বিধিনিষেধের পরও ভারতীয় সুতা আমদানিতে প্রভাব কম
প্রকাশ: ২৩ আগস্ট, ২০২৫

ভারত থেকে স্থলবন্দর দিয়ে সুতা আমদানি এ বছরের মধ্য এপ্রিলে বন্ধ করে দেয় বাংলাদেশ সরকার। তবে বিধিনিষেধ আরোপের পরও ভারত থেকে সুতা আমদানি কমেছে সামান্যই। কারণ, স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি বন্ধ হওয়ায় সমুদ্রবন্দর দিয়ে সুতা আসতে শুরু করে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যানুযায়ী, স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি বন্ধ হওয়ার আগের তিন মাসের চেয়ে পরের তিন মাসে ভারত থেকে সুতা আমদানি কমেছে ২ লাখ ৩০ হাজার কেজি। আগে দেশটি থেকে প্রতি মাসে গড়ে ৫ কোটি কেজি সুতা আসত। বিধিনিষেধ আরোপের পর মে ও জুন মাসে এসেছে গড়ে ৪ কোটি কেজি। জুলাই মাসে আবার সুতা আমদানি ৫ কোটি কেজি ছাড়িয়ে গেছে।
একাধিক বস্ত্রকলের মালিক বলেছেন, স্থলবন্দরে তদারকির অভাবে ঘোষণার চেয়ে বেশি সুতা দেশে চলে আসত। এমনকি ৩০ কাউন্টের সুতার চালানে ঢুকিয়ে নিয়ে আসা হতো ৮০ কাউন্ট সুতা (সুতার সূক্ষ্মতা ও স্থূলতা পরিমাপ হয় কাউন্ট দিয়ে)। বন্ড সুবিধায় আসা এসব সুতা স্থানীয় বাজারে কম দামে বিক্রি করে দেন অসাধু ব্যবসায়ী তথা আমদানিকারকেরা। তাতে দেশি সুতাকলগুলো বড় লোকসানের মুখে পড়ে। বিধিনিষেধ আরোপের পর ভারত থেকে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে সুতা আমদানি বন্ধ হয়েছে। এতে বাজারে দেশি সুতার চাহিদা বেড়েছে। অনিয়ম পুরোপুরি বন্ধ করতে চট্টগ্রাম বন্দরে সুতার কাউন্ট পরীক্ষায় কড়াকড়ি আরোপ করা দরকার বলে মনে করেন তাঁরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলতি বছরের মার্চের শেষ দিকে বাংলাদেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় স্থলবন্দর দিয়ে সুতা আমদানি বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৫ এপ্রিল বেনাপোল, ভোমরা, সোনামসজিদ, বাংলাবান্ধা ও বুড়িমারী স্থলবন্দর দিয়ে সুতা আমদানির সুবিধা বাতিলের প্রজ্ঞাপন জারি করে এনবিআর। ভারত থেকে সুতা আমদানিতে মিথ্যা ঘোষণা ও কম মূল্যে দামি সুতা আসছে—এমন অভিযোগ করে আসছিলেন বাংলাদেশের বস্ত্র খাতের ব্যবসায়ীরা। তারই পরিপ্রেক্ষিতে স্থলবন্দর দিয়ে সুতা আমদানি বন্ধের সিদ্ধান্ত হয়।
বাংলাদেশে স্থলবন্দর দিয়ে সুতা আমদানি বন্ধের আগে ৯ এপ্রিল ট্রান্সশিপমেন্টের মাধ্যমে ভারতের বন্দর ব্যবহার করে তৃতীয় দেশে বাংলাদেশের পণ্য যাওয়ার ব্যবস্থা প্রত্যাহার করে ভারত। গত ১৭ মে ও ২৭ জুন দুই দফায় পোশাক, খাদ্যপণ্য, পাটপণ্য, তুলা-সুতার বর্জ্য, প্লাস্টিকের পণ্য ও কাঠের আসবাব রপ্তানিতে বিধিনিষেধ দেয় দেশটি। ১১ আগস্ট আরও কিছুসংখ্যক পাটপণ্যে বিধিনিষেধ দেয় ভারত।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ব্যবসায়ী নেতা প্রথম আলোকে বলেন, সুতা আমদানিতে বাংলাদেশের বিধিনিষেধ দেওয়ার পরে ভারত সরকার ট্রান্সশিপমেন্টের মাধ্যমে সে দেশের বন্দর ব্যবহার করে তৃতীয় দেশে বাংলাদেশের পণ্য পাঠানোর সুবিধা প্রত্যাহার করে নেয়।
ভারত থেকে আসে ৪৭ শতাংশ সুতা
তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বিশ্বে দ্বিতীয় শীর্ষ অবস্থানে থাকা বাংলাদেশে পাঁচ শতাধিক সুতাকল বা স্পিনিং মিল রয়েছে। তারপরও প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ সুতা আমদানি করতে হয়। তার প্রায় অর্ধেকই ভারত থেকে আসে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পরিমাণ সুতা আসে চীন থেকে।
