Advertisement

এক জাহাজ অপরিশোধিত চিনি আটকা বন্দরে

প্রথম আলো

প্রকাশ: ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

চট্টগ্রাম বন্দরফাইল ছবি
চট্টগ্রাম বন্দরফাইল ছবি

ব্রাজিলের সান্তোষ বন্দর থেকে ২৭৮ কোটি টাকা মূল্যমানের চিনির কাঁচামাল বা অপরিশোধিত চিনি নিয়ে গত মঙ্গলবার রাতে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছায় ‘এমভি স্পার ক্যাপেলা’ জাহাজ। তবে শুল্কায়নযোগ্য মূল্য নিয়ে বিরোধের কারণে গত পাঁচ দিনেও জাহাজটিতে আনা কাঁচামাল খালাস হচ্ছে না। ফলে এসব কাঁচামাল উৎপাদনের জন্য কারখানায়ও নেওয়া যাচ্ছে না।

সাধারণত ভোগ্যপণ্য আমদানিতে আমদানিকারক যে দর ঘোষণা করেন, তা আন্তর্জাতিক স্বীকৃত প্রতিষ্ঠানের মূল্য তালিকার সঙ্গে মিলিয়ে ও প্রাসঙ্গিক নানা বিষয় যাচাই করে শুল্কায়ন করে কাস্টমস। তবে চিনির এই চালানে আমদানি মূল্য কম থাকায় কাস্টমস আমদানিকারকের ঘোষিত মূল্যে শুল্কায়ন করেনি। কাস্টমস কর্তৃপক্ষ সমসাময়িক ঘোষিত মূল্য টনপ্রতি ৪২৬ ডলার দরে শুল্কায়নের প্রক্রিয়া করছে, যা আমদানিকারকের ঘোষিত মূল্য টনপ্রতি ৪০৪ দশমিক ৫১ ডলার দরের চেয়ে বেশি।

এ পরিস্থিতিতে আমদানিকারক ব্যাংক গ্যারান্টি বা নিশ্চয়তা দিয়ে সাময়িক শুল্কায়নের মাধ্যমে কাঁচামাল খালাসের আবেদন করেছে। অবশ্য কাস্টমস কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা জানিয়েছে। চিনির কাঁচামাল আমদানি হয়েছে বিদেশি জাহাজ ভাড়া করে। নির্ধারিত সময়ে এসব কাঁচামাল খালাস করতে না পারলে জাহাজের ক্ষতিপূরণ গুনতে হবে আমদানিকারককে।

চিনিতে বর্তমানে উচ্চ হারে শুল্ক-কর রয়েছে। শুল্ককর আদায় করা হয় শুল্কায়নযোগ্য মূল্যের ভিত্তিতে। আমদানি মূল্যের চেয়ে শুল্কায়ন মূল্য বেশি নির্ধারণ করা হলে আমদানিকারককে শুল্ককর বেশি দিতে হবে। আমদানিকারক বাড়তি শুল্ক–করের টাকা দিন শেষে ভোক্তার কাছ থেকেই আদায় করবেন। তাতে দিন শেষে ভোক্তাকে এই বাড়তি খরচ বহন করতে হবে।

কাস্টমস সূত্রে জানা গেছে, জাহাজটিতে চিনির কাঁচামাল আমদানি করেছে নারায়ণগঞ্জের মেঘনাঘাটে অবস্থিত মেঘনা অর্থনৈতিক অঞ্চলের প্রতিষ্ঠান মেঘনা সুগার রিফাইনারি লিমিটেড। ব্রাজিলের এই চিনি সরবরাহ করেছে সিঙ্গাপুরভিত্তিক সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান উইলমার। প্রতিষ্ঠানটি ৫৬ হাজার ৭৩ টন চিনি এনেছে ২ কোটি ২৬ লাখ ডলারে। জাহাজভাড়াসহ টনপ্রতি দাম পড়েছে ৪০৪ দশমিক ৫১ ডলার। সব মিলিয়ে খরচ পড়ছে ২৭৮ কোটি টাকা।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কমোডিটি এক্সচেঞ্জ ‘ইন্টারকন্টিনেন্টাল এক্সচেঞ্জে (আইসিই)’ চিনি বেচাকেনার চুক্তিতে যে দর নির্ধারিত হয়, তা বিশ্ববাজারে নির্ভরযোগ্য মূল্য হিসেবে বিবেচিত হয়। আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, এপ্রিল থেকে জুন এ সময়ে এসব চিনি কেনা হয়েছে। ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া কমোডিটি এক্সচেঞ্জটির লেনদেনের দর অনুযায়ী, এই সময়ে কমোডিটি এক্সচেঞ্জে অপরিশোধিত চিনির টনপ্রতি গড় দর ছিল ৩৭৬ ডলার। আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, বিভিন্ন সময়ে কেনা দর গড় করে তাদের টনপ্রতি দর দাঁড়িয়েছে ৩৭৫ দশমিক শূন্য ১ ডলার। এই দর জাহাজভাড়া ছাড়া।

আগে কখনো চিনিতে আমদানি মূল্যের চেয়ে শুল্কায়ন মূল্য বাড়ানো হয়নি। কারণ, বিশ্ববাজারে দাম কত, তা ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ নেই। এ জন্যই বিশ্ববাজারের স্বীকৃত দর যাচাই করে শুল্কায়নের জন্য আমরা আবেদন করেছি
তাসলিম শাহরিয়ার, উপমহাব্যবস্থাপক, এমজিআই

জানতে চাইলে মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) উপমহাব্যবস্থাপক তাসলিম শাহরিয়ার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগে কখনো চিনিতে আমদানি মূল্যের চেয়ে শুল্কায়ন মূল্য বাড়ানো হয়নি। কারণ, বিশ্ববাজারে দাম কত, তা ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ নেই। এ জন্যই বিশ্ববাজারের স্বীকৃত দর যাচাই করে শুল্কায়নের জন্য আমরা আবেদন করেছি, যাতে চিনির উৎপাদন ব্যাহত না হয়। আবার শুল্কায়ন নিয়ে জটিলতায় যাতে জাহাজের ক্ষতিপূরণ গুনতে না হয়, সে জন্য ব্যাংক নিশ্চয়তা দিয়ে সাময়িক শুল্কায়ন করে কাঁচামাল খালাসের আবেদন করেছি আমরা।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কাস্টমসের যুগ্ম কমিশনার সৈয়দ মোকাদ্দেস হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘কাস্টমস সবকিছু বিশ্লেষণ করে সমসাময়িক সময়ে একই রকমের আমদানিকারকের সর্বনিম্ন ঘোষিত মূল্যে শুল্কায়নের প্রস্তাব করেছে, যা প্রক্রিয়াধীন। শুল্ক মূল্যায়ন বিধিমালা অনুযায়ী এই প্রক্রিয়া চলছে।’

ভোগ্যপণ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শুল্ক–কর চিনিতে। পরিশোধিত এবং অপরিশোধিত দুভাবে চিনি আমদানি হয়। অপরিশোধিত চিনি কারখানায় পরিশোধন করে বাজারজাত করা হয়। পরিশোধিত চিনি সরাসরি বাজারজাত করা হয়। উৎপাদনমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানের অপরিশোধিত চিনি আমদানিতে টনপ্রতি দিতে হয় তিন হাজার টাকা কাস্টমস শুল্ক। এ ছাড়া সম্পূরক শুল্ক ও মূল্য সংযোজন কর ১৫ শতাংশ করে এবং অগ্রিম আয়কর ২ শতাংশ। সব মিলিয়ে গত মাসে প্রতি কেজি অপরিশোধিত চিনি থেকে কাস্টমস রাজস্ব আদায় করেছে ২৩ টাকা। একজন ক্রেতা বাজার থেকে চিনি কেনার সময় কেজিতে প্রায় ২৩ টাকা সরকারকে রাজস্ব দেন।

গত অর্থবছরে ১৪ লাখ ১৮ হাজার টন অপরিশোধিত চিনি আমদানি হয়। পরিশোধিত চিনি আমদানি হয়েছে আড়াই লাখ টন। সব মিলিয়ে ১৬ লাখ ৭০ হাজার টন চিনি আমদানি হয়। গত অর্থবছর সরকার পরিশোধিত-অপরিশোধিত চিনি থেকে রাজস্ব আদায় করেছে ৫ হাজার ২২৯ কোটি টাকা।

বিশ্ববাজারে চিনির দাম এখন কমতির দিকে। সর্বশেষ গত শুক্রবার কমোডিটি এক্সচেঞ্জে প্রতি পাউন্ড চিনি বেচাকেনা হয়েছে ১৫ দশমিক ৭৯ সেন্টে। এ হিসাবে জাহাজভাড়া ছাড়া টনপ্রতি দাম পড়ে ৩৪৮ ডলার। গত আগস্টে গড়ে চিনি বেচাকেনা হয়েছে প্রতি পাউন্ড ১৬ দশমিক ৩৯ ডলার বা টনপ্রতি ৩৬১ ডলারে। সেই হিসাবে টনপ্রতি ১৩ দশমিক ৩৩ ডলার কমেছে। কেজিপ্রতি কমেছে ১ টাকা ৬৩ পয়সা। বিশ্ববাজারে দাম কমায় দেশের বাজারেও চিনির দাম কমছে। বাজারে এখন প্যাকেটজাত চিনি কেজিতে ১১০ টাকা এবং খোলা চিনি ১০৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, এক বছর আগের তুলনায় চিনির দাম কমেছে প্রায় ১৪ শতাংশ। চিনি আমদানিকারকেরা বলছেন, বিশ্ববাজারে নতুন করে দাম কমলেও সে অনুযায়ী কাস্টমস শুল্কায়ন মূল্য না কমালে বাড়তি খরচ হবে আমদানিকারকদের। এই খরচ পণ্যমূল্যের সঙ্গে যুক্ত হবে।

Lading . . .