Advertisement
  • হোম
  • বিনোদন
  • ‘সিতারে’র বিশেষ ক্ষমতার গল্প, বিনোদনের স্ট্র্যাটেজ...

‘সিতারে’র বিশেষ ক্ষমতার গল্প, বিনোদনের স্ট্র্যাটেজি কি ‘ইনস্পিরেশন পর্ন’?

এই সময়

প্রকাশ: ৭ জুলাই, ২০২৫

(বাঁ দিক থেকে) স্টেলা ইয়ং, ‘সিতারে জ়মিন পর’-এর দৃশ্য, জিজা ঘোষ,ছবি: সোশ্যাল মিডিয়া,,গ্রাফিক্স: রাতুল মণ্ডল,অভিষেক অনিক্কা,ছবি: সোশ্যাল মিডিয়া,‘সিতারে জ়মিন পর’-এর দৃশ্য,ছবি: সোশ্যাল মিডিয়া
(বাঁ দিক থেকে) স্টেলা ইয়ং, ‘সিতারে জ়মিন পর’-এর দৃশ্য, জিজা ঘোষ,ছবি: সোশ্যাল মিডিয়া,,গ্রাফিক্স: রাতুল মণ্ডল,অভিষেক অনিক্কা,ছবি: সোশ্যাল মিডিয়া,‘সিতারে জ়মিন পর’-এর দৃশ্য,ছবি: সোশ্যাল মিডিয়া

দেবর্ষি ঘোষ ও মেঘা মণ্ডল

স্টেলা ইয়ং —সফল এবং জনপ্রিয় অস্ট্রেলিয়ান সাংবাদিক। সেই সঙ্গে কমেডিয়ানও। এক দশক আগে, ৩২ বছর বয়সে মৃত্যুর আগে স্টেলা ইয়ং অত্যন্ত গুরুত্তপূর্ণ একটি বিষয় চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে গিয়েছিলেন।

জটিল হাড়ের রোগে আক্রান্ত স্টেলা সারা জীবন হুইলচেয়ারে কাটান। ‘ওস্টিওজেনেসিস ইম্পারফেক্টা’র জন্য স্টেলার উচ্চতাও বাড়েনি। ডিজ়এবিলিটি রাইটস অ্যাক্টিভিস্ট হিসাবে নিজের মতো অন্য প্রতিবন্ধীদের জীবনের কথা প্রকাশ্যে তুলে আনতেন স্টেলা। এ রকমই এক পাবলিক ফোরামে কথা বলার সময়ে তিনি বলেছিলেন ‘ ইনস্পিরেশন পর্ন ’-এর কথা।

কাট টু ২০২৫। সদ্য মুক্তি পাওয়া আমির খান অভিনীত ‘সিতারে জ়মিন পর’-এ ‘মিস্টার পারফেকশনিস্ট’ একজন স্পোর্টস কোচ, যিনি ডাউন সিনড্রোম এবং অটিজ়মের মতো কন্ডিশন নিয়ে বাঁচা কিছু তরুণ-তরুণীকে বাস্কেটবল খেলা শেখাচ্ছেন। স্প্যানিশ ছবি ‘ক্যাম্পেয়োনেস’ মুক্তি পেয়েছিল ২০১৮ সালে। সেই সিনেমারই রিমেক ‘সিতারে জ়মিন পর’। মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানোর দায়ে কোর্টের নির্দেশে গুলশনকে (আমির) বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন কয়েকজন তরুণ-তরুণীকে বাস্কেটবল খেলার ট্রেনিং দিতে হবে, ছবির গল্প এমনই।

