাপন করেন। সভায় দেশের ৫১টি কোয়ারির মধ্যে ১৭টির ইজারা স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত হয়। পাথর উত্তোলন ও পরিবহন বন্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কঠোর অবস্থান নেবে বলে প্রতিশ্রুতি দেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।

গত ১৪ জুন জাফলংয়ের প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) পরিদর্শনে যান বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান এবং পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তখন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতাকর্মীরা পাথর কোয়ারি চালুর দাবিতে উপদেষ্টাদের গাড়িবহর আটকে বিক্ষোভ করেন। এ ঘটনার পর প্রশাসনের অভিযান জোরদার হয়। তবে রাজনৈতিক নেতাকর্মী, শ্রমিক সংগঠন ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের চাপে পরিস্থিতি জটিল হয়ে পড়ে। বিএনপি, জামায়াত, আওয়ামী লীগ, ইসলামী আন্দোলন, এনসিপিসহ সব রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতাকর্মীরা পাথর কোয়ারি চালুর দাবিতে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন শুরু করেন। এরপর পরিবহন শ্রমিকদের আন্দোলনে অচল হয়ে পড়ে সিলেট।

পাথর তুলতে রাজনৈতিক ঐক্য: সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে গত ২৪ জুন পাথর সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী-মালিক ও শ্রমিক ঐক্য পরিষদের ব্যানারে পাথর কোয়ারি খুলে দেওয়ার দাবিতে মানববন্ধন হয়। মানববন্ধন শেষে সেখান থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিলও বের হয়। এতে অংশ নেন সিলেট মহানগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রেজাউল হাসান কয়েস লোদী ও সাধারণ সম্পাদক ইমদাদ হোসেন চৌধুরী, জামায়াতে ইসলামী সিলেট মহানগরের আমির মো. ফখরুল ইসলাম ও জেলার সেক্রেটারি জয়নাল আবেদীন এবং এনসিপির সিলেটের প্রধান সমন্বয়কারী নাজিম উদ্দিন ও মহানগরের প্রধান সমন্বয়কারী আবু সাদেক মোহাম্মদ খায়রুল ইসলাম চৌধুরী।

মানববন্ধনে উপস্থিত সব রাজনৈতিক দলের নেতারা একসুরে কথা বলেন। মহানগর জামায়াতের আমির ফখরুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘যে বা যারাই পরিবেশের দোহাই দিয়ে এখানে পাথর-বালু উত্তোলনের কার্যক্রম বন্ধ রেখেছে, তাদের কোনো উদ্দেশ্য আছে কি না, খতিয়ে দেখার সময় এসেছে।’

মহানগর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রেজাউল হাসান কয়েস লোদী বলেন, ‘যে পাথর কোয়ারি এ জনপদের মানুষ পবিত্র আমানত হিসেবে মনে করত, সেই পাথর কোয়ারি বন্ধ করে দিয়ে ১০ লাখ মানুষের পেটে লাথি মারা হয়েছে।’

তার আগের দিন ২৩ জুন কোম্পানীগঞ্জে এক শ্রমিক সমাবেশে জামায়াতের সিলেট জেলার সেক্রেটারি জয়নাল আবেদীন বলেন, ‘সিলেট অঞ্চলের খেটে খাওয়া মানুষের উপার্জনের একমাত্র ক্ষেত্র পাথর কোয়ারি অবিলম্বে খুলে দিতে হবে, অন্যথায় কোনো নির্বাচন আমরা চাই না।’

তারও আগে ১০ মে সিলেটের কানাইঘাটে ইসলামী আন্দোলনের জনসভায় দলের কেন্দ্রীয় সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে বলেন, ‘প্রয়োজনে মব সৃষ্টি করে হলেও পাথর উত্তোলন করা হবে।’

গত ২ জুলাই বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আরিফুল হক চৌধুরী নগরীর কোর্ট পয়েন্ট এলাকায় পাথর শ্রমিক ও ব্যবসায়ীদের অবস্থান কর্মসূচিতে সংহতি জানিয়ে বলেছিলেন, ‘কোনো নোটিশ ছাড়াই পাথর ভাঙার যন্ত্রের ব্যবসায়ীদের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করছে জেলা প্রশাসন। ডিসি এ অঞ্চলের ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ নষ্ট করছেন। তাকে প্রত্যাহার করতে হবে।’

