Advertisement

বাড়ি ও অফিসের নিরাপত্তায় ১০ লাখ কর্মীর হাজার কোটি টাকার সেবা

প্রথম আলো

প্রকাশ: ২২ আগস্ট, ২০২৫

প্রশিক্ষণ চলছে একটি সংস্থার নিরাপত্তাকর্মীদেরছবি: প্রথম আলো
প্রশিক্ষণ চলছে একটি সংস্থার নিরাপত্তাকর্মীদেরছবি: প্রথম আলো

একসময় শুধু দারোয়ান দিয়েই নিরাপত্তা রক্ষার কাজ সামাল দেওয়া হতো। কিন্তু এখন বাণিজ্যিক ভবন বা করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে তাকালেই পোশাক পরিহিত নিরাপত্তাকর্মীদের চোখে পড়ে। দেশে এখন এ রকম নিরাপত্তাকর্মীর সংখ্যা ১০-১২ লাখের মতো। বিপুল এই কর্মসংস্থানের সুবাদে বেসরকারি নিরাপত্তা–সেবায় গড়ে উঠেছে হাজার কোটি টাকার বাজার। আর নিরাপত্তা–সেবার ব্যবসাটি করে বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠা বিভিন্ন সংস্থা। তারা মাসিক, ত্রৈমাসিক বা বার্ষিক চুক্তির ভিত্তিতে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, শিল্পকারখানা, ব্যাংক, এটিএম বুথ ও বিদেশি মিশনগুলোর চাহিদা অনুযায়ী নিরাপত্তাকর্মী সরবরাহ করে থাকে।

জানা গেছে, অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে দেশে ১৯৮৮ সালে প্রথম বেসরকারি পর্যায়ে নিরাপত্তা কোম্পানির যাত্রা শুরু হয়। এখন প্রায় ৫০০টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নিরাপত্তা–সেবা দিচ্ছে। আর সেবায় ইতিমধ্যে যুক্ত হয়েছে আর্চওয়ে, মেটাল ডিটেক্টর, স্ক্যানার, সিসিটিভি মনিটরিং, স্কটসহ অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার। এরই ধারাবাহিকতায় ডগ স্কোয়াড–সেবা দেওয়াও শুরু হয়েছে।

বেসরকারি নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর সূত্রে জানা গেছে, নিরাপত্তাকর্মীদের ৮ হাজার থেকে শুরু করে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বেতন দেওয়া হয়।

দেশের প্রথম বেসরকারি নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান হলো সিকিউরেক্স। বর্তমানে তাদের পাঁচ হাজারের বেশি নিরাপত্তাকর্মী রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি এখন প্রযুক্তিনির্ভর নিরাপত্তায় জোর দিয়েছে। গড়ে তুলেছে সেন্ট্রাল মনিটরিং সিস্টেম। তারা এখন প্রযুক্তিনির্ভর সেবা দিচ্ছে। ২০ জনকে প্রযুক্তিতে দক্ষ করে ৫০ জন নিরাপত্তাকর্মীর সমান সেবা দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে তারা।

জানতে চাইলে সিকিউরেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ফারহান কুদ্দুস প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশে নিরাপত্তা–সেবার চাহিদা বেড়েছে। গত বছরের আগস্টের পর আমরা অনেক ফোন পাই। কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে এত লোক সরবরাহ করা সম্ভব হয়নি। তাই আমরা প্রায় ৩০টি কোম্পানি একত্র হয়ে ৪০–৫০টি গাড়িতে করে এলাকা ভাগ করে প্যাট্রলিং করেছি। ঢাকার গুলশান, বনানী, উত্তরা, মিরপুর, ধানমন্ডিসহ বিভিন্ন এলাকায় পাহারার ব্যবস্থা করেছি।’

* বর্তমানে নিরাপত্তাকর্মীদের বেতন ৮ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা।
* দেশের প্রথম বেসরকারি নিরাপত্তা–সেবা কোম্পানি সিকিউরেক্স যাত্রা শুরু করে ১৯৮৮ সালে।
* দেশের সবচেয়ে বড় বেসরকারি নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান এলিট ফোর্স, যাদের কর্মী ২৩ হাজারের বেশি।
* শতবর্ষী বিদেশি প্রতিষ্ঠান জি৪এসও এখানে কাজ করছে। তাদের কর্মী ১৩ হাজারের বেশি।

