প্রকাশ: ৮ আগস্ট, ২০২৫

প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণার পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন আলোচনার কেন্দ্রে নির্বাচন। ভোটের মাঠে প্রতিপক্ষকে টেক্কা দেওয়ার কৌশল ঠিক করার কাজ শুরু করেছে বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল।
তবে জুলাই সনদ, বিচার এবং নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিয়ে সংশয় এখনো কাটেনি বলেও দাবি করছেন অনেকে।
আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে রোজার আগে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি শেষ করতে নির্বাচন কমিশনকে বুধবার চিঠি দিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়। সে অনুযায়ী কাজও শুরু করেছে ইসি।
এছাড়া বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক শেষে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেওয়ার বার্তা দেওয়া হয়েছে।
অন্যতম প্রধান দল বিএনপির নেতারা বলেছেন, ইতোমধ্যে দেশের মানুষ এবং তাদের নেতা-কর্মীরা নির্বাচনমুখী হয়েছেন।
আর নির্বাচনের প্রস্তুতি নিলেও বিভিন্ন দাবিতে সরকারের সঙ্গে আলোচনাও চালাতে চায় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ কয়েকটি দল।
নির্বাচনের আগে সংস্কার ও ছাত্র জনতার হত্যাকাণ্ডের বিচারসহ গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো সরকার কতটা করে, সেদিকেও নজর রাখার কথা বলছে তারা।
এছাড়া নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরিতে সরকার কী পদক্ষেপ নেয়, সেদিকেও গুরুত্ব দিচ্ছে এই দলগুলো।
নির্বাচনের ঘোষণা ইতিবাচক হলেও মাঠের রাজনীতিতে নির্বাচন ঘিরে সংশয় এখনো কাটেনি বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ।
তারা বলছেন, বিদ্যমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে সুষ্ঠু ও গ্রহনযোগ্য নির্বাচন আয়োজন কঠিন হবে।
এছাড়া আওয়ামী লীগের নির্বাচনে অংশ নেওয়া না নেওয়ার বিষয়েও সিদ্ধান্ত নিতে হবে সরকারকে।

ছবির উৎস, CA PRESS WING
ছবির উৎস, CA PRESS WING
রাজনৈতিক দলগুলো যা বলছে
বিবিসি বাংলার সর্বশেষ খবর ও বিশ্লেষণ এখন সরাসরি আপনার ফোনে।
ফলো করুন, নোটিফিকেশন অন রাখুন
বিবিসি বাংলার সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ বিবিসি বাংলার হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেল
নির্বাচনের ঘোষণাকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো। কিন্তু জুলাই ঘোষণাপত্র, সংস্কার প্রক্রিয়া এবং জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার ঘিরে মতভেদ রয়েছে কোনো কোনো দলের মধ্যে। এছাড়া নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিয়েও রয়েছে সংশয়।
অবশ্য অভিযোগ আর সংশয় ছাপিয়ে নির্বাচনের প্রস্তুতিও সেরে রাখছে রাজনৈতিক দলগুলো। তারা বলছে, দাবি আদায়ের চেষ্টা আর ভোটের মাঠের প্রস্তুতি চলবে পাশাপাশি।
জুলাই ঘোষণাপত্র কিংবা নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সীমা নিয়ে আপত্তি নেই বাংলাদেশ জাতিয়তাবাদী দল বিএনপি'র। ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘোষণাকে 'ঐতিহাসিক' বলেও অভিহিত করেছে দলটি।
তাদের দাবি, এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অচলাবস্থা কেটে যাবে।
এরই মধ্যে নির্বাচনের জন্য সাংগঠনিক প্রস্তুতিও শুরু করেছে দলটি। ভোটের মাঠের লড়াইয়ে এগিয়ে থাকতে নিজেদের কর্মপরিকল্পনা ঠিক করতে বৈঠক করেছে বিএনপি'র শীর্ষ নেতৃত্ব।
তারা বলছে, প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণায় দেশের মানুষ নির্বাচনমুখী হয়েছে। নির্বাচনের সময়সীমা দেওয়ার মধ্য দিয়ে, এ নিয়ে যারা ষড়যন্ত্র করছিল তারাও নিরুৎসাহিত হবে বলে মনে করেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন।
তিনি বলছেন, "জনগণ নির্বাচনমুখী হয়ে গেছে। এখন দলগুলোর যাদের নির্বাচন করার ইচ্ছা, যারা মনে করে তাদের প্রতি জনগণের সমর্থন আছে, তাদের উচিৎ মাঠে নেমে নির্বাচনমুখী রাজনীতি করা।"
ভোটের মাস-তারিখ নিয়ে দ্বিমত না থাকলেও জুলাই ঘোষণাপত্র এবং সংস্কার নিয়ে কিছু আপত্তি জানিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামি ও জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল।
তাই বিভিন্ন দাবি নিয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনা এবং নির্বাচনের প্রস্তুতি একসাথে চালানোর কথা বলছে দলগুলো।