অথবা ধরুন আসন্ন হিন্দি ফিল্ম ‘তনভি দ্য গ্রেট’-র কথা। অনুপম খের পরিচালিত এই ছবির মুখ্য চরিত্র তনভি (শুভাঙ্গি দত্ত) একজন অটিস্টিক তরুণী। ট্রেলারে দেখা যাচ্ছে, কখন, কোথায় কী বলা উচিত, তাঁর তথাকথিত ‘সিভিলাইজ়ড সেন্স’ নেই তনভির। ট্রেলার বলছে, তনভি ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে চায়। কিন্তু তার মা (পল্লবী যোশী), ঠাকুর্দা (অনুপম খের) সকলে তনভির এই জেদ নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছে। ট্রেলারে দেখানো হচ্ছে, প্রচুর প্রতিকূলতার মধ্য়েও তনভি সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। ট্রেলারে তাকে বলতে দেখা যায়, ‘আই অ্যাম ডিফারেন্ট, বাট নো লেস’ (আমি অন্য রকম হতে পারি, কিন্তু কারও চেয়ে কম নই)।

বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন চরিত্রদের জীবনকে অনুপম খের এবং ‘সিতারে...’ পরিচালক আরএস প্রসন্ন ‘ইনস্পিরেশনাল’ বা অনুপ্রেরণামূলক স্পিন দিয়েছেন।

যেমন ধরুন, ‘সিতারে...’-তে এদের মা-বাবা কী ভাবে প্রতিকূলতার মধ্যে সন্তানকে মানুষ করেন, তার কোনও উল্লেখ নেই। গোটা ছবিতে এই ‘স্পেশালি এবলড’ চরিত্রগুলিকে হাসি-মজা-খেলার মাধ্যমে দেখানো হয়েছে, যার উদ্দেশ্য হয়তো নিঃসন্দেহে সাধুবাদযোগ্য, কিন্তু ঠিক এই ধারাকেই প্রশ্ন করেছিলেন স্টেলা।

‘ইনস্পিরেশন পর্ন’ কী?

ইনস্পিরেশন পর্ন ’ শব্দবন্ধটি স্টেলা নিজেই তৈরি করেছিলেন। তাঁর মতে, পপ কালচার অর্থাৎ সিনেমা, ফ্যাশন বা খেলাধুলোর দুনিয়ায়, বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষদের ব্যক্তিত্বকে এমন ভাবে ‘কমার্শিয়ালাইজ়’ করা হয় যে, তাঁদের জোর করে নিজের জীবন সম্পর্কে মহৎ ধারণা পোষণ করতে বাধ্য করা হয়।

ভারতে এই একই জিনিস নিয়ে আলোচনা করেছেন ডিজ়এবিলিটি রাইটস অ্যাক্টিভিস্ট অভিষেক অনিক্কা । ২০২৩-এ প্রকাশিত তাঁর আত্মজীবনী ‘দ্য গ্র্যামার অফ মাই বডি’ এবং অন্যান্য প্রবন্ধে তিনি এই প্রসঙ্গে লিখেছেন।

২০২৪-এ ‘দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া’র এক প্রতিবেদনে প্যারালিম্পিকসের (স্পেশালি এবলড মানুষদের স্পোর্টস কম্পিটিশন) প্রসঙ্গে অভিষেক লেখেন, ‘সব প্রতিবন্ধী ক্রীড়াবিদ হতে পারবে না। তাঁদের আর্থিক অবস্থা, বর্ণ, জাতি, লিঙ্গর উপর অনেক কিছু নির্ভরশীল। ভাবুন, যদি আমি প্রতিটি সক্ষম মানুষের কাছ থেকে এই আশা রাখতাম, তাঁরা যেন নীরজ চোপড়া হয়? সক্ষম মানুষরা আমাদের সঙ্গে ঠিক তাই করে। আমরা ইনস্পায়ার না করতে পারলে যেন কিছুই নই।’

Abhishek Anicca

চলচ্চিত্রের ইতিহাসে ‘ইনস্পিরেশন পর্ন’

সিনেমার ইতিহাসে এর উদাহরণ প্রচুর। মূলত এই ধরনের ক্যারেক্টার ‘জিনিয়াস’ হিসাবে চিত্রিত হয়। ‘ রেন ম্যান ’ (১৯৮৮)-এ ডাস্টিন হফম্যানের চরিত্রের অটিজ়ম রয়েছে, কিন্তু গণিত এবং অন্যান্য জটিল চিন্তাভাবনায় সে পারদর্শী। তার পরের বছর মুক্তি পায় ‘ মাই লেফট ফুট ’, যেখানে ড্যানিয়েল ডে লিউইসের চরিত্রের সেরিব্রাল পলসি রয়েছে। সে শুধু তার বাঁ পা নাড়াতে পারে এবং সেটা দিয়েই দুর্দান্ত ছবি আঁকে।

২০০১-এর ‘ আ বিউটিফুল মাইন্ড ’-এ রাসেল ক্রো-কে বিখ্যাত গণিতবিদ জন ন্যাশের ভূমিকায় দেখা যায়। জন ন্যাশ স্কিৎজ়োফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত ছিলেন, অথচ অর্থনীতি এবং গণিতশাস্ত্রে প্রচুর অবদানের জন্য তাঁকে ১৯৯৪-এ নোবেল প্রাইজ় দেওয়া হয়। রোলগুলির জন্য ডাস্টিন, ড্যানিয়েল, রাসেল, তিনজনেই শ্রেষ্ঠ অভিনেতার অস্কার পান।

এই ধরনের চরিত্রদের যাতে সিনেমায় অতিরঞ্জিত, কৌতুকপূর্ণ ভঙ্গিতে দেখানো হয়, তাই একসময়ে লেখক-পরিচালকেরা বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন চরিত্রকে ‘ইনস্পিরেশনাল’ করে তোলার জন্য বাড়তি মোচড় দেওয়া শুরু করেন।

Stella Young, Sitaare Zameen Par, Jija Ghosh

‘সিতারে জ়মিন পর’ কি ‘ইনস্পিরেশন পর্ন’?

‘সিতারে জ়মিন পর’-এর অ্যাকটিং কোচ মনুজ শর্মা শুটিং শুরু হওয়ার আগে ছবির ১০ জন ‘সিতারে’র (বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন অভিনেতা-অভিনেত্রী) সঙ্গে ২২ দিনের ওয়ার্কশপ করেন । এই সময় অনলাইনকে মনুজ জানিয়েছেন: ‘সিতারে জ়মিন পর’-এ কোনও ‘ইনস্পিরেশন পর্ন’-এর এলিমেন্ট নেই।

মনুজ বলেছেন, ‘আমরা দেখানোর চেষ্টা করেছি যে বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ এবং সক্ষম মানুষ, সবাই নরমাল—এক। আপনি, আমি, আমাদের সকলের যে রকম খুবই সাধারণ কিছু আশা, আকাঙ্খা, অ্যাম্বিশন রয়েছে, এদেরও তাই রয়েছে।’

তবে মনুজ একটা কথা মনে করিয়ে দিতে চান, ‘এই ছবিতে কাজ করার সময়ে বুঝতে পেরেছি, আমাদের মতো মানুষের থেকে এদের ক্রিয়েটিভ ক্যাপাসিটি অনেক তীক্ষ্ণ, কারণ এদের মধ্যে নতুন ভাবে চিন্তা করার, নতুন ভাবে পৃথিবীকে বোঝার ভয় বা দ্বিধাবোধ নেই।’

Sitaare Zameen Par

‘ইনস্পিরেশন পর্ন’ থেকে এগিয়ে যাওয়ার সময় এসেছে

এ দেশে বা বিদেশে, বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন চরিত্রদের সিনেমায় করুণার পাত্র-পাত্রী হিসেবে দেখে অডিয়েন্স। নইলে তাঁদের অনুপ্রেরণার ধ্বজাধারী হিসাবে দেখানো হয়, এমনটাই মনে করেন ‘সিতারে জ়মিন পর’-এর কাস্টিং ডিরেক্টর অনমোল আহুজা

