- হোম
- প্রযুক্তি
- ফ্রিল্যান্সিং
- পোশাককর্মী থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, অতঃপর সফল উদ্য...
পোশাককর্মী থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, অতঃপর সফল উদ্যোক্তা মেহেদী
প্রকাশ: ৩১ আগস্ট, ২০২৫

ব্যর্থতা, অপমান, আর বেদনার আগুনে পুড়ে খাঁটি সোনায় পরিণত হওয়ার গল্প এটি। যশোর জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে এসে স্বপ্নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখা, বিসিএসের সাক্ষাৎকারে দু’বার স্বপ্নভঙ্গের শিকার হওয়া এবং শেষ পর্যন্ত একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করা—মেহেদী হাসানের জীবন যেন এক জীবন্ত অনুপ্রেরণা। তাঁর গল্প বলে ইচ্ছাশক্তি আর অধ্যবসায় থাকলে যেকোনো প্রতিকূলতাকে জয় করা সম্ভব। ২৪ আগস্ট যশোর শহরে কথা হয় মেহেদী হাসানের সঙ্গে।
স্বপ্নভঙ্গ ও নতুন স্বপ্নের সূচনা
মেহেদী হাসানের জন্ম ১৯৮৫ সালে, যশোরের ঝিকরগাছার উজ্জ্বলপুর গ্রামে। গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে তাঁকে দুই বছরের বড় বোনের সঙ্গে সরাসরি দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভর্তি করে দেওয়া হয়। কিন্তু পারিবারিক জটিলতায় ১৯৯৮ সালে এসএসসি পরীক্ষায় অপ্রত্যাশিতভাবে ফেল করে বসেন তিনি। মাত্র ১৪ বছর বয়সে এই লজ্জা আর অভিমানে এক বন্ধুর সঙ্গে গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় পালিয়ে যান মেহেদী। মিরপুরের এক তৈরি পোশাক কারখানায় মাসিক তিন হাজার টাকা বেতনে শুরু হয় তাঁর জীবনযুদ্ধ। সেটা ১৯৯৯ সালের কথা।
একদিন ছুটিতে শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরে ঘুরতে গিয়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস দেখতে পান। কার্জন হল, টিএসসি, কলা ভবন—এসব দেখে তাঁর ভেতরে এক নতুন স্বপ্নের জন্ম হয়। সেই রাতে তিনি ঘুমাতে পারেননি, শুধু ভেবেছেন, ‘আমার তো এখানে থাকার কথা ছিল!’ সেই রাতেই সিদ্ধান্ত নেন, যত কষ্টই হোক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁকে পড়তেই হবে।
অদম্য ইচ্ছাশক্তি ও স্বপ্নের ক্যাম্পাস
সাত দিনের মাথায় ঢাকা ছেড়ে বাড়ি ফিরে এসে মেহেদী আবার পড়াশোনা শুরু করার সিদ্ধান্ত জানান। পরিবার থেকে তাঁকে মালয়েশিয়া পাঠানোর প্রস্তুতি চললেও তিনি ছিলেন নাছোড়বান্দা। স্বপ্নের পেছনে ছুটতে গিয়ে তিনি গোপনে পাশের গ্রামের এক দাখিল মাদ্রাসায় নবম শ্রেণিতে ভর্তি হন। সবাইকে অবাক করে দিয়ে মাদ্রাসায় যাওয়া শুরু করেন। এরপর আর তাঁকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বার্ষিক পরীক্ষায় মাদ্রাসায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। ২০০২ সালে দাখিল এবং ২০০৪ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। এবার তাঁর একমাত্র লক্ষ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