রাজনৈতিক নেতাদের এসব ধারাবাহিক ঐক্যবদ্ধ বক্তব্যে কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। প্রচণ্ড চাপের মুখে পড়ে স্থানীয় প্রশাসন। একপর্যায়ে স্থানীয় প্রশাসনের অনেক শীর্ষ কর্তাও পাথর উত্তোলনের পক্ষে অবস্থান নেন। ৮ জুলাই বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে পাথর সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী, পরিবহন শ্রমিক ও রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার খান মো. রেজা-উন-নবী বলেন, ‘সারা দেশে পাথর উত্তোলন করা গেলে সিলেটে যাবে না কেন? এর সঙ্গে মানুষের জীবন-জীবিকা জড়িত।’ এর পরই শুরু হয় চতুর্মুখী লুটপাট। যে যেভাবে পারেন সেভাবেই লুট করেন মূল্যবান সাদাপাথর। কেউ পাথর লুটেছেন, আবার কেউবা লুটপাটকারীদের কাছ থেকে চাঁদা নিয়েছেন। রাজনীতিকদের সঙ্গে সমান্তরালভাবে চাঁদাবাজিতে যোগ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে থানা পুলিশ ও বিজিবির বিরুদ্ধেও। রাজনৈতিক দলের নেতারা পাথর উত্তোলনে পার্শ্ববর্তী উপজেলা থেকে শ্রমিকদের ভাড়ায় আনেন। স্থানীয়রা জানান, পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন এলাকার ৩০-৩৫ হাজার শ্রমিক ভাড়ায় এসে পাথর লুটের কাজে অংশ নেয়। গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার পাশাপাশি আশপাশের আরও কয়েকটি উপজেলা থেকেও অনেক শ্রমিককে নিয়ে আসা হয় পাথর উত্তোলনে।

শ্রমিকদের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, প্রতিদিন পাথর উত্তোলন বাবদ ২ হাজার টাকার মতো আয় করতে পারেন তারা। অন্য কাজ করে যেখানে দিনে সর্বোচ্চ আয় হয় এক হাজার টাকা। এ কারণে গত কয়েক মাসে ভিড় বাড়ে শ্রমিকদের।

যত মামলা: পাথর লুটপাটের ঘটনায় পরিবেশ অধিদপ্তরের স্থানীয় কার্যালয় ও কোম্পানীগঞ্জ থানা পুলিশ বেশ কয়েকটি মামলা করে। তবে বেশিরভাগ মামলাতেই হোতাদের বাদ দিয়ে আসামি করা হয় শ্রমিক ও অজ্ঞাতপরিচয়দের। কোম্পানীগঞ্জ থানায় বালু ও পাথর লুটপাটের ঘটনায় অন্তত ১৯টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় নাম উল্লেখ করা আসামি রয়েছে ১৫৭ এবং অজ্ঞাতপরিচয় ২৮৬ জন। যার মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছে মাত্র ৬০ জন। এ ছাড়া বিশেষ টাস্কফোর্সের অভিযানে আরও ৫২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। জাফলংয়ে বালু ও পাথর লুটপাটে ১১টি মামলা করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। এসব মামলায় আসামি করা হয় ২৫১ জনকে।

জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের সিলেট বিভাগের এক শীর্ষ কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, ‘এখানে আসলে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক মদদে চতুর্মুখী লুটপাট চালানো হয়েছে। পাথর একটি খনিজ সম্পদ। তাই এটি রক্ষার প্রাথমিক দায়িত্ব খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় ও খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর। তবে তারা এখানে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। আমরা আগে ১ কোটি ঘনফুট পাথর জব্দ করেছিলাম। পরে উল্টো তারা আমাদের চিঠি দিয়ে বলে—আমরা এটি করতে পারি না।’

মিলেমিশে লুটপাট: কালবেলার অনুসন্ধানে পাথর লুটপাটের সঙ্গে সব রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতাদের যোগসাজশের প্রমাণ পাওয়া গেছে। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির তৎকালীন সভাপতি মো. সাহাব উদ্দিনের নাম গণমাধ্যমে এলে কেন্দ্র থেকে তার পদ স্থগিত করা হয়। এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে উপজেলা বিএনপি সভাপতির পদ স্থগিত হওয়া মো. সাহাব উদ্দিনের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল ও বার্তা পাঠিয়েও কোনো সাড়া মেলেনি। তবে জানতে চাইলে বিএনপির কেন্দ্রীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক মিফতা সিদ্দীকি কালবেলাকে বলেন, ‘লুটপাটকারীদের কোনো দল থাকতে পারে না। লুটপাটকারী ও চাঁদাবাজরা সমাজ, দেশ, দল; সবকিছুর শত্রু। এদের বিরুদ্ধে সর্বত্র প্রতিরোধ প্রয়োজন। সুন্দর বাংলাদেশ গড়তে আমাদের সবাইকে একত্রিত হয়ে দল ও মতপার্থক্যের ঊর্ধ্বে উঠে দেশের স্বার্থে কাজ করতে হবে।’

আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মধ্যে বালু ও পাথর লুটপাটে নেতৃত্ব দেন কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও তেলিখাল ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান আব্দুল ওদুদ আলফু ওরফে আলফু চেয়ারম্যান। তার নেতৃত্বে লুটপাটে ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা হাফিজ আব্দুল্লাহ, কুদ্দুস, বিল্লাল মিয়া, ২ নম্বর পূর্ব ইসলামপুর যুবলীগ সভাপতি আলিমুদ্দিন ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আজিমউদ্দিন, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সদস্য শাহাবুদ্দিন, মনির, কালিবাড়ি ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি সৈয়দুর রহমান ও পূর্ব ইসলামপুর আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল আজিজ। তবে আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল ওদুদ আলফু ওরফে আলফু চেয়ারম্যান কালবেলার প্রশ্নের জবাবে পাথর লুটপাটে নিজের সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করেন। অন্যদিকে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা জামায়াতের সাবেক আমির আজমান আলীর নেতৃত্বে লুটপাটে অংশ নেন জামায়াত নেতাকর্মীরা। এতে জড়িত ছিলেন জামায়াত নেতা মাস্টার শফিকুর। অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে আজমান আলীর মোবাইল ফোনে বেশ কয়েকদিন ধরে কল ও বার্তা পাঠিয়েও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

তবে জানতে চাইলে সিলেট জামায়াতের আমির মাওলানা হাবিবুর রহমান বলেন, ‘এ ধরনের ন্যক্কারজনক কাজের সঙ্গে আমাদের কোনো নেতাকর্মী জড়িত নয়। আমরা শুরু থেকেই এর বিরোধিতা করে আসছি। তবুও কারও সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এক্ষেত্রে ছাড় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।’

এ ছাড়া ইসলামী আন্দোলনের সিলেট জেলা শাখার ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক আবু আহমদ, কোম্পানীঞ্জ উপজেলার সভাপতি মো. মামুন ও পূর্ব ইসলামপুর ইউনিয়নের সভাপতি মইনউদ্দিন মিলন পাথর লুটপাটে অংশ নেন। তবে নিজেদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি অস্বীকার করেন ইসলামী আন্দোলনের সিলেট জেলা শাখার ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক আবু আহমদ। তার দাবি, ক্রাশার মেশিনে তিনি শুধু এলসির (আমদানিকৃত) পাথর ভাঙেন।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা শাখার নেতা জাকির আহমদ ও সাজনের নেতৃত্বেও প্রকাশ্যে পাথর উত্তোলন করা হয়েছে। তবে জাকির নিজের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। গণঅধিকার পরিষদ কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার আহ্বায়ক লিটন মাহমুদের নেতৃত্বেও পাথর লুটপাটের অভিযোগ পাওয়া গেছে। যদিও লিটন মাহমুদ বিষয়টি অস্বীকার করে একে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র বলে আখ্যায়িত করেন।

