প্রকাশ: ১১ আগস্ট, ২০২৫

দিন-রাতে অহরহ চুরি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, ডাকাতি, খুন ও দেদার মাদক বেচাকেনাসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে আগে থেকেই অতিষ্ঠ রাজধানীর অদূরের শিল্প অধ্যুষিত জনপদ গাজীপুরের সাধারণ মানুষ। এবার তাদের জন্য নতুন আরেক আতঙ্ক হিসেবে দেখা দিয়েছে হানিট্র্যাপ (যৌনতা বা শারীরিক সম্পর্কের প্রলোভন দেখিয়ে ফাঁদে ফেলে প্রতারণা বা ছিনতাই)। যেসব চক্রে রয়েছে কয়েক ডজন নারীও। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের টার্গেট (লক্ষ্য) পুরুষ পথচারী। টার্গেট করা ব্যক্তিকে চক্রের অন্য সদস্যদের সহযোগিতায় ধাপে ধাপে ফাঁদে ফেলে একপর্যায়ে জিম্মি করে সর্বস্ব লুটে নেয় এসব চক্র। নগরীর ব্যস্ততম চান্দনা চৌরাস্তায় দিনে-রাতে সবসময়ই সক্রিয় থাকে এমন বেশ কয়েকটি গ্রুপ। সম্প্রতি এমনই এক ঘটনা কেন্দ্র করে প্রকাশ্যে সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিনকে কুপিয়ে হত্যার পর নতুন করে আলোচনায় এসেছে এ হানিট্র্যাপ গ্রুপ।
হানিট্র্যাপের মাধ্যমে ছিনতাই করত কেটু মিজান ও তার স্ত্রী পারুল আক্তার ওরফে গোলাপী এবং তাদের চক্রের সদস্যরা। হানিট্র্যাপের মাধ্যমে ছিনতাইয়ের এ চক্রটির হোতা কেটু মিজান। গ্রেপ্তারের পরও তার ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ থেমে থাকেনি। পুলিশের কড়া পাহারা ও পিছমোড়া করে হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে গত শনিবার আদালতে নেওয়ার সময় মিজান সেখানে উপস্থিত সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলে ওঠেন, ‘আপনারা নাটক-সিনেমা-ছবি করেন, আমি করি রিয়েল।’ সাংবাদিক তুহিনকে কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যার এ ঘটনা দেশজুড়ে আলোড়ন তৈরি করলেও পুলিশের হাতে গ্রেপ্তারের পর তার মধ্যে বিন্দুমাত্র অনুশোচনা বা ভীতির ছায়া দেখা যায়নি। বরং আদালতে নিয়ে যাওয়ার সময়ও চোখ পাকিয়ে সাংবাদিকদের দেখে নেওয়ার হুমকি দেন।
জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার মাহমুদপুর ইউনিয়নের সিঁড়িঘাট মিলন বাজার এলাকার মোবারক হোসেনের ছেলে কেটু মিজান গাজীপুরে এসে গড়ে তোলেন এক ‘অপরাধ সাম্রাজ্য’। মেলান্দহ থেকে ২৫-৩০ বছর আগে তার পরিবার চলে যায় রংপুর। পরবর্তী সময়ে একই এলাকার মো. সুলাইমানের মেয়ে পারুল আক্তার গোলাপীকে বিয়ে করে সঙ্গে নিয়ে মিজান চলে আসে গাজীপুর। তার গড়ে তোলা অপরাধ জগতের সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিল নিজেরই স্ত্রী গোলাপী। দুজনে মিলে গাজীপুর মহানগরের ব্যস্ততম চান্দনা চৌরাস্তা মোড় এলাকায় নিয়ন্ত্রণ করত ছিনতাইকারী চক্র। কেটু মিজান ও গোলাপী গ্রুপের সদস্য সাংবাদিক তুহিন হত্যায় সরাসরি অংশ নেওয়া পাবনার ফরিদপুর উপজেলার সোনাহারা গ্রামের নূর মোহাম্মদের ছেলে মো. স্বাধীন (২৮), খুলনার সোনাডাঙ্গা উপজেলার ময়লাপোতা এলাকার হানিফের ছেলে আল আমিন (২১), কুমিল্লার হোমনা থানার আন্তপুর গ্রামের হানিফ ভূঁইয়ার ছেলে শাহ জালাল (৩২), পাবনার চাটমোহর থানার পাঁচবাড়িয়া গ্রামের কিয়ামুদ্দিনের ছেলে ফয়সাল হাসান (২৩), শেরপুরের নকলা থানার চিতলিয়া গ্রামের আব্দুস সালামের ছেলে সাব্বির সুমন (২৬) এবং ত্রিশালের শহীদুল ইসলাম। এরই মধ্যে এ আটজনকেই গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
তাদের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন থানায় হত্যা, ধর্ষণ, মাদক, ছিনতাইসহ বিভিন্ন ধারায় ২৯টি মামলা রয়েছে। শুধু মিজানের বিরুদ্ধেই বিভিন্ন থানায় ১৫টি মামলা রয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। গত বৃহস্পতিবার রাতে কেটু মিজান ও গোলাপীর প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়েছিলেন শেরপুরের বাদশা মিয়া নামে এক যুবক। যার শেষ পরিণতির শিকার হন দৈনিক প্রতিদিনের কাগজের স্টাফ রিপোর্টার আসাদুজ্জামান তুহিন।
চান্দনা চৌরাস্তায় কয়েকজন দোকানি ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চান্দনা চৌরাস্তার সাবেক বাসন ইউনিয়ন পরিষদের পরিত্যক্ত কার্যালয়ের সামনে, জাগ্রত চৌরঙ্গীর আশপাশে ও বিভিন্ন গলিতে সন্ধ্যার পর থেকে অবস্থান নেয় হানিট্র্যাপ চক্রের সদস্যরা। সময় সুযোগ বুঝে তারা টার্গেট করে বিভিন্ন জেলা থেকে আগত সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে পথচারীদের হানিট্র্যাপে ফেলে সবকিছু লুটে নেয় তারা।
স্থানীয়রা জানান, দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে এসে নানা কাজে চান্দনা চৌরাস্তা হয়ে প্রতিদিন অন্তত ৪ লাখ মানুষ যাতায়াত করে। তাদের মধ্যে থাকেন দূরদূরান্ত থেকে আসা বহু নারী-পুরুষও। এ ছাড়া গাজীপুরের বিভিন্ন কলকারখানার শ্রমিক-কর্মচারীরাও যাতায়াত করেন চান্দনা চৌরাস্তা হয়ে। দিনের বেলা টানা পার্টি (পথচারী বা যানবাহনে থাকা যাত্রীদের ব্যাগ অথবা মোবাইল ফোন টান দিয়ে ছিনিয়ে দৌড়ে পালানো) তাদের টার্গেট করে। ঢাকা মহাসড়ক, টাঙ্গাইল মহাসড়ক, ময়মনসিংহ মহাসড়ক ও গাজীপুর অভিমুখী মহাসড়কে অবস্থান নিয়ে টানা পার্টির সদস্যরা ভ্যানিটি ব্যাগ, পার্স, মানিব্যাগ, কানের দুল, গলার চেইন ইত্যাদি নিয়ে ভিড়ের মধ্যে মিশে যায়। তবে তাদের প্রধান টার্গেট থাকে মোবাইল ফোন। হেঁটে ফোনে কথা বলতে বলতে চলার সময় বা বাসে বসে ফোনে কথা বলার সময় জানালা দিয়ে মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিয়ে যায় এসব চক্রের সদস্য। প্রতিদিনই এ ধরনের অহরহ ঘটনা ঘটছে। তবে আইনি জটিলতাসহ নানা কারণে ভুক্তভোগীদের অনেকেই পুলিশের কাছে অভিযোগ করেন না।