এনবিআরের তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে (জানুয়ারি-জুলাই) ৭২ কোটি কেজি সুতা আমদানি হয়। এই সুতা আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ২২০ কোটি মার্কিন ডলার। আমদানি হওয়া সুতার মধ্যে ভারত থেকে ৪৭ শতাংশ বা ৩৪ কোটি কেজি এবং চীন থেকে ৩৮ শতাংশ বা ২৭ কোটি ৬১ লাখ কেজি এসেছে।
চলতি বছরের জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ও মার্চে ভারত থেকে যথাক্রমে ৫ কোটি ৫১ লাখ কেজি, ৫ কোটি ২১ লাখ ও ৫ কোটি ১৩ লাখ কেজি সুতা আমদানি হয়েছে। এপ্রিলে বিধিনিষেধ আরোপ হলে আমদানি কমে ৪ কোটি ৫৭ লাখ কেজিতে নামে। পরের দুই মাস অর্থাৎ মে ও জুনে আসে যথাক্রমে ৪ কোটি ১৫ লাখ ও ৪ কোটি ৫ লাখ কেজি সুতা। আর সর্বশেষ জুলাই মাসে সেটি আবার বেড়ে ৫ কোটি ৩৪ লাখ কেজিতে উন্নীত হয়েছে।
জানা যায়, ভারতের কর্ণাটক, তামিলনাড়ু ও গুজরাট থেকে বাংলাদেশে সুতা আসে। আগে বেনাপোল সীমান্তের আশপাশে সুতা মজুত করা হতো। আমদানি আদেশ পাওয়ার দু–এক দিনের মাথায় পণ্য পাঠিয়ে দিতেন ভারতীয় রপ্তানিকারকেরা। তাতে এক সপ্তাহের মধ্যেই সুতা পেয়ে যেত তৈরি পোশাক কারখানাগুলো। বর্তমানে সমুদ্রবন্দর দিয়ে সুতা আনতে ২০-২৫ দিন পর্যন্ত সময় লেগে যাচ্ছে। যদিও জাহাজে সুতা আনলে খরচ কম পড়ে।
জানতে চাইলে বস্ত্রকল–মালিকদের সংগঠন বিটিএমএর পরিচালক খোরশেদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভারত থেকে সুতা আনা বন্ধ হোক সেটি আমরা চাই না। আমরা শুধু চেয়েছি, মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে বেশি কাউন্টের সুতা আসা বন্ধ হোক। স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি বন্ধ হওয়ার পর বাজারে বেশি কাউন্টের ভারতীয় সুতা পাওয়া যাচ্ছে না। এতে স্থানীয় স্পিনিং মিলের বিক্রি বেড়েছে।’ তারপরও ভারতের সুতা আমদানি কমেনি কেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সুতা রপ্তানিতে ভারতের ব্যবসায়ীরা নগদ সহায়তা পান। সে কারণে তাঁরা বাংলাদেশের চেয়ে কম দামে দিতে পারেন।
বিটিএমএর তথ্যানুযায়ী, দেশে ৫১৯টি স্পিনিং মিল রয়েছে। এসব স্পিনিং মিল নিট কাপড়ের ৮৫-৯০ শতাংশ এবং ওভেন কাপড়ের প্রায় ৪০ শতাংশ সুতা সরবরাহ করে থাকে। তবে কয়েক দফায় গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিতে সুতার উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। গ্যাস–সংকটের কারণেও দেশীয় সুতাকলগুলো ভুগেছে দীর্ঘ সময়।
জানতে চাইলে নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি বন্ধ হওয়ায় ভারত থেকে সুতা আনতে আগের চেয়ে বেশি সময় লাগছে। এতে আমাদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমছে। আসলে আমাদের সমস্যার গভীরে যাওয়া দরকার। ভারত থেকে সুতা আসার বড় কারণ তাদের দাম বাংলাদেশের চেয়ে কেজিতে ২০-৩০ সেন্ট কম। গত বছর বাংলাদেশ সরকার দেশি সুতা ব্যবহার করে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে নগদ সহায়তা কমিয়ে দেওয়ার পর এই ব্যবধান আরও বেড়েছে।’
উদাহরণ দিয়ে মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘আমার প্রতিষ্ঠানের একটি ক্রয়াদেশের জন্য ভারত থেকে যে সুতা ২ ডলার ১২ সেন্টে এনেছি, সেটি বাংলাদেশ থেকে কিনতে ২ ডলার ৬৫ সেন্ট লাগছে। ফলে বস্ত্র খাতকে শক্তিশালী করতে হলে তৈরি পোশাকশিল্পকে বাদ দিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিলে হবে না।’ তাঁর দাবি, স্থলবন্দর দিয়ে সুতা আমদানি বন্ধের সিদ্ধান্তটি কেবল বস্ত্রকল–মালিকদের সঙ্গে আলোচনা করে নিয়েছে সরকার।