যেভাবে পাচার হয় পাথর: পাথর ব্যবসার অন্যতম কেন্দ্র কোম্পানীগঞ্জ। এখানে প্রতিদিন ভারত থেকে বিপুল পরিমাণে পাথর আমদানি করা হয়। সিলেট সদর উপজেলার ধোপাগুল-লালবাগ, সালুটিকর ও কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ এলাকায় শত শত ক্রাশার মিল রয়েছে। এসব মিলে বড় পাথর ভেঙে ছোট টুকরা করা হয়। কালবেলার অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এসব মিলে প্রথমে লুটপাট করা পাথর এনে ক্রাশারে ভেঙে ছোট ছোট টুকরা করা হয়। এরপর এসব পাথর গভীর রাতে শত শত ট্রাকে করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এর মধ্যে কিছু কিছু ট্রাকে ওপরে বালু, নিচে পাথর দিয়ে সরিয়ে নেওয়ার প্রমাণ মিলেছে। এ ছাড়া ভারত থেকে আনা এলসির পাথরের সঙ্গে মিশিয়েও পাথর সরানোর প্রমাণ মিলেছে। আবার নদীপথেও নৌকা করে পাথর সরানো হয়। গত ১২ আগস্ট রাতে শত শত ট্রাকে করে পাথর সরিয়ে নেওয়ার ৩ মিনিট ৪৫ সেকেন্ডের একটি এক্সক্লুসিভ ভিডিও প্রকাশ করে কালবেলা। এরপর নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। দুদকের অভিযানের পরদিন রাত থেকেই তৎপরতা বাড়িয়ে লুট হওয়া পাথর উদ্ধারে অভিযান শুরু করে জেলা প্রশাসন। সার্বক্ষণিক টহল বাড়ানো হয় পর্যটন কেন্দ্রে। এ ছাড়া জাফলংয়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে চলা অভিযানে পাথর উত্তোলনের বেশকিছু নৌকা নষ্ট করে দেওয়া হয়।

কী পরিমাণ ও কত টাকার পাথর লুট হয়েছে : সিলেটে যে পাথর লুট হয়েছে সেই সাদাপাথর অত্যন্ত মূল্যবান খনিজসম্পদ। এগুলো সাধারণত নির্মাণকাজে ব্যাপকহারে ব্যবহার হয়। বিশেষ করে ফাউন্ডেশন, রাস্তা, ব্রিজ, আর্টিফিশিয়াল কংক্রিট, ইটের মিশ্রণ, বাড়ির দেয়াল, বারান্দা, ফ্লোর তৈরির কাজে। এ ছাড়া ডেকোরেটিভ ও সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্যও এসব পাথর ব্যবহার হয়। যে পাথরের দাম প্রতিঘনফুট ২২০ থেকে ২৩০ টাকা। তবে কী পরিমাণ পাথর লুটপাট হয়েছে তার সুনির্দিষ্ট কোনো হিসাব কারও কাছেই নেই। স্থানীয় বাসিন্দা ও পরিবেশকর্মীদের তথ্যমতে, গত এক বছরে সিলেটের সাদাপাথর এবং বিছানাকান্দি, জাফলং, উৎমাছড়া, লাকমাছড়াসহ আশপাশের নদী ও পর্যটন কেন্দ্রগুলো থেকে প্রায় ৪ কোটি ঘনফুট পাথর লুটপাট করা হয়েছে।

পাথরশূন্য বিছনাকান্দি পর্যটন স্পট: পাথরকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বিছনাকান্দি পর্যটন কেন্দ্রের পাথর চুরি হওয়ায় কিছুটা নড়েচড়ে বসেছিল গোয়াইনঘাট উপজেলা প্রশাসন। পাথর চোর চক্রের বিরুদ্ধে মামলা ও টাস্কফোর্সের অভিযানে লক্ষাধিক ঘনফুট পাথর জব্দ করা হয়েছিল। তবে পরবর্তী সময়ে জব্দকৃত এসব পাথরের আর হদিস পাওয়া যায়নি। স্থানীয়রা বলছেন, প্রশাসনের সহযোগিতা ছাড়া অভিযানে জব্দকৃত পাথর সরিয়ে নেওয়া সম্ভব ছিল না।

জানা যায়, গোয়াইনঘাট উপজেলার সাবেক সহকারী কমিশনার (ভূমি) সাইদুল ইসলামের মৌখিক আদেশে তোয়াকুল ইউনিয়ন ভূমি অফিসের সাবেক তহশিলদার রুহুল আমিন বাদী হয়ে ৩০ অক্টোবর গোয়াইনঘাট থানায় একটি মামলা করেন। যাতে বিছনাকান্দি পর্যটন কেন্দ্র ও তৎসংলগ্ন এলাকা থেকে আনুমানিক ৬০ লাখ ঘনফুট পাথর চুরি হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। ওই মামলায় উপজেলার রুস্তুমপুর ইউনিয়নের ভেড়িবিল গ্রামের আব্দুছ ছত্তারের ছেলে হারুন মিয়াকে প্রধান আসামি করে এজাহারে ২৩ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। এ ছাড়া অজ্ঞাতপরিচয় আসামি করা হয়েছিল আরও ৫০ থেকে ৬০ জনকে। এজাহারে উল্লেখ করা হয়, ৫ আগস্ট বিকেল ৪টা থেকে সৃষ্ট অস্থিতিশীল পরিবেশে দুষ্কৃতকারীরা পাথর চুরি শুরু করে এবং ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত নিয়মিত বিছনাকান্দি পর্যটন কেন্দ্র ও তৎসংলগ্ন এলাকা থেকে প্রায় ৬০ লাখ ঘনফুট পাথর চুরি করে নিয়ে যায়।