ছবির উৎস, CA PRESS WING
ছবির উৎস, CA PRESS WING
সংস্কার প্রক্রিয়ার আইনগত ভিত্তি নিয়ে সংশয়ে জামায়াতে ইসলামী। তারা বলছে, দ্রুত আইনগত বিষয়টি নিশ্চিত করে, এই সংস্কারের ভিত্তিতেই আগামী নির্বাচন হওয়া উচিৎ।
এছাড়া সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সরকারের আরো বেশি কিছু করার রয়েছে বলেও মনে করে দলটি।
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বিবিসি বাংলাকে বলেন, "ইলেকশন যদি ফেয়ার না হয় পার্টিসিপেটরি (অংশগ্রহণমূলক) না হয়, লোকেরা যদি স্বাচ্ছন্দে ভোট দিতে না পারে তাহলে তো এই নির্বাচন আবারো প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যাবে।"
সংস্কার ও বিচার নিয়ে দাবিদাওয়া থাকলেও নির্বাচনের প্রস্তুতি আগেভাগেই শুরু করেছে জামায়াতে ইসলামী। তিনশ আসনে প্রার্থী ঠিক করার বিষয়টিও অতীতে জানানো হয়েছিল দলটির পক্ষ থেকে।
মি. তাহের বিবিসি বাংলাকে বলেন, "নির্বাচনের জন্যে আমরা প্রস্তুত আছি, কিন্তু নির্বাচনটা সুষ্ঠু হবে কিনা- এ ব্যাপারে আমরা সন্দিহান। কারণ নির্বাচনের উপযুক্ত যে পরিবেশ থাকার কথা ছিল, তা সরকার এখনো নিশ্চিত করতে পারেনি, " বলেন তিনি।
এদিকে, জুলাই সনদ ও ঘোষণাপত্রের কার্যকারিতার ভিত্তিতে সামনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে বলে আবারো দাবি জানিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি।
জুনের মধ্যে যেকোনো সময় নির্বাচন আয়োজন করা হলে তাদের কোনো আপত্তি নেই বলেও জানিয়েছেন দলটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন।
তিনি বলছেন, রাজনৈতিক দল হিসেবে আমাদেরও নির্বাচনের প্রস্তুতি রয়েছে, কিন্তু নির্বাচন আয়োজনের আগে সংস্কার ও বিচারকাজ বাস্তবায়নসহ অবশ্য পালনীয় কাজগুলো সরকার কতটা দৃশ্যমান করে সেদিকে নজর রাখবেন তারা।

সুষ্ঠু ও গ্রহনযোগ্য নির্বাচন আয়োজনই চ্যালেঞ্জ
প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণা অনুযায়ী চলতি বছরের ডিসেম্বর মাস লক্ষ্য করে নির্বাচনের প্রস্তুতির কথা আগেই জানিয়েছিল নির্বাচন কমিশন।
পাঁচই অগাস্ট জাতীর উদ্দেশে ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়ার পর থেকেই আনুষ্ঠানিক প্রস্তুতি শুরু করেছে ইসি।
নির্বাচন নিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ও। বুধবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে উচ্চপর্যায়ের বৈঠক। বৈঠকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এখন পর্যন্ত ভোট ঘিরে কতটুকু প্রস্তুতি শেষ করতে পেরেছে, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
এছাড়া বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক থেকে জাতিকে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেওয়ার বার্তা দেওয়া হয়েছে। নির্বাচনের ঘোষণার মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু হয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়।
এদিকে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহনযোগ্য নির্বাচন আয়োজনে নির্দেশনা দিয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে চিঠি পাওয়ার পরই গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ও নির্বাচনের আচরণবিধি নিয়ে বৈঠক করেছে নির্বাচন কমিশন।
আগামী বছর ফেব্রুয়ারিতে রমজান মাস শুরুর আগেই নির্বাচন আয়োজনে সব ধরনের তোড়জোড় শুরু হলেও নির্বাচন ঘিরে এখনো সংশয় কাটেনি বলেই মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে।
তারা বলছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রকাশ্য দুরত্ব এতটা বাড়েনি, যাতে নির্বাচন না হওয়ার মতো কোনো সংকট তৈরি করবে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বর্তমান প্রেক্ষাপট সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, "আমার মনে হয় না সংকটের কোনো পরিস্থিতি তৈরি হবে। কিন্তু নির্বাচনকালীন সময়ে ল এন্ড অর্ডারের ইস্যুটা নিয়ে সংশয় আছে।"
জুলাই অভ্যুত্থানের সময় বিভিন্ন থানা থেকে লুট হওয়া অনেক অস্ত্রও এখনো সব উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি, পুলিশ বাহিনী সবাই এখনো কার্যকর ও নিরপেক্ষ ভূমিকা রাখবে কিনা, এ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে বলেও মনে করেন মি. আহমেদ।
তিনি বলছেন, "সরকারকে নির্বাচনটা করতে হইলে আর্মির ওপরই নির্ভর করতে হবে। আর্মির সাথে অন্য বাহিনীগুলো যদি অ্যাকটিভ থাকে, তাহলে হয়তো নির্বাচন ফ্রি, ফেয়ার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।"
এছাড়া নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে অংশগ্রহনের সুযোগ দেওয়া হবে কিনা, সে বিষয়েও সরকারকে সিদ্ধান্ত নিয়ে হবে, বলেন তিনি।