প্রকাশ: ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

‘আমি, তুমি-আমরা’-এভাবেই সাজানো হয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) নির্বাচনি ছক। ভোটার নিজেদের, প্রার্থী নিজেদের, নির্বাচন কমিশনও নিজেদের। সবকিছুই নিজের করে নিয়ে বিসিবির নির্বাচনে সভাপতি প্রার্থী হচ্ছেন বর্তমান সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল। বিসিবির নির্বাচনে তিনিই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার সরাসরি হস্তক্ষেপের অভিযোগ নিয়ে বিসিবির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ৬ অক্টোবর।
নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মুখোমুখি ক্রীড়া উপদেষ্টা গ্রুপ এবং ক্রিকেটার ও ক্রীড়া সংগঠকদের সমন্বয়ে গঠিত সম্মিলিত পরিষদ। অভিযোগ রয়েছে, বিসিবির বর্তমান সভাপতি আমিনুলকে সরাসরি মদদ দিচ্ছেন যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা। আমিনুলকে পাশে বসিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে সেটা ঘটা করেই জানান দিয়েছেন ক্রীড়া উপদেষ্টা। সম্মিলিত পরিষদের সামনের সারিতে রয়েছেন তারকা ক্রিকেটার তামিম ইকবাল। ঢাকার ক্লাবগুলোর সমর্থনে তামিম কাউন্সিলর হয়েছেন ওল্ডডিওএইচএস থেকে। আমিনুল কাউন্সিলর হয়েছেন ঢাকা জেলা ক্রীড়া সংস্থার। বিসিবির নির্বাচন পরিচালনার জন্য যে কমিশন গঠন করা হয়েছে সেখানেও সরকারি কর্মকর্তাদের আধিক্য রয়েছে। বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ পহাসেনকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার করে গঠিত তিন সদস্যের কমিশনের অন্যরা হলেন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অতিরিক্ত আইজিপি সিবগাত উল্লাহ এবং জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের নির্বাহী পরিচালক যুগ্ম সচিব কাজী নজরুল ইসলাম।
বিসিবির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অন্ধকারের রাজনীতির সঙ্গে হুমকি-ধমকি এবং ক্রীড়া উপদেষ্টার সরাসরি হস্তক্ষেপ নতুন বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। উত্তেজনার পারদ এখন তুঙ্গে। পদ-পদবির লোভে নানা পক্ষ বিভিন্ন জায়গায় ধরনা দিচ্ছেন। মন্ত্রীপাড়ায় দৌড়ঝাঁপ চলছে। গুলশান-বনানীর অভিজাত হোটেলগুলোও এখন লোকে লোকারণ্য। প্রশ্ন উঠছে বিসিবির নির্বাচনে সরকারের সরাসরি হস্তক্ষেপ নতুন কোনো বিপদে ফেলবে কিনা বাংলাদেশকে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের (আইসিসি) নির্দেশনা অনুযায়ী সদস্য দেশগুলোর বোর্ডে সরাসরি সরকার হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। কিন্তু সরকারের হস্তক্ষেপ হওয়ায় এর আগে জিম্বাবুয়ে, শ্রীলংকা, নেপালকে সাময়িক নিষিদ্ধ করেছিল আইসিসি। বাংলাদেশও সেদিকে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা করছেন ক্রিকেট বিশেষজ্ঞরা। আইসিসির ২.৪.৩ ধারায় বলা আছে, নিজেদের ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালনা এবং নির্বাচন প্রক্রিয়া সরকারের হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত থাকবে।
বাংলাদেশ জেলা ও বিভাগীয় ক্রীড়া সংগঠক অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক শরীফুল আলম অভিযোগ করে বলেন, ‘আমিনুল ইসলাম বুলবুল যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের মনোনীত সভাপতি প্রার্থী। আমিনুলের নির্বাচনে ভরাডুবির আশঙ্কায় হেন কোনো অসৎ উপায় নেই যা করছে না ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের বিশেষ সহকারী মো. সাইফুল ইসলাম মনোনীত ব্যক্তিদের নিয়ে জেলা ক্রীড়া সংস্থার অ্যাডহক কমিটি গঠন করেছেন।’ তার কথা, ‘৯০ দিনের জন্য গঠিত অ্যাডহক কমিটির দৈনন্দিন কাজ ও নির্বাচন আয়োজন ছাড়া অন্য কোনো কাজ নেই। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় বিসিবি নির্বাচনে অযাচিত হস্তক্ষেপ করছে, যা মোটেই কাম্য নয়।’ কাউন্সিলর নির্ধারণে বিসিবির গঠনতন্ত্রের ৯.১ অনুচ্ছেদের ক-উপধারায় বলা হয়েছে, প্রতিটি আঞ্চলিক ক্রিকেট সংস্থা হতে সাবেক ক্রিকেট খেলোয়াড়/ক্রিকেট সংগঠককে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিসিবির কাউন্সিলর হিসাবে ওই আঞ্চলিক ক্রিকেট সংস্থার সভাপতি অথবা ক্ষেত্র বিশেষে ওই বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার সভাপতি মনোনীত করবেন। এই ধারায় নির্বাচনের ক্ষেত্রে ‘অ্যাডহক কমিটি’ শব্দই নেই। নির্বাচন নিয়ে সভাপতি প্রার্থী তামিম ইকবাল বলেন, ‘আমরা চাই সুষ্ঠু নির্বাচন। অথচ সব জায়গায় সরকার হস্তক্ষেপ করছে। এই সমস্যার সমাধান না করলে বিসিবির নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হবে। এ ধরনের একপেশে নির্বাচন ক্রিকেটের জন্য মঙ্গলকর হবে না। এরকম চলতে থাকলে আইনি পদক্ষেপসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। প্রয়োজনে আইসিসিকেও জানানো হবে।’
