Advertisement

বন্দরের কদম রসুল দরগা শরিফ

যুগান্তর

প্রকাশ: ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

24obnd

মোগল আমলের দৃষ্টিনন্দন এক স্থাপনার নাম নারায়ণগঞ্জের কদম রসুল দরগা শরিফ। শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্বপার বন্দর উপজেলার নবীগঞ্জে আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পদচিহ্ন (কদম মোবারক) ঘিরে মাজার শরিফটি গড়ে ওঠে। এখানে রয়েছে প্রিয় নবী (সা.)-এর ডান পায়ের চিহ্ন। প্রতিদিন মুসলমানসহ বিভিন্ন ধর্মের শত শত মানুষ ভিড় জমান এই পদচিহ্ন দেখার জন্য। শ্রদ্ধাভক্তি জানিয়ে মানত করেন, যেন মনের বাসনা পূরণ হয়। মোগল আমলেই এই দরগার নামে ৮০ বিঘা জমি দান করা হয়। কিন্তু সেই জমির অর্ধেকের বেশি বেদখল হয়ে গেছে। সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে বাড়িঘর, দোকানপাটসহ নানা স্থাপনা।

সম্রাট আকবরের সময় ঈশা খাঁ ছিলেন সোনারগাঁ পরগনার শাসক। তিনি আকবরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং আফগান সেনাপতি মাসুম খান কাবুলীর নেতৃত্বে বিশাল সৈন্যবাহিনী গড়ে তোলেন। ঈশা খাঁর বিদ্রোহ দমন করতে সম্রাট আকবর তার বিশ্বস্ত সেনাপতি মানসিংহকে পূর্ব বঙ্গদেশে পাঠান। মানসিংহের সঙ্গে যুদ্ধের সম্ভাবনা দেখা দিলে ঈশা খাঁ সোনারগাঁ থেকে তার সেনাবহর নিয়ে নদীপথে বর্তমান সোনাকান্দা কেল্লার উদ্দেশে রওয়ানা হন। পথে নদীর তীরবর্তী গভীর জঙ্গলে আলো দেখতে পেয়ে সেনাদের একাংশ নিয়ে সেখানে প্রবেশ করেন। এরপর দেখতে পান একজন সাধক সৈয়দ হাজী নুর মোহাম্মদ (র.)কে। পাশেই তার স্ত্রী একটি পায়ের ছাপখচিত কষ্টিপাথর মাথায় নিয়ে বসে আছেন। ঈশা খাঁ ওই সাধকের কাছে পাথর খণ্ড সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি (সাধক) বলেন, ‘এটি মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পবিত্র পদচিহ্ন। পাথর খণ্ডটি আমি ও আমার স্ত্রী পালাক্রমে মাথায় রাখি; যাতে পদচিহ্ন বা কদম মোবারক অবমাননা না হয়।’ এই কথা শোনার পর ঈশা খাঁ শ্রদ্ধা ভক্তি নিয়ে মানসিংহের সঙ্গে যুদ্ধ জয়ের জন্য পবিত্র পদচিহ্নের (কদম মোবারক) দোয়া কামনা করেন। এ সময় সাধক (নুর মোহাম্মদ) ঈশা খাঁকে বলেন, ‘আপনি ওয়াদা ও মানত করেন যুদ্ধে জয়লাভ করলে পদচিহ্নটি (কদম মোবারক) উঁচু ও উপযুক্ত স্থানে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করবেন।’ সাধকের কথামতো ঈশা খাঁ মানত করেন এবং অলৌকিকভাবে ওই যুদ্ধে জয়লাভ করেন। সেই যুদ্ধে আকবরের প্রধান সেনাপতি মানসিংহের তরবারি ভেঙে যায়।

যুদ্ধে জয়লাভের পর ঈশা খাঁ মানত অনুযায়ী তার সেনাপতি মাসুম খান কাবুলীকে একটি উঁচু স্থানে পবিত্র পদচিহ্নটি (কদম মোবারকটি) সংরক্ষণের নির্দেশ দেন। নির্দেশ পেয়ে মাসুম কাবুলী নবীগঞ্জ এলাকায় প্রায় ৬০ ফুট উঁচু মাটির টিলা এবং একটি সুন্দর ঘর তৈরি করে পদচিহ্ন (কদম মোবারক) সংরক্ষণ করেন। আর পাথরের ওপর লিপিবদ্ধ করেন রাসুল (সা.)কে উদ্দেশে করে সৃষ্টিকর্তার বিখ্যাত বাণী- ‘আমি তোমাকে সৃষ্টি না করলে এই পৃথিবী সৃষ্টি করতাম না।’

হাজী নুর মোহাম্মদ ওয়াকফ এস্টেট (আল আওলাদ) মোতোয়ালি কমিটি কর্তৃক সম্পাদিত কদম রসুলের ইতিহাস বইতে বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, সম্রাট শাহজাহান তৎকালীন জাহাঙ্গীর নগর (ঢাকা) পরিদর্শনে আসেন। সে সময় তিনি খালি পায়ে ৬০ ফুট উঁচু টিলায় উঠে পদচিহ্ন বা কদম মোবারকে ভক্তি প্রদর্শন করেন। সেই থেকে অদ্যাবধি কমদ রসুল দরগায় খালি পায়ে উঠার রেওয়াজ চালু আছে। সম্রাটা শাহজাহান দিল্লির সিংহাসনে আরোহণের পর পুত্র শাহ সুজাকে বাংলার সুবেদার নিযুক্ত করেন। শাহ সুজা বাবার মানত অনুযায়ী দরগা শরীফ রক্ষণাবেক্ষণে খাদেম সৈয়দ হাজী নুর মোহাম্মদ (র.)-এর নামে দুই সনদে ৬০ বিঘা ও ২০ বিঘা মিলে মোট ৮০ বিঘা জমি দান করেন। ফার্সি ভাষায় লিখিত ওই দলিলে শাহ সুজার দস্তখত ও সিলমোহর রয়েছে; যা ঢাকা কলেকটরেট মোহাফেজ খানায় সংরক্ষিত আছে।

কদম রসুল দরগায় প্রবেশ পথে উঁচু বিশাল একটি তোরণ (গেট) রয়েছে। চমৎকার কারুকাজ করা এই স্থাপনা দূর থেকে দেখেই মনে হবে একটি সুন্দর মসজিদ বা দরগা। আসলে এটি একটি প্রবেশ তোরণ। এটি পার হয়ে ভেতরে ঢুকতেই উত্তর দিকে চোখে পড়বে একটি মসজিদ। আর দক্ষিণ দিকে রয়েছে একটি মাজার (কবরস্থান)। এই দুইয়ের মাঝে আছে সাদা শ্বেতপাথরের এক গম্বুজবিশিষ্ট ভবন। এখানেই সংরক্ষিত আছে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কদম মোবারকের ছাপ সংবলিত পাথরটি। বড়সড় খড়ম আকৃতির কালো পাথর এটি। আগে সব সময় দেখানো হতো। কিন্তু এখন নির্দিষ্ট কিছু দিনেই কাচের বাক্স থেকে এটি বের করা হয়। পাথরটি গোলাপজল মিশ্রিত পানির মধ্যে চুবিয়ে রাখা হয়েছে। দর্শনার্থীরা চাইলে গ্লাসে করে সেই পানি পান করতে দেওয়া হয়। কবরস্থানের ভেতরে রয়েছে বিশাল বড় কাঠ গোলাপের গাছ। অবশ্য সত্যিই এটি মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কদম মোবারকের ছাপ কিনা- সেটা নিয়ে রয়েছে মতভেদ।

কথিত আছে, মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) মেরাজের রাতে বোরাকে উঠার সময় বেশকিছু পাথরে তার পায়ের ছাপ পড়ে। এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত পাথরটি আছে জেরুজালেমে। এছাড়া আরও কিছু পাথর রয়েছে ইস্তাম্বুল, কায়রো, দামেস্ক ও দিল্লিতে। বাংলাদেশেও এমন দুটি পাথর রয়েছে- যার একটি আছে চট্টগ্রামে। অপরটি নবীগঞ্জ কদম রসুল দরগায়।

এদিকে মির্জা নাথান ১৭শ শতকে রচিত তার বিখ্যাত ‘বাহির-স্থানই গায়েবী’ বইয়ে নবীগঞ্জের পাথরটির কথা উল্লেখ করেছেন। এতে তিনি লেখেন, ১৫৮০ সালে সম্রাট আকবরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণাকারী আফগান সেনাপ্রধান মাসুম খান কাবুলি মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পদচিহ্ন সংবলিত পাথরটি এক আরব বণিকের কাছ থেকে কিনেছিলেন। তার অনেক পরে ঢাকার জমিদার গোলাম নবী ১৭৭৭-১৭৭৮ সালে নবীগঞ্জের একটি উঁচু স্থানে একটি এক গম্বুজবিশিষ্ট দরগা নির্মাণ করে সেখানে পাথরটি স্থাপন করেন। পরে কদম রসুল দরগার প্রধান ফটকটি গোলাম নবীর ছেলে গোলাম মুহাম্মদ ১৮১৪ সালে নির্মাণ করেন।

দরগা শরীফের খাদেম লোকমান হোসেন রানা জানান, শাহসুজা ফার্সি ভাষায় সৈয়দ হাজী নুর মোহাম্মদ ওয়াকফ এস্টেট (আল আওলাদ) লিখে দিলেও বর্তমানে দরগার অর্ধেকের বেশি জমি প্রভাবশালীরা দখল করে নিয়ে গেছে। প্রশাসন জমি উদ্ধারের ব্যাপারে তেমন কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না। দরগার সামনে নদীর তীরবর্তী মাঠটি ছিল দরগার সম্পত্তি। ওই জায়গা থেকে খাজনা তুলত দরগা কর্তৃপক্ষ। কিন্তু কালের বিবর্ততে ওই মাঠসহ বিপুল জায়গা বেদখল হয়ে গেছে।

Lading . . .