ধানমন্ডির তেহারী ঘরে দিনে বিক্রি হতো দুই–আড়াই লাখ টাকার তেহারি
প্রকাশ: ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

দোকানের ওপর বড় সাইনবোর্ডে লেখা ‘তেহারী ঘর—এর কোনো শাখা নেই’। এই লেখার মাহাত্ম্য বুঝতে অবশ্য বিজ্ঞ হওয়ার দরকার নেই। তেহারী ঘর নামে ঢাকায় ঠিক কত শত খাবারের দোকান আছে, সেটা গুনে শেষ করাটা একটা চ্যালেঞ্জ। তবে সবগুলো আলাদা হয়েছে সামনে ব্যক্তির নাম, জায়গার নাম বা ‘নিউ’ শব্দটি বসে। আর শুধু ‘তেহারী ঘর’-এ খেতে চাইলে, যেতে হবে ধানমন্ডির ১৩ নম্বর। সহজ ঠিকানা, সোবহানবাগ অফিসার্স কোয়ার্টার ফটকের উল্টো দিকের রাস্তা।
এই তেহারি কেন সবার এত পছন্দ, যাচাই করতে দোকানটায় ঢুঁ মেরেছিলাম ৪ সেপ্টেম্বর। নাম তেহারী ঘর হলেও ভুনা খিচুড়ি ও মুরগির বিরিয়ানিও পাওয়া যায়। দাম ২০০ থেকে ৪০০ টাকা। অনেক রেস্তোরাঁয় অতিরিক্ত তেল, মসলাযুক্ত তেহারি খাওয়ার পর কেমন যেন অস্বস্তি লাগে। কিন্তু শর্ষের গন্ধমাখা গরুর মাংসের এই তেহারিটা খাওয়ার পর সেটা হয়নি। উল্টো আরেকবার খাওয়ার ইচ্ছা হলো। যথেষ্ট মাংসের সঙ্গে তেহারিতে মিলবে গোল আলু। আর মাখানো সালাদ। তাদের বোরহানিটাও বেশ ঘন আর সুস্বাদু।
১৯৮৭ সালে ছোট্ট একটা জায়গা নিয়ে চালু হয় তেহারি ঘর। তখন মালিক ছিলেন কাজী আখলাক আহমেদ। পরের বছর কর্মচারী হিসেবে যোগ দেন মো. ইকবাল হোসেন। চার বছর পর তিনিই বনে যান নতুন মালিক। কীভাবে এমনটা ঘটল, জানতে চাইলাম। ক্যাশে বসে ব্যস্ততার ফাঁকে ফাঁকে ইকবাল জানান, ১৯৯১ সালের দিকে বিদেশ চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকেন তাঁর মহাজন। তখন দোকান ভাড়া দেওয়ার চেষ্টা করা হয়; কিন্তু কিছুতেই ভাড়া হচ্ছিল না। ফলে তাঁকেই অস্থায়ীভাবে দায়িত্ব দেন। পরে ১৯৯২ সালে অগ্রিম টাকা পরিশোধ করে দোকান পরিচালনা শুরু করেন।
তেহারি ঘরের তেহারি কেন আলাদা? শর্ষের তেলে খাবারের স্বাদ ও গন্ধ কিছুটা আলাদা হয়, এটাই কি কারণ? নাকি বিশেষ কোনো পদ্ধতিতে তৈরি হয় খাবার? জনপ্রিয়তার রহস্য খোলাসা করলেন না ইকবাল। তিনি জানান, গ্রাহকেরা অন্য আট–দশটা জায়গার তেহারি থেকে তাঁদেরটাকে ব্যতিক্রমী মনে করেন। সে জন্যই খেতে আসেন। পাকের মধ্যে একটা ব্যাপার আছে। কিন্তু কীভাবে রান্না হয়, সেটা বলা যাবে না।
এই তেহারিতে ব্যবহৃত হয় হাড়ছাড়া মাংস, উন্নত মানের চিনিগুঁড়া চাল এবং সরাসরি মিল থেকে আনা শর্ষের তেল। বর্তমানে তিনজন বাবুর্চি প্রতিদিনের হেঁশেল সামলান। তবে তাঁরা মেনে চলেন প্রধান বাবুর্চির রেসিপি। ইকবাল জানালেন, তাঁদের সেই বাবুর্চির নাম ইকবাল হোসেন। তিনি অনেক রেসিপি ও মানের রান্না জানেন। নতুন বাবুর্চি নিয়োগ হলে তাঁর থেকেই প্রশিক্ষণ নিতে হয়। এ জন্যই শুরু থেকে স্বাদ একই রকম থেকেছে।
প্রশ্ন করলাম, আপনার এবং এই প্রধান বাবুর্চির নাম তো দেখি একই। বেশ তুখোড় গোয়েন্দার মতো মুখে রহস্যভেদী হাসি দিয়ে তিনি বললেন, ‘শুধু নাম না, মানুষটাও এক।’ অর্থাৎ এতক্ষণ যে চরিত্রের বর্ণনা দিয়েছেন, সেটা আসলে তিনি নিজেই। নিজের চেষ্টায় রান্না শিখেছেন।
ধানমন্ডি এলাকার অনেকের কাছেই তেহারি ঘর একটা নস্টালজিয়া। দোকানের বাইরেই একজনের সঙ্গে কথা হলো। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ব্যক্তি জানালেন, নব্বইয়ের দশকে বাবার হাত ধরে প্রথম এখানে খেতে এসেছিলেন। এখন বাবা ও সন্তানের জন্য তেহারি কেনেন মাসে দু-তিনবার। জাহাঙ্গীর নামে আরেক মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি বলেন, ‘কম বয়সকালে প্রায়ই খাইতাম। এখন মাঝেমধ্যে আসি।’
চালু হওয়ার অল্প সময়ের মধ্যেই জনপ্রিয়তা পায় তেহারি ঘর। তখন আশপাশে তেহারির আর কোনো দোকান ছিল না। সেই তুলনায় এখন আয়তন বেড়েছে। তবে এখনো দোকানটিকে খুব বড় বলা যাবে না। পাঁচ-ছয়টা টেবিলে গোটা বিশ-বাইশজন মানুষ বসে খেতে পারে। চাইলে কিনে নিয়ে বাসায় নিয়ে খেতে পারেন। আর ভরদুপুরে বসে খেতে চাইলে একটু সময় নিয়ে যেতে হবে।
২০১০-১১ সালের দিকে এখানে বসেই দিনে দুই-আড়াই লাখ টাকার তেহারি বিক্রি করেছেন ইকবাল। কিন্তু এখন আর সেই দিন নেই। প্রতিদিন বিক্রি হয় ৭০-৮০ হাজার টাকার খাবার। লাভও খুব বেশি হয় না। আক্ষেপ করে বলেন, ঢাকার মোড়ে মোড়ে এখন বিভিন্ন ধরনের তেহারির দোকান। এর মধ্যে নামেও অনেকগুলোর সঙ্গে মিল আছে। ফলে তাঁর দোকানের বেচাকেনা কমেছে।
বর্তমানে এক মণেরও বেশি চালের তেহারি রান্না হয় প্রতিদিন। মাংসও লাগে সমপরিমাণ। খাবার পাওয়া যায় সকাল দশটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত।