- হোম
- বাণিজ্য
- উদ্যোক্তা updated
- গ্যারেজ থেকে কৃষকের খেতে অঙ্কুর
গ্যারেজ থেকে কৃষকের খেতে অঙ্কুর
প্রকাশ: ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

গাইবান্ধার এরেন্দাবাড়ী গ্রামের কৃষক শাহাদাত হোসেন। ৩৩ শতাংশ জমিতে চাষাবাদ করেন তিনি। তবে চাষের মাটি তৈরি, আবহাওয়া ও কী ধরনের ফসলের চাষ করবেন, তা নিয়ে সব সময় দ্বিধায় ভোগেন। সেই সঙ্গে চাষের খরচ জোগাতে চড়া সুদে নেওয়া ঋণের চাপ তো আছেই। এভাবেই চলছিল কৃষক শাহাদাত হোসেনের কৃষকজীবন। ২০২৩ সালে স্থানীয় এক বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) মাধ্যমে পরিচয় হয় ডিজিটাল কৃষি তথ্য ও পরামর্শ সেবাদাতা স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠান ‘অঙ্কুর’–এর সঙ্গে। অঙ্কুরের নানা সেবা বদলে দেয় শাহাদাত হোসেনের কৃষকজীবন। শাহাদাত হোসেনের মতো অনেক কৃষকের অনেক কাজকে সহজ করে দিয়েছে অঙ্কুর।
চাষের জমির মাটি পরীক্ষা করে অঙ্কুর জানিয়ে দেয়, ‘বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১০’ জাতের ভুট্টার চাষই শাহাদাত হোসেনের জমির জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত। সেই সঙ্গে জানিয়ে দেয়—বীজ, সার, কীটনাশক থেকে শুরু করে ছত্রাক দমনে খরচ হবে মোট ৯ হাজার ৬৫ টাকা। পাশাপাশি কোন ধরনের সার কতটুকু প্রয়োগ করতে হবে, সে তথ্যও বাংলায় খুদে বার্তার মাধ্যমে পৌঁছে যায় তাঁর মুঠোফোনে। অঙ্কুরের পক্ষ থেকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার করে আবহাওয়ার পূর্বাভাসও নিয়মিত পৌঁছে যায় শাহাদাত হোসেনের কাছে। এমনকি ব্যাংক থেকে ৪ থেকে ৯ শতাংশ সুদে কৃষিঋণের সন্ধানও পান তিনি। এভাবে কৃষির নানা প্রয়োজনীয় তথ্য নিয়ে কৃষকের পাশে দাঁড়িয়েছে স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠান অঙ্কুর।
দেশে কৃষকদের জন্য চাষের জমির মাটি পরীক্ষার সেবা দেয় মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট (এসআরডিআই)। বর্তমানে দেশজুড়ে প্রতিষ্ঠানটির ২৪টি গবেষণাকেন্দ্র রয়েছে। ফলে চাষের জমির মাটি পরীক্ষা করতে একজন কৃষকের ১৫ দিন বা তার বেশি সময় লেগে যায়। আবার প্রান্তিক কৃষকের জন্য আবহাওয়ার তথ্যও খুবই গুরুত্বপূর্ণ; কিন্তু প্রান্তিক কৃষকেরা সেই সেবাও সহজে পান না। কৃষকের এসব প্রয়োজনীয় সেবার সীমাবদ্ধতার কথা মাথায় নিয়ে ২০১৯ সালে কয়েক বন্ধু মিলে শুরু করেন কৃষিসেবানির্ভর প্রতিষ্ঠান অঙ্কুর। অঙ্কুর নামটি ব্যাপক পরিচিতি পেলেও এটির মূল কোম্পানি ‘আইপেজ গ্লোবাল’। এই নামেই উদ্যোগটি নিবন্ধিত। উন্নত নানা প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই স্টার্টআপ থেকে কৃষকদের প্রয়োজনীয় নানা সহায়তা দেওয়া হয়। দ্রুততম সময়ে এই স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠান থেকে কৃষকেরা তাঁদের চাষের জমির মাটি পরীক্ষার ফল সম্পর্কে জানতে পারেন। এ জন্য কৃষককে নিবন্ধিত হতে হয় অঙ্কুরের সঙ্গে।
* মাটি পরীক্ষা, আবহাওয়ার পূর্বাভাস, ঋণসহায়তা মিলছে এক প্ল্যাটফর্মে।
* অঙ্কুরের সেবা নেওয়ার পর ফসল উৎপাদন গড়ে ১৫% বেড়েছে।
* কৃষকের চাষের খরচ কমেছে ২৫–২৮%, লাভ বেড়েছে প্রায় ৩৫%।
* বছরে প্রতিষ্ঠানটির আয় ৫ কোটি টাকার বেশি।
* এখন আঞ্চলিক কার্যালয় আছে পাঁচ জেলায়।
নিবন্ধনের কারণে কৃষকের প্রায় সব তথ্যই থাকে অঙ্কুরের কাছে। একজন কৃষক যদি তাঁর চাষের জমিতে ভুট্টার চাষ করেন, তখন অঙ্কুরের পক্ষ থেকে ওই কৃষককে জানিয়ে দেওয়া হয় কখন কী করতে হবে। যেমন ভুট্টা বপনের ১০ দিন পর কী করতে হবে বা ৪০ দিন পর কী করতে হবে। অঙ্কুরের দাবি, তাদের সেবা নেওয়ার পর একজন কৃষকের ফসলের উৎপাদন গড়ে ১৫ শতাংশ বেড়েছে। আর চাষের খরচ কমেছে ২৫ থেকে ২৮ শতাংশ। সব মিলিয়ে কৃষকের লাভের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ৩৫ শতাংশ।
যেভাবে অঙ্কুরের শুরু
রাজধানী ঢাকার ধানমন্ডির ৬ নম্বর সড়কে একটি গ্যারেজের ১৮০ বর্গফুট জায়গা নিয়ে ২০১৯ সালে যাত্রা শুরু অঙ্কুরের। অঙ্কুরের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মাশরুর এইচ সুহৃদ। অঙ্কুর প্রতিষ্ঠার আগে ২০১৫ সালে ‘ই-ল্যাব’ নামে তাঁর আরেকটি স্টার্টআপ ছিল। তাই প্রযুক্তির ধারণাটি তাঁর আগে থেকেই ছিল। পাশাপাশি কৃষক পরিবারের সন্তান হওয়ায় কৃষকের সমস্যাগুলোও তাঁর আগে থেকে জানা ছিল। শুরুতে অঙ্কুরের কর্মী ছিলেন সাতজন। বর্তমানে কর্মী বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩২ জনে। ১৮০ বর্গফুটের গ্যারেজ থেকে এখন অঙ্কুরের কার্যালয় স্থানান্তর করা হয়েছে সাড়ে তিন হাজার বর্গফুট জায়গায়। পাঁচটি জেলায় রয়েছে পাঁচটি আঞ্চলিক কার্যালয়। পাবনা, গাইবান্ধা, জয়পুরহাট, রংপুর ও সিরাজগঞ্জে স্থানীয় এনজিওর মাধ্যমে এসব কার্যালয় ফ্র্যাঞ্চাইজি মডেলে পরিচালিত হচ্ছে।
কৃষককে সঠিক সময়ে মাটি ও আবহাওয়ার তথ্য দিতে পারলে তাঁদের ফলন সহজে বাড়ানো যায়। আমরা কৃষকদের মাটির উর্বরতা শক্তি ও সরকার-নির্ধারিত ক্রপ জোনিং বুঝে সঠিক জাতের নিবন্ধিত বীজ ও কীটনাশক ব্যবহারের পরামর্শ দিই। ভবিষ্যতে খুলনা, সাতক্ষীরা ও কক্সবাজারে নিজেদের সেবার আওতা বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে।ইমতিয়াজ হোসেন, প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা, অঙ্কুর।
যাত্রা শুরুর কিছুদিনের মধ্যে অঙ্কুরের সঙ্গে যুক্ত হন ইমতিয়াজ হোসেন ও সাইফুল্লাহ। তাঁদের মধ্যে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার ইমতিয়াজ বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা; আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষার্থী সাইফুল্লাহ কাজ করেন ব্যবসা প্রসারে। ২০১৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত এই তিনজন মিলে প্রযুক্তির উন্নয়ন ও ব্যবসায়িক মডেল নিয়ে কাজ শুরু করেন। যেকোনো ব্যবসার মতো তাঁদেরও ব্যবসার শুরুতে প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে সামনে আসে মূলধন সংস্থানের বিষয়। যদিও শুরুতে নিজেদের জমানো ২০ লাখ টাকা পুঁজি হিসেবে বিনিয়োগ করেন তাঁরা। ওই টাকায় শুরুর কিছু প্রাথমিক খরচ সামলান। এরপর বড় বিনিয়োগের বিষয়টি যখন বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে সামনে আসে, তখন তাঁদের পাশে দাঁড়ান ইউনিলিভার বাংলাদেশের চেয়ারম্যান জাভেদ আখতার। সব মিলিয়ে প্রায় এক কোটি টাকা বিনিয়োগ পেয়ে যান তাঁরা। কোটি টাকায় শুরু হয় অঙ্কুরের যাত্রা। এখন প্রতিষ্ঠানটির মাসিক আয় ৪০ থেকে ৪৫ লাখ টাকা। তাতে বছরে প্রতিষ্ঠানটির আয় দাঁড়ায় ৪ কোটি ৮০ লাখ থেকে ৫ কোটি ৪০ লাখ টাকায়।
সম্প্রতি কথা হয় মাশরুর এইচ সুহৃদসহ তিন উদ্যোক্তার সঙ্গে। এ সময় সুহৃদ জানান, ২০১৯ সালে যাত্রা শুরু করলেও ২০২২ সালে আইপেজ গ্লোবাল তাদের কার্যক্রম শুরু করে গাইবান্ধার প্রত্যন্ত এলাকা এরেন্দাবাড়ী থেকে। বর্তমানে গাইবান্ধায় পাঁচ হাজারের বেশি কৃষক অঙ্কুরের সেবা নিচ্ছেন। এ পর্যন্ত প্রায় ৩২ হাজার ৩০০ কৃষক নিবন্ধিত হয়েছেন তাঁদের প্ল্যাটফর্মে। তাঁদের মধ্যে প্রায় ৬ হাজার ৯০০ কৃষক সরাসরি টাকার বিনিময়ে সেবা নিচ্ছেন।
মাশরুর এইচ সুহৃদ বলেন, ‘গাইবান্ধায় আবু শামা নামের একজন কৃষক আছেন। বয়স প্রায় ৬০ বছর। নিজের জমি কম থাকায় বর্গা চাষ করেন। আগে অনেকটা অনুমান করে জমি বর্গা নিতেন। এতে কখনো লাভ হতো, কখনো হতো ক্ষতি। তবে অঙ্কুরের সেবা ব্যবহার করে এখন তিনি দর–কষাকষি করেন। তাঁর আত্মবিশ্বাস দেখে আমরাও অনেক উৎসাহ পাই। আমাদের অ্যাপ ইন্টারনেট ছাড়া কাজ করার ফলে কৃষকেরা সহজেই ব্যবহার করতে পারছেন।’
কৃষক যেভাবে সেবা নেন
অঙ্কুরের ব্যবসায়িক ভিত্তি মূলত ডেটা সার্ভিস মডেল। ব্যাংকগুলোর পক্ষে সাধারণত কৃষকের আয়-ব্যয়ের সঠিক তথ্য পাওয়া কঠিন। ফলে কৃষকেরা ব্যাংক থেকে সহজে ঋণ পান না। কৃষকের সেই কাজ সহজ করে দিয়েছে অঙ্কুর। তাদের তথ্য কাজে লাগিয়ে ব্যাংকগুলো সহজেই ঋণ দিতে পারে কৃষকদের। বর্তমানে ঢাকা ব্যাংক ও শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংক অঙ্কুরের সঙ্গে কাজ করছে।
একজন কৃষককে অঙ্কুরের সেবা নিতে প্রতি বিঘায় সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা খরচ দিতে হয়। কৃষক প্রথম দুই থেকে তিন মৌসুম বিনা খরচে এই সেবা নিতে পারেন। যার মধ্যে রয়েছে জমির মাটি পরীক্ষা, আবহাওয়ার তথ্য, মৌসুমভিত্তিক প্রশিক্ষণ ও ঋণের জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা।
অঙ্কুরের প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা ইমতিয়াজ হোসেন বলেন, ‘কৃষককে সঠিক সময়ে মাটি ও আবহাওয়ার তথ্য দিতে পারলে তাঁদের ফলন সহজে বাড়ানো যায়। আমরা কৃষকদের মাটির উর্বরতা শক্তি ও সরকার–নির্ধারিত ক্রপ জোনিং বুঝে সঠিক জাতের নিবন্ধিত বীজ ও কীটনাশক ব্যবহারের পরামর্শ দিই। ভবিষ্যতে খুলনা, সাতক্ষীরা ও কক্সবাজারে নিজেদের সেবার আওতা বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে। পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও ফিলিপাইনে ছোট পরিসরে পাইলট প্রকল্প শুরুর পরিকল্পনা রয়েছে।’