গোয়াইনঘাট থানায় পাথর চুরির মামলা (নং ৪৫/২৭৫) হওয়ার পর ৩ নভেম্বর গোয়াইনঘাট উপজেলার সাবেক ইউএনও ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. তৌহিদুল ইসলামের নেতৃত্বে বিছনাকান্দি সীমান্ত এলাকায় টাস্কফোর্সের অভিযান চলে। অভিযানে বিছনাকান্দি সীমান্ত এলাকার বিভিন্ন গ্রামে পতিত অবস্থায় আনুমানিক ১ লাখ ২৫ হাজার ৯০০ ঘনফুট পাথর জব্দ করা হয়েছিল।

হুমকিতে জাফলং: অবৈধভাবে পাথর ও বালু উত্তোলনের ফলে হুমকিতে পড়েছে ভ্রমণপিপাসুদের অন্যতম পছন্দের পর্যটনকেন্দ্র জাফলং। গত বুধবার দুপুরে জাফলংয়ের পিয়াইন নদীতে শ্রমিকদের পাথর উত্তোলন করতে দেখা গেছে। সে সময় জিরো পয়েন্টের পাশে শত শত পাথর ও বালু তোলার নৌকা নোঙর করা অবস্থায় ছিল। একই সময় জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পলি রানি দেবকে অভিযান চালাতে দেখা যায়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পাথর লুটের শুরুতেই দল থেকে বহিষ্কার হন বিএনপি নেতা শাহ পরান। এ ছাড়া পাথর লুটে জড়িত থাকার অভিযোগে পরিবেশ অধিদপ্তরের মামলার আসামি হয়েছেন গোয়াইনঘাট উপজেলা পরিষদের অপসারিত চেয়ারম্যান ও সিলেট জেলা বিএনপির বহিষ্কৃত কোষাধ্যক্ষ শাহ আলম স্বপন এবং পূর্ব জাফলং ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আমজাদ বক্স। জাফলংয়ের পাথর লুটের ঘটনায় বিএনপির ওই তিন নেতাসহ আরও অনেকে আসামি হয়েছেন। গত ৯ জানুয়ারি জেলা যুবদলের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আবুল কাশেমকে বহিষ্কার করা হয়।

পাশেই বিজিবি ক্যাম্প, তবু থেমে নেই লুট: সিলেটে লুটপাট হওয়া সাদাপাথরের আশপাশে বিজিবির একাধিক ক্যাম্প রয়েছে। সম্প্রতি সেখানে গিয়ে ক্যাম্পে বিজিবির সদস্যদের সরব উপস্থিতি দেখা গেছে। নদীর কিনারে যেখানে পাথর মজুত করা হয়, সেখানে বিজিবি সদস্যরা নৌকায় বসে ছিলেন, আবার কেউবা দাঁড়িয়ে মোবাইল ফোনে কথা বলছিলেন। তাদের সামনেই চলতে থাকে পাথর কেনাবেচা। শতাধিক বারকি নৌকা দিয়ে নির্বিঘ্নে নিরাপদে পাথর লুট করতে দেখা যায়।

পাথর উত্তোলনে নিয়োজিত শ্রমিকরা জানান, বিজিবি সদস্যদের নিয়মিত টাকা দিতে হয়। তারা সিগন্যাল দিলে (ইশারা) পাথর উত্তোলন শুরু হয়, আর বন্ধ করতে বললে বন্ধ রাখতে হয়। বিজিবির লাইনম্যানের হাতে প্রতি গর্ত অনুযায়ী হিসাব করে টাকা দিতে হয়। এর পর পুলিশ ও প্রশাসনের চাঁদা পরিশোধ করতে হয়, যা মাসোহারা নামে পরিচিত। কোনো মাসে টাকা না দিলে অভিযানের নামে উৎপাত করা হয়। এ ছাড়া রাজনৈতিক নেতাদের তৎপরতাও থাকে; পাথর-বালু গাড়িতে ওঠার আগেই তাদের গাড়িপ্রতি ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা দিতে হয়। জানতে চাইলে ৪৮ বিজিবি সিলেট ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল নাজমুল হক কালবেলাকে বলেন, ‘আমাদের প্রধান কাজ সীমান্ত নিরাপত্তা ও চোরাচালান বন্ধ করা। এ ছাড়া যেহেতু এই পর্যটন স্পটটি আমাদের ক্যাম্পের কাছেই, তাই রাষ্ট্রীয় এই সম্পদ রক্ষাও আমার একটা দায়িত্ব। যে কারণে আপনি দেখবেন—

