Advertisement

মা–বাবার সঙ্গে দুই ছেলের একসঙ্গে যাত্রা, একসঙ্গেই মৃত্যু

প্রথম আলো

প্রকাশ: ২৩ আগস্ট, ২০২৫

পরিবারের চার সদস্যকে হারিয়ে কান্না থামছে না স্বজনদের। শুক্রবার সন্ধ্যায় ময়নামতি হাইওয়ে থানা প্রাঙ্গণেছবি: প্রথম আলো
পরিবারের চার সদস্যকে হারিয়ে কান্না থামছে না স্বজনদের। শুক্রবার সন্ধ্যায় ময়নামতি হাইওয়ে থানা প্রাঙ্গণেছবি: প্রথম আলো

কুমিল্লার বরুড়া উপজেলার হোসেনপুর গ্রামের ওমর আলী (৮০) ও তাঁর স্ত্রী নুরজাহান বেগমের (৬৫) চার ছেলেমেয়ের সবাই ঢাকায় থাকেন। মাস দেড়েক আগে স্বামী-স্ত্রী ঢাকায় গিয়েছিলেন সন্তানদের কাছে। ঢাকায় বড় ছেলের বাসার ছাদে পড়ে গিয়ে ঊরুতে ব্যথা পান ওমর আলী। সন্তানদের বাসা আর হাসপাতাল মিলে প্রায় দেড় মাস তিনি চিকিৎসাধীন ছিলেন। একটু ভালো লাগতেই কয়েক দিন ধরেই দুই ছেলেকে বলছিলেন বাড়ি ফেরার কথা।

মা–বাবার পীড়াপীড়িতে বড় ছেলে আবুল হাসেম (৫০) নিজের ব্যক্তিগত গাড়িতে করেই রওনা হন বাড়িতে। সঙ্গী হন ছোট ছেলে আবুল কাশেমও (৪৫)। কিন্তু বাড়ির কাছাকাছি এসেও বাড়ি ফেরা হলো না তাঁদের। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে চারজনের।

শুক্রবার দুপুর সোয়া ১২টার দিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার পদুয়ার বাজার এলাকায় লরির নিচে প্রাইভেট কার চাপা পড়ে মারা যান মা–বাবা আর তাঁদের দুই ছেলে। একই লরির নিচে চাপা পড়ে একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক ও দুই যাত্রী গুরুতর আহত হয়েছেন।

নিহত ওমর আলীর বড় ছেলে আবুল হাসেম ওরফে স্বপনের বাসা রাজধানীর কল্যাণপুরে। নিজের ফ্ল্যাটেই থাকতেন স্ত্রী আর দুই সন্তানকে নিয়ে। ব্যাংক এশিয়ার রাজধানীর মিরপুরের রূপনগর শাখার ব্যবস্থাপক তিনি। আবুল হাসেম দুই সন্তানের জনক। বড় মেয়ে রাজধানীর ভিকারুননিসা স্কুল থেকে এবারের এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে। একমাত্র ছেলে সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী।

ছোট ছেলে আবুল কাশেম ওরফে মামুন রাজধানীর মানিকনগর এলাকায় নিজ ফ্ল্যাটে বসবাস করতেন স্ত্রী আর দুই সন্তানকে নিয়ে। তিনি এমএনজে নামক একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করতেন। আবুল কাশেমের বড় ছেলে শাহির আহমেদ ওরফে আয়ান ষষ্ঠ শ্রেণিতে আর ছোট ছেলে সাজিল আহমেদ ওরফে আবরান প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী।

ময়নামতি হাইওয়ে থানায় কথা হয় আবুল কাশেমের ছেলে শাহির আহমেদের সঙ্গে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে ১১ বছর বয়সী শাহির বলে, ‘আমার বাবাই ছিল আমাদের সব। বাবাকে ছাড়া কীভাবে থাকব।’

ওমর আলীর দুই মেয়েও ব্যাংকে চাকরি করেন। বড় মেয়ে হাসিনা আক্তার যমুনা ব্যাংকের ধোলাইখাল শাখায় কর্মরত। আর ছোট মেয়ে রোকসানা আক্তার ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের শ্যামলী শাখায় কর্মরত। মা–বাবা ও দুই ভাইকে হারানোর খবর পেয়েই শুক্রবার বিকেলে ময়নামতি হাইওয়ে থানায় ছুটে আসেন দুই বোন। এ সময় তাঁদের আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে সেখানকার পরিবেশ। আত্মীয়স্বজন তাঁদের সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু কোনো সান্ত্বনাতেই তাঁরা থামছিলেন না।

নিহত ওমর আলীর ছোট ভাই মহরম আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার বড় ভাইয়ের কত সুখী পরিবার। এমন ঘটনা আমরা কেমনে মেনে নেব!’

নিহত ওমর আলীর বড় মেয়ের স্বামী দেলোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বেলা দুইটার দিকে আমার স্ত্রীর ছোট বোন আমাকে কল দিয়ে বলে, “ভাইয়া আব্বু আম্মু আর ভাইদের খবর পাচ্ছি না। ভাইদেরকে ফোন করছি তারা কল ধরছে না। আর টিভিতে দেখাচ্ছে কুমিল্লায় চারজন মারা গেছে সড়ক দুর্ঘটনায়, আমাদের চারজনও তো একই গাড়িতে ছিল”। তাঁর এমন কথা শোনার পর আমি আবুল হাসেম ভাইয়ের মোবাইল নম্বরে অনেকবার কল করার পর পুলিশের একজন ধরেন। তিনি ঘটনার বিস্তারিত জানান। এরপর আমরা ময়নামতি হাইওয়ে থানায় ছুটে আসি।’

দুর্ঘটনার পর হাইওয়ে পুলিশের সদস্যরা মরদেহগুলো উদ্ধার করে ময়নামতি হাইওয়ে থানায় নিয়ে আসে। এদিন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে আইনি প্রক্রিয়া শেষে ময়নাতদন্ত ছাড়াই নিহতদের মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

ময়নামতি হাইওয়ে থানার উপপরিদর্শক আনিসুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা ময়নাতদন্ত করাতে চাননি। তাঁদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মরদেহ হস্তান্তর করা হয়েছে। তবে এ ঘটনায় মামলা হবে।

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে হাইওয়ে পুলিশের উপপরিদর্শক আনিসুর রহমান বলেন, ওই লরি ছিল ঢাকামুখী। পদুয়ার বাজার ইউটার্নে উল্টো পথে একটি প্রাইভেট কার, একটি বাস ও একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা হঠাৎ চলে এলে লরির চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। এ সময় তিনি ইউটার্নে লরির মুখ ঢাকামুখী লেন থেকে চট্টগ্রামমুখী লেনে নিয়ে গেলে লরি উল্টে যায়। এতে ওই প্রাইভেট কার লরির বডির নিচে চাপা পড়ে দুমড়েমুচড়ে যায়।

Lading . . .