চট্টগ্রামের লোহাগাড়ায় বাসচাপায় তরুণের মৃত্যু, দিশাহারা পরিবার
প্রকাশ: ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

‘দুপুরে রান্না শেষে ছেলেটারে বললাম ভাত খাইতে। সে বলল, জোহরের নামাজ পড়ে এসে খাবে। দুপুরের ভাত আর খাওয়া হয়নি, বাসচাপায় ছেলেটা মরে গেল।’ ঘরের বারান্দায় চোখের পানি মুছতে মুছতে কথাগুলো বলছিলেন আছমা খাতুন।
বৃদ্ধা আছমা খাতুনের বসবাস চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার চুনতি ইউনিয়নের বনপুকুর পাড় কালু সিকদারপাড়ায়। গতকাল মঙ্গলবার রাত আটটার দিকে বাড়িতে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। বাড়ির অদূরেই গতকাল বেলা সোয়া একটার দিকে বাসচাপায় নিহত হন তাঁর ২৫ বছর বয়সী ছেলে জাকির হোসেন। জাকির স্থানীয় একটি কলেজে স্নাতকের ছাত্র ছিলেন।
জাকিরেরা পাঁচ ভাই-বোন। তিন বোন বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে থাকেন। তাঁর বড় ভাইটি বিবাহিত এবং পেশায় দিনমজুর। নিজের পড়ালেখার খরচ জোগানোর পাশাপাশি বৃদ্ধ মা-বাবার ভরণপোষণের দায়িত্ব ছিল জাকিরের কাঁধে। তাই টিউশনির পাশাপাশি ব্র্যাকের গণশিক্ষা প্রকল্পের একটি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন তিনি।
কয়েক দিন আগেও আমাকে নিয়ে হাসপাতালে ছোটাছুটি করেছে ছেলেটা। বিকালে বাজারে গিয়ে আমার জন্য ওষুধ আনার কথা ছিল তার। আমার ওষুধ আনা আর হয়নি। এভাবে ছেলেটা চলে যাবে, স্বপ্নেও ভাবিনি।আবুল ফজল, নিহত জাকিরের বাবা
জাকিরের বাড়িটি চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের পাশেই। টিনের ছাউনির মাটির একটি ছোট ঘরে তাঁর পরিবারের বসবাস। সরেজমিনে বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বারান্দায় বসে ছেলের কথা বলে বিলাপ করছেন আছমা খাতুন। তাঁর পাশে বসে রয়েছেন স্বামী আবুল ফজল। আশপাশে থাকা প্রতিবেশী ও স্বজনেরা তাঁদের সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন।
ছেলের কথা জিজ্ঞেস করতেই কেঁদে ওঠেন আবুল ফজল। জানান, তিনি পেশায় দিনমজুর। তবে বার্ধক্যজনিত নানা রোগে আক্রান্ত থাকায় এখন আর কাজ করতে পারেন না। সম্প্রতি দুই মাস হাসপাতালে থাকতে হয়েছে তাঁকে। এরপর গত সপ্তাহে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে ফিরেছেন। অসুস্থতার কারণে তিনি কাজ করতে না পারায় ছেলে জাকিরই তাঁদের চিকিৎসা, ওষুধসহ পরিবারের খরচ চালিয়ে আসছিলেন।
আবুল ফজল বলেন, ‘কয়েক দিন আগেও আমাকে নিয়ে হাসপাতালে ছোটাছুটি করেছে ছেলেটা। বিকালে বাজারে গিয়ে আমার জন্য ওষুধ আনার কথা ছিল তার। আমার ওষুধ আনা আর হয়নি। এভাবে ছেলেটা চলে যাবে, স্বপ্নেও ভাবিনি।’ তিনি বলেন, ‘আমি অসুস্থ শরীর নিয়ে বাড়ির উঠানে মাদুর পেতে শুয়ে ছিলাম। জাকিরের মা তখন গরু নিয়ে মাঠে। এর মধ্যে একজন দৌড়ে এসে জাকিরের মৃত্যুর কথা জানাইছে। আমি তখনই ছুটে গেছি। বাসের নিচে ছেলের লাশ দেখে সহ্য করতে পারছিলাম না। জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে গেছি। পরে আশপাশের মানুষ আমাকে ধরে ঘরে নিয়ে আসে।’