আমাদের ক্যাম্পের পাশে মূল যে পর্যটন স্পট, সেখানে এখনো কিছু পাথর আছে। তাছাড়া আমরা সীমান্ত থেকে ১৫০ গজ পর্যন্ত এরিয়াকে (এলাকা) প্রায়োরিটি (অগ্রাধিকার) দিয়ে থাকি। আমাদেরও কিছু লিমিটেশন (সীমাবদ্ধতা) আছে, বিজিবির সুনির্দিষ্ট কিছু কাজও আছে। তবে রাতের বেলা এরা যখন লুট করতে আসে, একসঙ্গে ৪০০-৫০০ নৌকা আসে। হাজার হাজার মানুষ আসে—সেখানে আমাদের একার পক্ষে এটা সামলানো খুবই টাফ (কঠিন)। তবে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। রাতে তারা আমাদের দিকে পাথর ছুড়ে মারে। এতে আমাদের অফিসাররাও আহত হয়েছেন।’

বাঙ্কার হয়েছে গিরিখাত, কিছুই নেই শাহ আরেফিন টিলায়: ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে শাহ আরেফিন টিলা। এক সময় এখানে বড় আকারের দুটি টিলা ছিল, যেখানে মাটির নিচে স্তরে স্তরে ছিল অসংখ্য পাথর। চূড়া ও টিলার ভাঁজে ভাঁজে ছিল সবুজ গাছপালা। ধীরে ধীরে ‘পাথরখেকো’দের কারণে পাথর সাবাড় হয়ে গেছে। সুউচ্চ টিলার জায়গায় এখন গভীর গর্ত। বাঙ্কার এলাকায়ও শত শত গর্ত করা হয়েছে। জানা গেছে, এখানে বিপুল পরিমাণে পাথর জমা ছিল।

দুদকের অভিযানের পর বেড়েছে তৎপরতা: দুদকের সিলেট জেলা সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের একটি টিম গত ১৩ আগস্ট দুপুরে সাদাপাথর কোয়ারিতে অভিযানে যায়। এ সময় স্থানীয় প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার পাথর লুটের প্রমাণ পায় দুদকের দলটি। অভিযানের নেতৃত্বে থাকা দুদকের উপপরিচালক রাফি মোহাম্মাদ সাদাত জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেন। এরপর সন্ধ্যায় জরুরি সভা ডাকা হয় সিলেটের জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে। রাত থেকেই বিভিন্ন পয়েন্টে চেকপোস্ট বসিয়ে পাথর উদ্ধার অভিযান শুরু হয়।

জানতে চাইলে দুদকের সহকারী পরিচালক (জনসংযোগ) তানজীর আহমেদ বলেন, ‘কমিশনের নির্দেশে আমাদের সিলেটের টিম সাদাপাথরে অভিযানে যায়। সেখানে গিয়ে আমাদের টিম শত শত কোটি টাকার রাষ্ট্রীয় সম্পদ সাদা পাথর লুটপাটের বিভিন্ন আলামত পায়। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলেন, এই লুটপাটের সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সম্পৃক্ততা ও স্থানীয় প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ পায়। সরকারি চাকরিজীবীদের দায়িত্বে অবহেলা দুদকের তপশিলভুক্ত শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সরকারি এই সম্পদ লুটপাটে যাদেরই সম্পৃক্ততা ও যোগসাজশ কিংবা দায়িত্বে অবহেলার প্রমাণ পাওয়া যাবে, তাদের সবাইকেই আইনের আওতায় আনা হবে।’

এনসিপির সিলেট জেলার প্রধান সমন্বয়কারী নাজিম উদ্দিন শাহান কালবেলাকে বলেন, ‘সাদাপাথরে কারা লুটপাট করেছে, সবাই তা জানে। আমাদের বৈষম্যবিরোধী বা এনসিপির কেউ জড়িত নন। সিলেটের এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যারা ধ্বংস করেছে, তাদের আইনের আওতায় আনা উচিত।’