নিরাপত্তাকর্মীদের বেতনকাঠামো নিয়ে ফারহান কুদ্দুস বলেন, ‘আমরা বছরে তিন হাজার লোক নিয়োগ দিই। আবার প্রায় আড়াই হাজার লোক চলে যায়। কারণ, বেতন কম। রিকশা চালিয়ে এখন ২০ হাজারের বেশি আয় করা যায়। মাত্র ১০ হাজার টাকার কম বেতনে কর্মী ধরে রাখা যায় না। তাই ভালো বেতন নিশ্চিতে আমরা দক্ষ কর্মী তৈরিতে জোর দিচ্ছি।’

কারওয়ান বাজার এলাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তায় নিয়োজিত নাহিদ (ছদ্মনাম)। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘৮ ঘণ্টা কাজ করলে মাসে বেতন পড়ে ১১ হাজার টাকা। আর এক দিন ৮ ঘণ্টা, আরেক দিন ১৬ ঘণ্টা করে কাজ করলে মাসে বেতন পড়ে ১৫ হাজার টাকা। খাওয়া নিজের। খরচ পড়ে তিন হাজার টাকা। সাপ্তাহিক ছুটিও নেই।’

দেশের সবচেয়ে বড় বেসরকারি নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান হচ্ছে এলিট ফোর্স। মাত্র সাতজন গার্ড নিয়ে ১৯৯৯ সালে যাত্রা করা এ প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে ২৩ হাজারের বেশি জনবল কাজ করছে। দেশে ১৮টি বিদেশি দূতাবাসের নিরাপত্তা সামাল দিচ্ছে এই প্রতিষ্ঠান। তা ছাড়া এটিএম বুথে টাকা স্থানান্তরের ৬৫ শতাংশ কাজ তারা একাই করছে। তাদের রয়েছে চারটি নিজস্ব ট্রেনিং একাডেমি।

এলিট ফোর্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শরীফ আজিজ প্রথম আলোকে বলেন, গড়ে ১০ হাজার টাকা বেতন ধরলেও ১০ লাখ কর্মীর মাসিক বেতন দাঁড়ায় প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা। তিনি বলেন, তবে লোকবল বাড়লেও নিরাপত্তা–সেবার মান বাড়েনি। কারণ, মাত্র ৯–১০ হাজার টাকা সার্ভিস চার্জ নিয়ে কর্মীদের কীভাবে বেতন, প্রশিক্ষণ আর ইউনিফর্ম সরবরাহ করব? বেতন খুবই কম। তাই অনেকে ১৬ ঘণ্টা কাজ করেন। বেতন বাড়ানো গেলে ভালো হতো।’

শরীফ আজিজের পাশাপাশি খাতসংশ্লিষ্ট আরও কয়েকজন ব্যক্তির সঙ্গে আলাপ করে বোঝা যায়, দেশে বছরে নিরাপত্তা–সেবার বাজার এখন ১২ হাজার কোটি টাকার।

গুলশানের দূতাবাসসংশ্লিষ্ট একটি ভবনের নিরাপত্তায় নিয়োজিত একজন বেসরকারি নিরাপত্তাকর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ‘দিনে ৮ ঘণ্টা কাজ করলে বেতন পাওয়া যায় ১৩ হাজার টাকা। তবে ওভারটাইমসহ ১৬ ঘণ্টা কাজ করলে অতিরিক্ত ৮ ঘণ্টার জন্য পাওয়া যায় ১১ হাজার টাকা। ওভারটাইমে মানুষ বেশি টাকা পেলেও আমরা পাই কম।’

খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিশাল কর্মী বাহিনী নিয়ে নিরাপত্তা–সেবায় বড় ভূমিকা পালন করলেও এ খাতকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। অনেকে কাজের সন্ধানে এ খাতে যুক্ত হলেও কম বেতনের কারণে আবার চলে যান। প্রায় দুই–তৃতীয়াংশ ক্লায়েন্ট ন্যূনতম মজুরি দেয় না। সে জন্য নিরাপত্তাকর্মীদের ন্যূনতম বেতন বৃদ্ধি ও সরকারের তদারকি নিশ্চিতের তাগিদ দেন তাঁরা।