একটি পিকআপ ভ্যানকে অতিক্রম করার সময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বৈদ্যুতিক খুঁটিতে ধাক্কা দেয় মারছা পরিবহনের একটি বাস। এতে বাসটির সামনের অংশ দুমড়েমুচড়ে গেলেও যাত্রীদের কেউ হতাহত হননি। তবে নিচে যে জাকিরের লাশ চাপা পড়ে আছে, সেটি জানা যায় বাসটি উদ্ধারের পর। জাকির নিহত হওয়ার ঘটনাটি জানতে পেরে স্থানীয় জনতারা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।
জাকিরের মা আছমা খাতুন জানান, টিউশনি করে জমানো টাকা দিয়ে দুটি গরু কিনেছিল জাকির। গরু দুটি কোরবানির হাটে বিক্রি করে জীর্ণ বাড়িটি মেরামত করার ইচ্ছা ছিল তার। আছমা খাতুন বলেন, ‘দুপুরে ছেলে যখন বলল ভাত পরে খাবে, আমি গরু দুইটা নিয়ে মাঠে গেছি। ফিরে এসে শুনি আমার ছেলেটা বাসের নিচে চাপা পড়ছে। আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ছে তখন। আমি কী করব বুঝতে পারছিলাম না।’
স্থানীয় বাসিন্দারা জানায়, বেলা সোয়া একটার দিকে জাকিরের বাড়ির অদূরে একটি পিকআপ ভ্যানকে অতিক্রম করার সময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বৈদ্যুতিক খুঁটিতে ধাক্কা দেয় মারছা পরিবহনের একটি বাস। এতে বাসটির সামনের অংশ দুমড়েমুচড়ে গেলেও যাত্রীদের কেউ হতাহত হননি। তবে নিচে যে জাকিরের লাশ চাপা পড়ে আছে সেটি জানা যায় বাসটি উদ্ধারের পর। জাকির নিহত হওয়ার ঘটনাটি জানতে পেরে স্থানীয় জনতারা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। একপর্যায়ে তারা যান চলাচল বন্ধ করে দিয়ে জাকির নিহত হওয়ার ঘটনার বিচার এবং মহাসড়কটি চার লেন করার দাবিতে স্লোগান দিতে থাকে। এতে মহাসড়কের কয়েক কিলোমিটারজুড়ে দীর্ঘ যানজট দেখা দেয়। প্রায় ৪ ঘণ্টা পর স্থানীয় সাবেক সংসদ সদস্য ও জামায়াত নেতা শাহাজাহান চৌধুরী এবং চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আসহাব উদ্দিনের আশ্বাসে বিক্ষুব্ধ জনতা অবরোধ তুলে নেয়।
নিহত তরুণ মহাসড়কের পাশ দিয়ে মসজিদে যাচ্ছিলেন। এ সময় তাঁকে বাসটি চাপা দেয়। তাঁকে চাপা দেওয়ার ঘটনা স্থানীয় বাসিন্দাদের কারও চোখে পড়েনি। তবে চালক বিষয়টি জেনেও গোপন করায় মানুষ বেশি ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।মো. ইয়াছিন, প্যানেল চেয়ারম্যান, চুনতি ইউনিয়ন পরিষদ
চুনতি ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান মো. ইয়াছিন প্রথম আলোকে বলেন, নিহত তরুণ মহাসড়কের পাশ দিয়ে মসজিদে যাচ্ছিলেন। এ সময় তাঁকে বাসটি চাপা দেয়। তাঁকে চাপা দেওয়ার ঘটনা স্থানীয় বাসিন্দাদের কারও চোখে পড়েনি। তবে চালক বিষয়টি জেনেও গোপন করায় মানুষ বেশি ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।
দোহাজারী হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাহাবুব আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুর্ঘটনাকবলিত বাসটি আমাদের হেফাজতে আছে। তবে চালক পলাতক। এ ব্যাপারে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে।’ জাকিরের লাশ গতকাল রাত ১১টায় স্থানীয় কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।