Advertisement

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘর্ষে আহত ৮৩ শিক্ষার্থীকে বাঁচালেন রুবেল

প্রথম আলো

প্রকাশ: ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

সংঘর্ষে আহত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮৩ শিক্ষার্থীকে বিনা ভাড়ায় চিকিৎসাকেন্দ্রে নিয়ে যান রিকশাচালক মোহাম্মদ রুবেল হোসেন। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের ঝুপড়িতেছবি: সৌরভ দাশ
সংঘর্ষে আহত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮৩ শিক্ষার্থীকে বিনা ভাড়ায় চিকিৎসাকেন্দ্রে নিয়ে যান রিকশাচালক মোহাম্মদ রুবেল হোসেন। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের ঝুপড়িতেছবি: সৌরভ দাশ

প্রতিদিনের মতোই সকালে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা নিয়ে বের হয়েছিলেন মোহাম্মদ রুবেল হোসেন। দুপুরে হঠাৎ থমকে যান তিনি। রক্তাক্ত অবস্থায় এদিক-সেদিক ছুটতে দেখেন আহত কয়েক শ আহত শিক্ষার্থীকে। এ দৃশ্য দেখে আতঙ্কে ঘটনাস্থলে থাকা রিকশাচালকেরা ফিরে যাচ্ছিলেন। তবে রুবেল করলেন উল্টোটা। নিজের অটোরিকশায় করে একের পর এক চিকিৎসাকেন্দ্রে নিতে থাকেন আহত শিক্ষার্থীদের। আহত ৮৩ জনকে পর্যায়ক্রমে শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাকেন্দ্রে নিয়ে যান তিনি।

গত ৩১ আগস্ট চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ নম্বর গেট এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। ওই দিন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয় লোকজনের সংঘর্ষ হয়। আগের রাতে এক ছাত্রীকে তাঁর বাসার দারোয়ানের মারধরের অভিযোগ ওঠার পর সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। এই সংঘর্ষে অন্তত ২০০ শিক্ষার্থী আহত হন। ওই দিন নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েই আহত এসব শিক্ষার্থীর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন অটোরিকশাচালক রুবেল। এখনো তাঁর অটোরিকশার আসনে আহত শিক্ষার্থীদের রক্তের দাগ রয়েছে। রুবেলকে গত মঙ্গলবার বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন পুরস্কৃত করেছে।

রুবেলের বাড়ি কুমিল্লার লাকসামে। ২০১৩ সালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আসেন। এরপর থেকে ভাড়ায় অটোরিকশা চালাচ্ছেন তিনি। স্ত্রী, সাড়ে চার বছর বয়সী কন্যা ও তিন বছরের ছেলেকে নিয়ে তাঁর সংসার। অটোরিকশা চালিয়ে কখনো ৩০০ আবার কখনো ৫০০ টাকা আয় হয় তাঁর। এটি দিয়েই তাঁর সংসার চলে।

সেদিন কেউ টাকা দেননি, আমিও চাইনি। বিবেকই আমাকে চালিয়েছে। পরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আমাকে ডেকে স্বেচ্ছায় টাকা ও পুরস্কার দিয়েছে। আমি কিছু চাইনি। তবে আমার পরিবারের সদস্যরাও বিষয়টি জেনে খুশি হয়েছেন।
মোহাম্মদ রুবেল হোসেন, অটোরিকশাচালক

গতকাল বৃহস্পতিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের ঝুপড়িতে কথা হয় রুবেলের সঙ্গে। ওই দিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে রুবেল হোসেন বলেন, অটোরিকশা নিয়ে যখন তিনি বের হন, তখনো সংঘর্ষের খবর জানতেন না। একটি ভাড়া নিয়ে ২ নম্বর গেট এলাকায় যাওয়ার পর সংঘর্ষে আহত ব্যক্তিদের দেখতে পান।

রুবেল বলেন, শিক্ষার্থীরা তাঁকে প্রথমে ভুল বুঝেছিলেন। স্থানীয় গ্রামবাসী ভেবে তাঁকেও আঘাত করা হয়। অটোরিকশার চাবিও ভেঙে দেওয়া হয়। এর পরও তিনি দমে যাননি। তিনি শিক্ষার্থীদের সাহায্য করেছেন। তিনি বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা আমার ভাই বা আত্মীয়ের মতো। তাঁদের কারণেই তো আমার সংসার চলে। শিক্ষার্থী না থাকলে আমাদের আয়-রোজগার হতো কীভাবে?’

সেদিন দুপুরে খাওয়ারও সময় পাননি রুবেল। তিনি বলেন, বিকেল সাড়ে চারটা পর্যন্ত তিনি কিছু খাননি। অনেকে আহত ছিলেন। ওই পরিস্থিতিতে খাবার খাওয়ার পরিস্থিতি ছিল না। পরে একজন শিক্ষার্থী অনেকটা জোর করে তাঁকে বিস্কুট আর পানি খাওয়ান। ওই শিক্ষার্থী বলছিলেন, ‘কিছু খান, নইলে আহতদের কে নিয়ে যাবে।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের যে জায়গায় সংঘর্ষ হয়েছিল, সেখান থেকে চিকিৎসাকেন্দ্রে যেতে ভাড়া লাগে ২০ থেকে ৩০ টাকা। তবে অসংখ্যবার শিক্ষার্থীদের চিকিৎসাকেন্দ্রে নিয়ে গেলেও তিনি ভাড়া নেননি। রুবেল বলেন, ‘সেদিন কেউ টাকা দেননি, আমিও চাইনি। বিবেকই আমাকে চালিয়েছে। পরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আমাকে ডেকে স্বেচ্ছায় টাকা ও পুরস্কার দিয়েছে। আমি কিছু চাইনি। তবে আমার পরিবারের সদস্যরাও বিষয়টি জেনে খুশি হয়েছেন।’

পুরস্কারের বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর নুরুল হামিদ প্রথম আলোকে বলেন, রুবেল চিন্তা ও মননে মানবিক। সংঘর্ষে আহত ৮৩ শিক্ষার্থীকে বিনা ভাড়ায় চিকিৎসাকেন্দ্রে নেওয়ার মাধ্যমে তিনি অনন্য নজির স্থাপন করেছেন। তাঁর সরলতা, সততা ও দায়িত্ববোধের জন্যই এই পুরস্কার দেওয়া হয়েছে।

Lading . . .