মেহেদী হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্বপ্নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় তীব্র অর্থসংকট। শত প্রতিকূলতার মাঝেও দমে যাইনি। যশোরের খোলাডাঙ্গা বস্তিতে মাত্র ১০০ টাকায় একটি ঝুপড়ি ঘর ভাড়া নিয়েছিলাম। এক ভ্যানচালকের শিশুদের পড়ানোর বিনিময়ে জুটত তিন বেলার খাবার, সকালে প্রায়ই থাকত পান্তাভাত আর কাঁচা মরিচ। তবে কোনো কষ্টই আমার লক্ষ্য থেকে সরাতে পারেনি। ২০০৫ সালের ২৩ মার্চ ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলে যখন নিজের রোল নম্বর (ক্রমিক ৬২২) খুঁজে পেলাম, তখনই স্বপ্ন সত্যি হয়। সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়ে আমি ক্যাম্পাসের প্রতিটি ধূলিকণায় নিজের দীর্ঘ সংগ্রামের ঘ্রাণ খুঁজে নিতাম।’
নতুন স্বপ্ন ও বারবার স্বপ্নভঙ্গের বেদনা
বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনও সহজ ছিল না। টিকে থাকার লড়াই, হলে সিট পাওয়ার সংগ্রাম আর রাজনীতির জটিলতায় বারবার ছন্দপতন ঘটে। এর মধ্যেই তিনি বিসিএস পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। ৩০তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি এবং লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সাক্ষাৎকারের (ভাইভা বোর্ড) মুখোমুখি হন।
কিন্তু ভাইভা বোর্ডে তাঁর জীবনের গল্পকেই ‘নাটক’ বলে অভিহিত করা হয়। মাদ্রাসা থেকে পড়াশোনা করায় তাঁকে রাজনৈতিকভাবে ট্যাগ দেওয়া হয়। কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়েই বোর্ড থেকে তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। সেদিন বৃষ্টির পানির সঙ্গে মিশে গিয়েছিল মেহেদীর চোখের জল। ৩৪তম বিসিএসে আবার অংশ নিলেও ভাইভায় সামান্য কারণে আটকে দেওয়া হয়। পরপর দুটি বিসিএস ভাইভায় ব্যর্থ হয়ে তিনি সব ধরনের চাকরির চেষ্টা করার ইচ্ছা হারিয়ে ফেলেন।
উদ্যোক্তা জীবনের পথে যাত্রা
২০১৪ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত মেহেদী একটি তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানে (আইটি ফার্ম) ম্যানেজারের চাকরি করেন। কিন্তু তাঁর মন পড়ে ছিল নিজের মতো কিছু করার জন্য। ২০২১ সালে চাকরি ছেড়ে গ্রামে ফিরে ছয় বন্ধু মিলে ২৫ বিঘা জমি লিজ নিয়ে শুরু করেন অর্গানিক কৃষি খামার।
এরপর ২০২৪ সালে তিনি ফ্রিল্যান্সিংয়ের জগতে পা রাখেন। স্কিলআপারের প্রতিষ্ঠাতা শামীম হোসেন তাঁকে অনুপ্রেরণা দেন। গুগল অ্যাডস ও ওয়েব অ্যানালিটিকস বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করেন। মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি ফাইভআর, আপওয়ার্ক এবং লিংকডইন থেকে নিয়মিত কাজ পেতে শুরু করেন।
বর্তমানে তিনি এডমেট্রিক্স নামে নিজের একটি ডিজিটাল মার্কেটিং এজেন্সি প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাঁর দলে এখন অনেকেই কাজ করছেন, যাঁরা গুগল অ্যাডস, ওয়েব অ্যানালিটিকস, ওয়েবসাইট ডিজাইন ও এসইও সেবা প্রদান করছেন। এখন তাঁর স্বপ্ন এজেন্সিটিকে আরও বড় করা এবং বহু মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা।
মেহেদী হাসানের মতে, ‘এই ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প প্রমাণ করে, একটি বা দুটি ব্যর্থতা জীবনের শেষ কথা নয়। সঠিক লক্ষ্য, অদম্য ইচ্ছা এবং নিরন্তর প্রচেষ্টা থাকলে যেকোনো পরিস্থিতি থেকেই ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব।