চার কোটি টাকার ভবন পড়ে আছে, এক যুগেও চালু হয়নি সেবা
প্রকাশ: ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তিদের জরুরি চিকিৎসা দিতে লোহাগাড়া উপজেলায় নির্মাণ করা হয় একটি ট্রমা সেন্টার (আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসাকেন্দ্র)। প্রায় চার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ট্রমা সেন্টারটি উদ্বোধনও করা হয় ২০১৩ সালে, তবে ১২ বছর পার হলেও জনবল ও যন্ত্রপাতির অভাবে এটি চালু করা যায়নি।
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের দৈর্ঘ্য ১৪৮ কিলোমিটার। দুই লেনের সরু এই মহাসড়ক খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ও দুর্ঘটনাপ্রবণ হিসেবে পরিচিত। মহাসড়কটির কাছে কোনো বিশেষায়িত হাসপাতাল নেই। ট্রমা সেন্টার উদ্বোধনের পরও চালু না হওয়ার কারণে মহাসড়কটিতে হতাহত ব্যক্তিরা দ্রুত চিকিৎসাসেবা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০০৭ সালে ২০ শয্যার লোহাগাড়া ট্রমা সেন্টারটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। ৩ কোটি ৮৫ লাখ টাকা ব্যয়ে তিনতলা ভবনটির নির্মাণকাজ শেষ হয় ২০১২ সালে। এই সেন্টারের জন্য চিকিৎসা কর্মকর্তা, জুনিয়র কনসালট্যান্ট, সহকারী সার্জন, নার্স, টেকনোলজিস্টকে মোট ২৭টি পদের সুপারিশ করা হয়। কিন্তু এসব পদের বিপরীতে জনবল পদায়ন করা হয়নি। যন্ত্রপাতিও বরাদ্দ দেওয়া হয়নি, যার কারণে চালু করা যায়নি ট্রমা সেন্টারটি।
মহাসড়কের চন্দনাইশ, সাতকানিয়া ও লোহাগাড়া উপজেলা অংশের প্রায় ৬০ কিলোমিটারের মতো দোহাজারী হাইওয়ে থানার অধীন। ২০২৫ সালের এ পর্যন্ত এই অংশেই ৫১টি দুর্ঘটনায় অন্তত ৩৫ জন নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে হাইওয়ে পুলিশ।
উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, সম্প্রতি স্বাস্থ্য উপদেষ্টার নির্দেশে ট্রমা সেন্টারটিতে চিকিৎসাসেবা শুরু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সেই লক্ষ্যে চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তি করেছে সরকার। চুক্তি অনুযায়ী বেসরকারি হাসপাতালটি প্রয়োজনীয় জনবল, যন্ত্রপাতিসহ প্রয়োজনীয় সহায়তা দেবে। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হবে লোহাগাড়া ট্রমা সেন্টার।
লোহাগাড়া ট্রমা সেন্টারটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পাশেই অবস্থিত। সম্প্রতি সেখানে গিয়ে দেখা যায়, দীর্ঘদিন ধরে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকা ভবনটিতে শ্রমিকেরা সাজসজ্জা ও পরিচ্ছন্নতার কাজ করছেন। নষ্ট হয়ে যাওয়া আসবাবপত্র মেরামত করা হচ্ছে। শ্রমিকেরা জানান, প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে তাঁরা ভবনটি ব্যবহার উপযোগী করার কাজ করছেন।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. ইকবাল হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিদিন অনেক হাড়ভাঙা রোগী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আসেন। ট্রমা সেন্টারটি চালু হলে তাঁরা সেখানে চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ পেতেন। এটি চালুর বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে বেশ কয়েকবার চাহিদাপত্র পাঠিয়েছেন তিনি। বেসরকারি হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তির বিষয়টি নিশ্চিত করে মো. ইকবাল হোসেন বলেন, সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যেই যাতে ট্রমা সেন্টারটি চালু করা যায়, সেই চেষ্টা চলছে।
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক হয়ে বান্দরবান ও কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকতে যান পর্যটকেরা। এ কারণে সড়কটিতে সব সময় যানবাহন ও যাত্রীর বাড়তি চাপ থাকে। সরু সড়কটিতে অসংখ্য ঝুঁকিপূর্ণ বাঁকের সঙ্গে রয়েছে তিন চাকার যানবাহনের দৌরাত্ম্য। এ ছাড়া লবণবোঝাই ট্রাক থেকে ঝরে পড়া পানির কারণে পিচ্ছিল থাকে সড়কটি। যার কারণে প্রায়ই ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটে। তবে মহাসড়কের পাশে বিশেষায়িত হাসপাতাল না থাকায় দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত ব্যক্তিরা দ্রুত চিকিৎসাসেবা পান না। এতে মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যায়।
চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তিদের বেশির ভাগই মারা যান অতিরিক্ত রক্তপাতের কারণে। আহত ব্যক্তিদের গোল্ডেন আওয়ারের (প্রথম এক ঘণ্টা) মধ্যে চিকিৎসাসেবা দিয়ে রক্তপাত বন্ধ করা গেলে অনেকের জীবন বাঁচানো সম্ভব হয়।
মহাসড়কের চন্দনাইশ, সাতকানিয়া ও লোহাগাড়া উপজেলা অংশের প্রায় ৬০ কিলোমিটারের মতো দোহাজারী হাইওয়ে থানার অধীন। ২০২৫ সালের এ পর্যন্ত এই অংশেই ৫১টি দুর্ঘটনায় অন্তত ৩৫ জন নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে হাইওয়ে পুলিশ।
২০২১ সালে লোহাগাড়া উপজেলার তজু মুন্সীর গ্যারেজ এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেন উপজেলার আমিরাবাদ গ্রামের বাসিন্দা রমজান আলী। তিনি বলেন, দুর্ঘটনার অন্তত চার ঘণ্টা পর তাঁকে নগরের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। ট্রমা সেন্টারটি চালু থাকলে তিনি পাঁচ মিনিটের মধ্যেই সেবা পেতেন, হয়তো তাঁকে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হতো না।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তিদের দ্রুত সেবা দিতে ট্রমা সেন্টার তৈরি করা ছিল গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। সেন্টার নির্মাণ করার উদ্দেশ্য ছিল দুর্ঘটনা ঘটলে দ্রুত চিকিৎসা দিয়ে মৃত্যুহার ও পঙ্গুত্ব কমানো। দ্রুত যাতে লোহাগাড়ার ট্রমা সেন্টারটি চালু করা হয়, সেই দাবি সরকারের কাছে জানাচ্ছি।’