প্রকাশ: ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

কমলনগর উপজেলায় নয়টি ইউনিয়নের ছয়টিই মেঘনা উপকূলবেষ্টিত। ঝড়-জলোচ্ছ্বাস আর নদীভাঙন এখানকার বাসিন্দাদের নিত্যসঙ্গী। দীর্ঘ পাঁচ দশক ধরে নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তারা। এরই মধ্যে মেঘনায় বিলীন হয়ে গেছে কমলনগর ও রামগতি উপজেলার এক-তৃতীয়াংশ এলাকা। শুধু কমলনগরেই ভূমিহীন হয়েছে অন্তত ৪০ হাজার পরিবার। ভাঙনের কবল থেকে উপজেলাবাসীকে রক্ষায় নদী তীরবর্তী টেকসই বাঁধ নির্মাণের দাবি স্থানীয়দের।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২০২১ সালের আগস্টে তিন হাজার ৮৯ কোটি টাকা ব্যয়ে কমলনগর ও রামগতি উপজেলায় ৩১ কিলোমিটার ‘তীর সংরক্ষণ বাঁধ’ প্রকল্পের দরপত্র আহ্বান করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। ৩৪টি প্যাকেজে ৯৭টি লটের আওতায় ১৬টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এ কাজ পায়। পাঁচ বছর সময়সীমার এ প্রকল্পটি চলতি বছরের ডিসেম্বর মাসে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত কাজ শেষ হয়েছে স্থানভেদে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ। কাজ পাওয়া চারটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান একবছর ধরে কাজ বন্ধ রেখে লাপাত্তা রয়েছে। এর মধ্যে মেসার্স এসএসইসিএল এর সাতটি লট ( প্রতি লট ২৫০-৩৫০ মিটার) কাজ করেছে ২-৩ ভাগ, এডব্লিউআরডিএল’র পাঁচটি লট কাজ করেছে দুই ভাগ, বিশ্বাস বিল্ডার্সের ছয়টি লট কাজ করেছে দুই ভাগ, ইলেক্ট্রো গ্রুপের একটি লট মাত্র পাঁচ ভাগ কাজ করে উধাও হয়ে গেছে। এছাড়া মেসার্স ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ১৫টি লট এবং ঠিকাদার সালেহ আহমেদের ১৭টি লটের কাজ চালু থাকলেও খুবই ধীরগতিতে চলছে বাঁধ নির্মাণ।
এতে অরক্ষিত হয়ে পড়েছে কমলনগরের বিস্তীর্ণ জনপদ। হুমকিতে রয়েছে উপজেলা শহরসহ চরফলকন, চরলরেন্স, চরমার্টিন, চরকালকিনি, পাটারীরহাট ও সাহেবেরহাট ইউনিয়ন। ইতোমধ্যে এসব ইউনিয়নের বেশ কিছু এলাকা নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। ঝড়-জলোচ্ছ্বাস কিংবা জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হচ্ছে উপকূলবেষ্টিত ছয়টি ইউনিয়ন। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাড়িঘর, রাস্তাঘাট ও ফসলি জমি। আর্থিকভাবে ক্ষতির মুখে পড়ছেন বাসিন্দারা। চরকালকিনি ইউনিয়নের বাসিন্দা আরিফ জানান, কিছুদিন আগে জোয়ারের পানি বেড়ে পুরো গ্রাম ডুবে যায়। অন্তত ৩০টি বসতঘরের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। তীররক্ষা বাঁধ না হওয়ায় প্রতিবছরই জোয়ারের পানি লোকালয়ে প্রবেশ করায় আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। একই এলাকার বাসিন্দা আবদুস ছালাম বলেন, বর্ষা এলেই আতঙ্কে থাকতে হয়।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের লক্ষ্মীপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী নাহিদ-উজ জামান খান বলেন, কাজে অনুপস্থিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কার্যাদেশ বাতিল করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ২০২২ সালের জুন মাসে শুরু হওয়া কাজটির মাধ্যমে ৩১ কিলোমিটার এলাকা ইতোমধ্যে নদীভাঙন থেকে রক্ষা পেয়েছে। বাঁধের পুরো কাজ সম্পন্ন করতে সময় বৃদ্ধি করা হবে। কমলনগর উপজেলা জেএসডির সাংগঠনিক সম্পাদক এবিএম বাবুল মুন্সীর মতে, নদীভাঙনের কবলে পড়ে এরই মধ্যে কমলনগর উপজেলার আয়তন কমে গেছে। ৩১ কিমি. তীররক্ষা বাঁধের প্রকল্পটি পাশ হওয়ার পর ভেবেছিলাম নতুন করে আর কোনো পরিবারকে তাদের ঘরবাড়ি হারাতে হবে না। এখন বাঁধের কাজের ধীরগতি দেখে মনে হচ্ছে, দুর্ভোগ যেন আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী হিসাবেই রয়ে গেল।
এদিকে তীররক্ষা বাঁধের কাজ সম্পন্ন না হওয়ায় জোয়ারের পানিতে ছয় ইউনিয়নের ৬০ শতাংশ গ্রামীণ কাঁচা-পাকা সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে দুর্ভোগ বেড়েছে শিক্ষার্থীসহ বাসিন্দাদের। চরকালকিনি ইউপি চেয়ারম্যান মাস্টার সাইফুল্লাহ জানান, নদীর তীরের পুরোনো ভোট অফিসটি গত বছর নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। অফিসটি বাঁচাতে নিজ খরচে একটি বিকল্প রাস্তা করেছিলেন। কিন্তু সেটিও নদীতে বিলীন হয়েছে।
কমলনগর উপজেলা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) প্রকৌশলী আব্দুল কাদের মোজাহিদ বলেন, ছয়টি ইউনিয়নই মেঘনা উপকূলীয় অঞ্চল। তাই জোয়ারের পানি ঢুকে পড়লে এমন অবস্থা সৃষ্টি হয়। আমরা ভেঙে যাওয়া সড়কগুলোর তালিকা তৈরি করেছি। বরাদ্দের অভাবে সংস্কার করা যাচ্ছে না। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা পরিতোষ কুমার সাহা বলেন, উপজেলায় প্রায় সাতশ কিলোমিটার গ্রামীণ সড়ক রয়েছে। এর মধ্যে মেঘনার অস্বাভাবিক জোয়ারের পানিতে ৩৫০ কিলোমিটার রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বরাদ্দ না থাকায় রাস্তাগুলো মেরামত করা যাচ্ছে না।
আরও পড়ুন