জানতে চাইলে কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি উজাইর রহমান বলেন, ‘এখানে আমাদের কোনো দুর্বলতা, গাফিলতি কিংবা যোগসাজশ নেই। আমরা ৫ আগস্টের পরে এ ঘটনায় ১৯টি মামলা করেছি। আমাদের ওপরে পাঁচবার হামলা করা হয়েছে।’

যা বলছে বেলা: বেলার সিলেট বিভাগীয় সমন্বয়ক শাহ শাহেদা আখতার কারবেলাকে বলেন, ‘বেলার পক্ষ থেকে আমরা অনেকবার প্রশাসনকে স্পষ্ট করে বলেছি যে, আমরা যদি এখনই এটা (পাথর লুটপাট) থামাতে না পারি, তাহলে এখন যা হয়েছে সে অবস্থার সৃষ্টি হবে। তবে তারা আন্তরিকভাবে কাজ করেনি। তাদের কার্যকর কোনো ভূমিকা আসলে দেখিনি। কী পরিমাণ পাথর লুটপাট করা হয়েছে তার সুনির্দিষ্ট হিসাবও কেউ দিচ্ছে না। তার মানে হলো—রাজনৈতিক নেতা থেকে প্রশাসন সবার যোগসাজশে সম্মিলিতভাবে এই লুটপাটটা হয়েছে।’

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ বলেন, ‘পাথর লুটপাটকারীদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। লুটপাটে যাদেরই সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাবে, তাদের সবাইকেই আইনের আওতায় আনা হবে।’

সিলেটে পাথর লুটের ঘটনা প্রসঙ্গে গতকাল রোববার দুপুরে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে কথা বলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। পরিবেশ উপদেষ্টা বলেন, ‘সিলেটে পাথর লুটের ঘটনায় স্থানীয় প্রশাসনের যোগসাজশ ছিল অথবা প্রশাসন নীরব ছিল। এ ঘটনায় প্রশাসনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত হবে।’

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে আন্দোলন করে পাথর উত্তোলন বন্ধে সফল হলেও অন্তর্বতী সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে পাথর উত্তোলন ঠেকাতে গিয়ে বাধার মুখে পড়ার কথাও তুলে ধরেন সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেন, ‘পাথর লুটপাট যেন বন্ধ হয়, সেজন্যই ফিল্ডে গিয়েছিলাম। যারা লুটপাট করে তাদের একটা বার্তা দিতে গিয়েছিলাম। গত ২০ বছরে পাথর লুটের বিরুদ্ধে কোনো মন্ত্রীকে ফিল্ডে যেতে, আক্রান্ত হতে দেখেছেন?’

পরিবেশ উপদেষ্টা বলেন, ‘পাথর ইজারা ও বালু ইজারা জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে হয়ে থাকে। যখন আমরা পরিবেশ আন্দোলন করছিলাম, তখন ২০১১ সালে একটা রায় পাই। সেটা হচ্ছে- জাফলংয়ে ডাউকি ও পিয়াইন ইকোলজিক্যালি ক্রিটিক্যাল এরিয়া (ইসিএ) ঘোষণা করা। সেই আদেশ ক্রমাগত চেষ্টা করে ২০১৬ সালে মন্ত্রণালয় পর্যন্ত আনতে পারছিলাম। ২০১৯ সালে এটাকে ইকোলজিক্যালি ক্রিটিক্যাল এরিয়া ঘোষণা করা হয়েছিল। তখন আমাদের মনে হয়েছে ওখানে পরিবেশবান্ধব পর্যটন করলে সব শ্রমিক সেখানে পুনর্বাসিত হবে এবং পাথর কোয়ারিটাও রক্ষা পাবে। পিয়াইন ও ডাউকিতে ২০২০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত পাথর তোলা বন্ধ ছিল। এই মামলার বাদী এককভাবে আমিই ছিলাম।’

রিজওয়ানা হাসান আরও বলেন, ‘নতুন সরকার দায়িত্বে আসার পর যুক্তি হাজির করা হলো যে, পাথর তো চুরি হচ্ছেই। তাহলে আমরা লিজ দেই না কেন? আমরা পাল্টা যুক্তি দিলাম যে, পাথর যদি চুরি হয়, তাহলে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। তার মানে এই নয় যে, আবার লিজ দেওয়া শুরু করব।’

আরও পড়ুন

Lading . . .