বিসিবির নির্বাচনে হস্তক্ষেপ শুরু হয়েছে প্রথম থেকেই। আগের সভাপতি ফারুক আহমেদকে সরিয়ে ক্রীড়া উপদেষ্টা ন্যক্কারজনকভাবে রাতের আঁধারে আমিনুলকে বসিয়ে দেন। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কার্যনির্বাহী কমিটির সভা ছাড়াই আমিনুলকে বিসিবির পরিচালক পদে মনোনয়ন দেওয়া হয়। আমিনুল মসনদে বসেই ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি টি ২০ ইনিংস খেলতে এসেছেন। দীর্ঘমেয়াদে থাকবেন না, নির্বাচনও করবেন না। কিন্তু ক্ষমতা পেয়েই দুই মাসের ব্যবধানে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে যান আমিনুল। ক্রীড়া উপদেষ্টার প্রত্যক্ষ মদদে দেশের জেলা ও বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থা থেকে নিজের মনমতো ব্যক্তিদের কাউন্সিলর বানিয়ে আনছেন আমিনুল। যাদের অনেকেই জানেন না কয় বলে এক ওভার হয়! সভাপতি পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে আবার ফারুক আহমেদকে স্বার্থের কারণে এখন ক্রীড়া উপদেষ্টা কাছে টানছেন। কয়েক দফা বৈঠকও করেছেন ফারুকের সঙ্গে।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মাধ্যমে প্রজ্ঞাপন জারি করে জেলা ও বিভাগীয় প্রশাসকের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার বাইরে যাতে কাউকে কাউন্সিলর করা না হয়। ১১ সেপ্টেম্বর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের উপসচিব মু. মাহমুদ উল্লাহ মারুফ স্বাক্ষরিত দেশের সব জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনারের কাছে পাঠানো চিঠিতে (স্মারক নং-০৪.০০.০০০০.০০০.৫১২.১৮.০০০২.২১.৩১৫.) এভাবেই নির্দেশনা দেওয়া হয়। তারপরও জেলা প্রশাসকরা গঠনতন্ত্র মেনে অনেক যোগ্য ব্যক্তিকে কাউন্সিলর করে বিসিবিতে পাঠিয়েছিলেন। সেগুলো আবার ফেরত পাঠিয়েছেন সভাপতি আমিনুল। স্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন, অ্যাডহক কমিটির বাইরে কাউকে কাউন্সিলর করা যাবে না। অথচ অ্যাডহক কমিটিতে ছিলেন না তিনি নিজেও।
রীতি অনুযায়ী কাউন্সিলর চেয়ে চিঠিতে স্বাক্ষর করেন মূলত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও)। ২ সেপ্টেম্বর বিভিন্ন জেলা ক্রীড়া সংস্থার কাছে পাঠানো চিঠিতে স্বাক্ষর করেছিলেন সিইও। ওই চিঠিতে ১৭ সেপ্টেম্বর ছিল কাউন্সিলর মনোনয়নের শেষদিন। ১৮ সেপ্টেম্বর যুব ও ক্রীড়া সচিবকে চিঠি দেন সভাপতি আমিনুল। ওই চিঠিতে (সূত্র নং-বিসিবি/প্রশাসন/২০২৫/৬৬২ (ক) বলা হয়-যেসব বিভাগ ও জেলা ক্রীড়া সংস্থা কাউন্সিলর মনোনয়ন ফরম ২০২৫ পূরণে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ গঠিত বিভাগীয় জেলা ক্রীড়া সংস্থা অ্যাডহক কমিটির সদস্যদের মধ্যে থেকে পাঠানোর যে বাধ্যবাধকতা রয়েছে তা যথাযথভাবে অনুসরণ করেননি তাদের ফরম বাতিল করে নতুন ফরম পাঠানো হয়েছে। আমিনুলের চিঠি ক্রীড়াঙ্গনে নতুন করে বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ হোসেন বলেন, ‘আমাদের কাছে বিসিবি যে কাউন্সিলর তালিকা ও গঠনতন্ত্র দেবে তার ওপর ভিত্তি করে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। গঠনতন্ত্র অনুসারে সব কিছু করা হবে।’ বিসিবির নির্বাচন নিয়ে আমিনুল কোনো কথা বলতে রাজি হননি। বিস্তারিত জানার জন্য বারবার ফোন দিলেও তিনি ফোন ধরেননি। জামালপুর জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল ফুয়াদ রেদোয়ানকে প্রথমে কাউন্সিলর হিসাবে পাঠানো হয়েছিল। পরে আমিনুলের চিঠির প্রেক্ষিতে রেদোয়ানের নাম বাদ দেওয়া হয়।
এদিকে অভিযোগ নিয়ে আসিফ মাহমুদ বলেন, ‘অন্যবার আওয়ামী লীগের জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদকরা জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক হতেন। তারাই ঠিক করত কে কাউন্সিলর হবে। আমরা সেই ধারা ভাঙতে চেয়েছি। ক্রীড়াঙ্গনে রাজনীতিকরণের বিরোধী আমরা।’ তিনি বলেন, ‘কাউন্সিলর যেন সঠিকভাবে নির্ধারণ হয় এজন্য বিসিবি ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা চেয়েছে। আমরা বিসিবির চিঠির প্রেক্ষিতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে সহায়তা দেওয়ার অনুরোধ করেছি মাত্র। অ্যাডহক কমিটির সদস্যরা সংশ্লিষ্ট জেলা ক্রীড়া সংস্থার নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। কিন্তু তারা অন্য ফেডারেশনের কাউন্সিলর হতে পারবেন। এ ব্যাপারে গঠনতন্ত্রে কোনো বাধা নেই।’
আরও পড়ুন