কম বেতন প্রদানসহ নিরাপত্তা–সেবার সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে বেসরকারি নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ প্রফেশনাল সিকিউরিটি সার্ভিসেস প্রোভাইডার অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএসএসপিএ) সভাপতি লে. কর্নেল (অব.) খালিদ আজমের সঙ্গে প্রথম আলোর কথা হয়। তিনি বলেন, ‘সরকার এ খাতের সর্বনিম্ন মজুরি শহর এলাকার জন্য ৯ হাজার ৮০০ টাকা ও মফস্‌সলে ৯ হাজার ১০০ টাকা নির্ধারণ করেছে। কিন্তু ৭০ শতাংশ ক্লায়েন্ট ন্যূনতম টাকাও দেয় না। তাই অনেক কোম্পানি কর্মীদের কম বেতন দিতে বাধ্য হয়। কেউ হয়তো বেশি ডিউটি করায়। এসব দেখার জন্য আমরা সরকারি মনিটরিং সিস্টেম চাই, যাতে কেউ নিয়ম না মানলে তাকে জবাবদিহি করা যায়। ন্যূনতম বেতন বৃদ্ধির দাবিও জানাচ্ছি আমরা।’

সরকার এ খাতের সর্বনিম্ন মজুরি শহর এলাকার জন্য ৯ হাজার ৮০০ টাকা ও মফস্‌সলে ৯ হাজার ১০০ টাকা নির্ধারণ করেছে। কিন্তু ৭০ শতাংশ ক্লায়েন্ট ন্যূনতম টাকাও দেয় না। তাই অনেক কোম্পানি কর্মীদের কম বেতন দিতে বাধ্য হয়। কেউ হয়তো বেশি ডিউটি করায়। এসব দেখার জন্য আমরা সরকারি মনিটরিং সিস্টেম চাই, যাতে কেউ নিয়ম না মানলে তাকে জবাবদিহি করা যায়।
খালিদ আজম, সভাপতি, বিপিএসএসপিএ।

বিপিএসএসপিএর তথ্যমতে, ২০২২ সালে সংগঠনটির পরিচালিত এক জরিপে সারা দেশে নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত মিলিয়ে প্রায় ৫০০ প্রতিষ্ঠানের তথ্য পাওয়া যায়। এই সংখ্যা এখন আট শতাধিক হবে বলে মনে করেন কেউ কেউ। এদিকে স্থানীয় পর্যায়ে তথা পাড়া–মহল্লায় আজকাল কয়েকজন লোক মিলেও ছোট পরিসরে নিরাপত্তা–সেবা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন। সব মিলিয়ে দেশে নিরাপত্তা–সেবায় নিয়োজিত মোট জনবল ১০–১২ লাখ হবে।

এ খাতের অন্যতম প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি এজিস। ১৯৯৯ সালে যাত্রা করা এ প্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তাকর্মী রয়েছেন সাড়ে আট হাজারের বেশি। ১০০ বছরের পুরোনো বিদেশি প্রতিষ্ঠান জি৪এস এখন বাংলাদেশে কাজ করছে। এখানে তাদের কর্মীর সংখ্যা ১৩ হাজারের বেশি। অন্য বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে ইউরো ভিজিল, সেন্ট্রি সিকিউরিটি, শিল্ড সিকিউরিটি, সিকিউরিটি ৩৬০, ওরিয়ন সিকিউরিটি ও প্রোটেকশন ওয়ান।

এ খাতের অবস্থা নিয়ে কথা হয় নিরাপত্তাবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ফাউন্ডেশন ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) ফজলে এলাহী আকবরের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারি নিরাপত্তাব্যবস্থার অপর্যাপ্ততা থেকেই বেসরকারি নিরাপত্তা–সেবার ধারণাটি আসে। বিশ্বের অনেক দেশেই এটা আছে। কেনিয়াতেও দুর্বল নিরাপত্তাব্যবস্থার কারণে এ সেবার ব্যাপক প্রচলন দেখেছি। আমাদের দেশেও এটা কর্মসংস্থানের বড় ব্যবস্থা। অনেকে চাকরি না পেয়ে এখানে কাজ করছেন। অনেক অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্যরাও গানম্যান হিসেবে কাজ করেন। তবে এ খাতের জন্য একটি কোড অব কনডাক্ট বা নীতিমালা থাকা উচিত।’

অষ্টম শ্রেণি থেকে স্নাতক বা মাস্টার্স পাস লোকজনও কাজের জন্য আসেন। বিশ্বের অনেক দেশেই বেসরকারি নিরাপত্তাকর্মীর চাহিদা বাড়ছে। এমনকি এখন যুদ্ধক্ষেত্রেও বেসরকারি বাহিনীর ব্যবহার দেখা যায়। যেমন ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার পক্ষে যুদ্ধ করে আলোচনায় আসে বেসরকারি ওয়াগনার গ্রুপ বা ওয়াগনার আর্মি।

Lading . . .