এই সময় অনলাইনকে অনমোল বলেন, ‘এই দুই প্যাটার্ন মেনে চরিত্রায়ণের ভালো কোনও উদ্দেশ্য থাকতেই পারে। তবুও এ ভাবে কোনও চরিত্রকে দাগিয়ে দেওয়া উচিত নয়। এই ধরনের চরিত্রকে ২৫ বছর আগে বাণিজ্যিক হিন্দি ছবিতে হাসির খোরাক হিসাবে ব্যবহার করা হত। কিন্তু এ সব পোর্ট্রেয়াল চরিত্রের মর্যাদাই কেবল কেড়ে নেয় না, বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন দর্শকদেরও মনের জোরও আলগা করে দেয়।’

অনমোলের মতে, মূলধারার ছবিতে এই ধরনের চরিত্রদের ধীরে ধীরে অন্য যে কোনও চরিত্রের মতোই গভীরতা, স্বকীয়তা এবং জটিলতার সঙ্গে উপস্থাপিত করা হচ্ছে।

অনমোল বলেন, ‘টোকেনিজ়মের বাইরে গিয়ে এই ধরনের মানুষদের দৈনন্দিন দিনযাপনের কথা তুলে ধরতে হবে। শুধুমাত্র কোনও বিশেষ মেডিক্যাল অথবা বিহেভিওরাল অবস্থার কারণে তাঁদের সংজ্ঞায়িত না করে আর পাঁচ জন মানুষের মতোই দেখানো হোক সিনেমায়।’

Stella Young, Sitaare Zameen Par, Jija Ghosh

বিশেষ ভাবে সক্ষমদের ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গিতে বদল এসেছে, তবে...

ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সেরিব্রাল পলসির আইটি ও অ্যাডভোকেসি ট্রেনার সুদীপেন্দু দত্তের কথায়, ‘চলচ্চিত্র সচেতনতা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ‘তারে জ়মিন পর’, ‘ব্ল্যাক’—এই ধরনের সিনেমাগুলো দেখার পরে অবশ্যই মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছে। বাস্তব জীবনে তার ফলও দেখতে পাই। আজ থেকে ৬-৭ বছর আগে যে ধরনের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতাম, এখন আর তেমনটা হই না। সর্বোপরি মানুষ আমাদের আর অন্য চোখে দেখে না।’

সুদীপেন্দু যে ‘অনেক পথ চলা’র কথা বলেছেন, বলিউডে তার প্রায় অনেকটা কাছাকাছি পৌঁছেছিল অনুরাগ বসু পরিচালিত ছবি ‘বরফি’র প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার চরিত্র।

সেরিব্রাল পলসিতে আক্রান্ত সমাজকর্মী জিজা ঘোষের বক্তব্য, ‘আমার ইনস্পিরেশন পর্ন’ শব্দটার ব্যবহার নিয়ে ব্যক্তিগত আপত্তি আছে। এবং আমি সিনেমাটাও দেখিনি। তা ছাড়া আমার মনে হয়, বিশেষ ভাবে সক্ষম মানুষদের বাস্তবটা না জেনেই সিনেমাগুলো তৈরি হয়। যে ভাবে সিনেমায় বিশেষ ভাবে সক্ষম মানুষদের তুলে ধরা হয়, তার থেকে বাস্তবটা অনেকটাই আলাদা। সিনেমার মাধ্যম ছাড়াও মানুষের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তোলা যায়।’

২০২৫-এ দাঁড়িয়ে বিশেষ ভাবে সক্ষম মানুষদের প্রতি অন্যদের দৃষ্টিভঙ্গি কি বদলেছে?

জিজা বলেন, ‘আগের থেকে এখন অনেক বদল দেখি। সমাজ অনেকটাই বদলেছে। কিন্তু আমরা শহরে বাস করি। প্রত্যন্ত এলাকায়, গ্রাম-গঞ্জে থাকা মানুষদের মধ্যে আদৌ কোনও বদল এসেছে কি না অথবা সেখানে কোনও বিশেষ ভাবে সক্ষম মানুষ কোনও সমস্যায় পড়ছেন কি না, তা আমরা জানি না। আরও সচেতনতা দরকার বলে আমার মনে হয়।’

Lading . . .