কালবেলার অনুসন্ধানে জানা যায়, হানিট্র্যাপ চক্রে যুক্ত রয়েছে কয়েক ডজন তরুণী। কারও কাছে টাকা বা মূল্যবান কিছু থাকলে তারা টার্গেট করে। টার্গেট করা ব্যক্তিকে এসব তরুণীকে দিয়ে ফাঁদে ফেলে মারধর করে মানিব্যাগসহ সঙ্গে থাকা মূল্যবান জিনিসপত্র কেড়ে নেওয়া হয়।
বাসন থানা সূত্রে জানা গেছে, গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রাতে নগরীর তেলিপাড়ায় বাবার লাশ অ্যাম্বুলেন্সে করে বাড়ি ফিরছিলেন দুই যুবক। চান্দনা চৌরাস্তায় পৌঁছলে ছিনতাইকারীরা গাড়ি থামিয়ে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সটির যাত্রীদের টাকাপয়সা ছিনিয়ে নেয়। পরে এ ঘটনায় গ্রেপ্তার হয় ফয়সাল নামে একজন। সে পাবনার চাটমোহরের কিয়ামুদ্দিনের ছেলে। তার কয়েকদিন আগে ২১ ফেব্রুয়ারি বাবার মৃত্যুর খবর পেয়ে দিনাজপুর যাওয়ার পথে চান্দনা চৌরাস্তায় ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ে একটি পরিবার। লাশ দেখতে যাওয়ার কথা বলেও রক্ষা পাননি তারা। অবশ্য এ ভুক্তভোগীরা পরে পুলিশের সহযোগিতায় অন্য একটি গাড়িতে গন্তব্যে রওনা হন।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, দিন দিন ছিনতাইকারীদের যেন স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে চান্দনা চৌরাস্তা। এসব ছিনতাইকারীর অনেকেই প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ায়। পুলিশ মাঝেমধ্যে তাদের গ্রেপ্তার করে। তবে কয়েকদিনের মধ্যেই জামিনে বেরিয়ে এসে ফের ছিনতাইয়ে জড়ায় তারা। সাংবাদিক তুহিন খুনের দিন সন্ধ্যায়ও এমনই একটি চক্রের সদস্যরা এক চালককে পিটিয়ে তার অটোরিকশা ছিনিয়ে নেয়। এসব অপরাধ চক্রের সদস্যরা মাদকের ঘোরে থাকায় সামান্য বাধা দিলেই কুপিয়ে সব লুটে নেয়। ছিনতাইয়ে বাধা দেওয়ায় গত বছর চান্দনা চৌরাস্তার বনরূপা সড়কে তানজিলা আক্তার (৩৮) নামে এক পোশাক শ্রমিককে ছুরিকাঘাতে খুন করে ছিনতাইকারীরা।
গাজীপুর মহানগর পুলিশের এক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, ‘ছিনতাইয়ের ঘটনায় বেশিরভাগ পথচারী বা ভুক্তভোগী থানায় অভিযোগ করেন না। এজন্য অনেক সময় বিষয়টি সম্পর্কে পুলিশ অবগত থাকে না।’
এ প্রসঙ্গে গাজীপুর মহানগর পুলিশের উপকমিশনার রবিউল হাসান বলেন, ‘চান্দনা চৌরাস্তায় আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আগেও ছিল। সাংবাদিক তুহিন হত্যাকাণ্ডের পর তা আরও জোরদার করা হয়েছে। ব্যবসায়ীদের সিসিটিভি ক্যামেরা লাগাতে বলা হয়েছে, যাতে অপরাধীরা পালিয়ে গেলেও তাদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা যায়। এ ছাড়া সেখানে সার্বক্ষণিক একটি নিরাপত্তা টিমের পাশাপাশি কুইক রেসপন্স টিম থাকবে। এর পাশাপাশি ছিনতাইকারীসহ অপরাধীদের গ্রেপ্তারে সাঁড়াশি অভিযান অব্যাহত রয়েছে।’
আরও পড়ুন