বাবা ছুরি নিয়ে তাড়া করছিলেন মাকে, বাঁচাতে গিয়েছিলেন একমাত্র ছেলে
প্রকাশ: ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
বাবার হাতে খুন হয়েছেন তাঁর একমাত্র ছেলে মোহাম্মদ শাহেদ। চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার মায়ানি ইউনিয়নের বিষু মিয়া সড়কের ঘড়ি মার্কেট এলাকায় তাঁদের বাড়ির সামনে জড়ো হওয়া গ্রামবাসীর এখনো যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না ঘটনাটি। ছেলের লাশ আনতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে গেছেন শাহেদের মা কামরুজ্জাহান ও তাঁর দুই বোন। তাঁরা এসে পৌঁছালে জানাজা পড়ানো হবে। সে আয়োজনের জন্য অপেক্ষার ফাঁকে বিমর্ষ মানুষজন গত বুধবার রাতে ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে আলাপ করছিলেন। বাবার হাতে কীভাবে ছেলে খুন হতে পারে? এমন প্রশ্ন তুলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন তাঁদের কয়েকজন।
গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে শাহেদের বাড়িতে ঢোকার সময় চোখে পড়ে সবুজ ধানখেত আর টলটলে জলের পুকুর। তার পাশ ঘেঁষে ভিটায় তৈরি হচ্ছে সাত কক্ষের একটি পাকা দালান। নির্মাণাধীন সে ঘরের সামনে বসে শাহেদের লাশের জন্য অপেক্ষা করছেন স্বজন ও প্রতিবেশীরা।
স্বজনদের কাছ থেকে জানা গেল, ছোটবেলা থেকেই মেধাবী ছিলেন মোহাম্মদ শাহেদ। গ্রামের বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এসএসসি ও পাশের কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে চট্টগ্রামের ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনা করছিলেন তিনি। সপ্তম সেমিস্টারের ছাত্র ছিলেন। পড়াশোনার পাশাপাশি ফ্রিল্যান্সিং করে সংসারে সহযোগিতাও করতেন। মাকে কথা দিয়েছিলেন, আর কিছুদিন পর পড়াশোনার পাট চুকলেই চাকরিতে ঢুকবেন। মায়ের দায়িত্ব নেবেন। শাহেদের সে স্বপ্ন আর পূরণ হলো না। গত বুধবার সন্ধ্যায় বাবার ছুরিকাঘাতে নিজ বাড়িতে মৃত্যু হয় তাঁর। বাবার একমাত্র ছেলে শাহেদ ছিলেন সবার আদরের। বাবা নুরুজ্জামানের দুই মেয়ে ও এক ছেলের মধ্যে সবার ছোট ছিলেন তিনি। সাহেদকে হারিয়ে এখন পাগলপ্রায় তাঁর মা কামরুজ্জাহান।
মাকে বাঁচাতে গিয়েছিলেন
বুধবার রাত নয়টার দিকে মিরসরাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ছেলেকে নিয়ে আসা কামরুজ্জাহানের সঙ্গে দেখা হয়। হাসপাতালে আনার আগেই রক্তক্ষরণে মৃত্যু হয় তাঁর। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসকেরা কেবল আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছিলেন। শোক আর হতাশায় বিহ্বল শাহেদের মা কামরুজ্জাহান কোনোভাবেই মানতে পারছিলেন না। বারবার ছুটে যেতে চাইছিলেন ছেলের কাছে। দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন তিনি। চট্টগ্রাম নগরে এই ছেলেকে নিয়েই থাকতেন তিনি। ছেলেটিই ছিল তাঁর পৃথিবী। আজ সেই পৃথিবী যেন স্তব্ধ হয়ে গেল।
ও বাপ, আমারে কেন বাঁচাইতে গেলি রে বাপ। এমন পাষণ্ড কেউ কি আর পৃথিবীতে আছে, নিজের ছেলেরে কেউ খুন করতে পারে?কামরুজ্জাহান, নিহত শাহেদের মা
গতকাল শাহেদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, শাহেদের বাবা নুরুজ্জামান ১৫ বছর ধরে সৌদি আরবে বসবাস করেন চাকরির সূত্রে। তাঁর স্ত্রী কামরুজ্জাহান দুই মেয়ে আর ছেলেকে নিয়ে চট্টগ্রাম নগরে থাকতেন। এর মধ্যে দুই মেয়ের বিয়ে হয়েছে। গত ১১ আগস্ট ছোট মেয়ের বিয়ে হয়। সে বিয়ের অনুষ্ঠানে বন্ধুর স্ত্রী পরিচয়ে নুরুজ্জামান সিলেটের এক নারীকে মিরসরাইয়ের বাড়িতে নিয়ে আসেন। এ নিয়ে তখনো অশান্তি হয়েছে। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার ওই নারীকে বিয়ে করে দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে ঘরে তোলেন তিনি। বিষয়টি জানতে পেরে ছেলে–মেয়ে ও বোনদের নিয়ে মিরসরাইয়ে আসেন কামরুজ্জাহান। এর আগে নানাভাবে জীবননাশের হুমকি পেয়ে বুধবার বিকেলে মিরসরাই থানায় একটি সাধারণ ডায়েরিও করেন তাঁরা। বাড়িতে যাওয়ার পর সন্ধ্যা সাতটায় স্বামী নুরুজ্জামানের সঙ্গে তাঁর কথা-কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে স্বামী ছুরি নিয়ে তাড়া করলে শাহেদ এগিয়ে আসেন মাকে বাঁচাতে। আর তখন ক্ষুব্ধ বাবা ছেলের বুকে ছুরিকাঘাত করে বসেন।
বুধবার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বারান্দায় বিলাপ করছিলেন কামরুজ্জাহান। কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, ‘ও বাপ, আমারে কেন বাঁচাইতে গেলি রে বাপ। এমন পাষণ্ড কেউ কি আর পৃথিবীতে আছে, নিজের ছেলেরে কেউ খুন করতে পারে?’
শাহেদ হত্যা মামলার তদন্তের দায়িত্বে আছেন মিরসরাই থানার উপপরিদর্শক (এসআই) জাহিদুল ইসলাম। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মিরসরাইয়ে বাবার ছুরিকাঘাতে ছেলে শাহেদ হত্যার ঘটনায় বুধবার রাতে তাঁর মা কামরুজ্জাহান বাদী হয়ে শাহেদের বাবা নুরুজ্জাহান ও তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীকে আসামি করে থানায় একটি হত্যা মামলা করেছেন। আমরা আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চালাচ্ছি।’
শাহেদের চাচাতো ভাই ইমাম হোসেন জানাজা আর দাফনের প্রস্তুতির দেখভাল করছিলেন। রাতে লাশ এসে পৌঁছানোর কথা রয়েছে। এখন ময়নাতদন্তের জন্য অপেক্ষা। সেটা শেষ হলেই শাহেদকে আনা হবে। শান্তশিষ্ট ছেলেটা কত কষ্টই না পেল। এ কথা বলতে বলতে চোখ মোছেন ইমাম হোসেন।