প্রকাশ: ২৭ আগস্ট, ২০২৫

১৯৩৪ সালের ১ জানুয়ারি কলকাতার ক্রাউন থিয়েটারে মুক্তি পায় ‘ধ্রুব’। নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষের ভক্ত ধ্রুব অবলম্বনে ছবিটি পরিচালনা করেছেন কাজী নজরুল ইসলাম ও সত্যেন্দ্রনাথ দে।
সুর দেওয়া ও গান গাওয়ার পাশাপাশি সিনেমাটিতে একটি চরিত্রে অভিনয়ও করেন কবি। মাথায় ঝাঁকড়া চুল, গলায় মালা, পরনে সিল্কের লম্বা কুর্তা—নারদ চরিত্রে দর্শকদের রীতিমতো চমকে দিয়েছিলেন নজরুল।
সিনেমাটি কেন গুরুত্বপূর্ণ
চলচ্চিত্র গবেষকেরা বলছেন, কাজী নজরুল ইসলামই প্রথম বাঙালি মুসলমান চিত্রপরিচালক। ‘ধ্রুব’ তাঁর নির্মিত একমাত্র চলচ্চিত্র। ফলে চলচ্চিত্রটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে।
‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিকথা’ বইয়ে চলচ্চিত্র গবেষক অনুপম হায়াৎ লিখেছেন, ‘কাজী নজরুল ইসলামই প্রথম বাঙালি মুসলিম চিত্রপরিচালক। এর আগে আর কোনো বাঙালি মুসলিম পরিচালকের নাম শোনা যায়নি।’
‘চলচ্চিত্র জগতে নজরুল’ নামে এ বিষয়ে একটা বইও লিখেছেন অনুপম হায়াৎ। তিনি গত রোববার প্রথম আলোকে বলেন, ‘তিনি (কাজী নজরুল ইসলাম) পাইওনিয়ার (অগ্রদূত)। তিনি সমাজের প্রচলিত ব্যারিয়ার (বাধা) ভেঙেছেন।’
সবাক যুগের প্রথম দিককার চলচ্চিত্র হিসেবে ‘ধ্রুব’ সিনেমাটি বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ।
চলচ্চিত্র বিশ্লেষকেরা বলছেন, ১৯৩১ সালে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম সবাক হিন্দি চলচ্চিত্র ‘আলম আরা’ নির্মিত হয়। একই বছর কলকাতায় মুক্তি পায় প্রথম সবাক বাংলা চলচ্চিত্র ‘জামাই ষষ্ঠী’। সবাক যুগের প্রথম দিককার চলচ্চিত্র হিসেবে ‘ধ্রুব’ সিনেমাটি বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ। এরও দুই দশক পর ১৯৫৬ সালে ঢাকায় মুক্তি পায় এই অঞ্চলের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সবাক সিনেমা ‘মুখ ও মুখোশ’।
পৌরাণিক কাহিনি অবলম্বনে নির্মিত সিনেমাটিকে লুফে নিয়েছিলেন কলকাতার দর্শকেরা। কলকাতার চলচ্চিত্রতাত্ত্বিক ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম স্টাডিজ বিভাগের সাবেক অধ্যাপক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় গত সোমবার প্রথম আলোকে জানান, সিনেমাটি কলকাতায় মুক্তির পর জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। সিনেমার কাহিনি ও সংগীতের জন্য দর্শকের কাছে সমাদৃত হয়েছিল। সবাক যুগের গোড়ার দিকে যে কয়েকটি বাংলা ছবি সফল হয়েছিল, তার মধ্যে রয়েছে ধ্রুব।
ঢাকার চলচ্চিত্র গবেষক মীর শামছুল আলম গতকাল প্রথম আলোকে জানান, সিনেমাটি সেই সময় ঢাকায়ও মুক্তি পেয়েছিল। সিনেমাটি মোটামুটি চলেছিল।
সিনেমাটি কলকাতায় মুক্তির পর জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। সিনেমার কাহিনি ও সংগীতের জন্য দর্শকের কাছে সমাদৃত হয়েছিল।সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়, চলচ্চিত্রতাত্ত্বিক
ত্রিশের দশকজুড়ে চলচ্চিত্রে নজরুলকে নানা পরিচয়ে পাওয়া গেছে—কখনো গীতিকার, কখনো সুরকার, কখনোবা অভিনেতা। পরিচালক নজরুলকে নিয়ে আলাপে–আড্ডায় ঘুরেফিরে ধ্রুবই সামনে আসে। ছবিটি মুক্তির প্রায় ছয় বছর পর মদিনা নামে আরেকটি চলচ্চিত্র পরিচালনার ঘোষণা দিয়েছিলেন নজরুল। তবে ১৯৪২ সালে অসুস্থ হওয়ায় সেটি আর করতে পারেননি।
একসময় কলকাতার ম্যাডান থিয়েটার কোম্পানিতে ‘সুরভান্ডারি’ পদে চাকরি করতেন নজরুল। তাঁর মূল কাজ ছিল অভিনয়শিল্পীদের কণ্ঠ, সুর ও আবৃত্তি পরীক্ষার মাধ্যমে সবাক চলচ্চিত্রের জন্য উপযুক্ত করে তোলা। একসময় সম্মানী নিয়ে টালবাহানায় ম্যাডান থিয়েটার কোম্পানি ছেড়ে দেন, পরে ম্যাডানের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান পাইওনিয়ার ফিল্মসের ব্যানারে ‘ধ্রুব’ চলচ্চিত্রে যুক্ত হন নজরুল।
সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘নজরুলকে নেওয়ার কারণ, তিনি অসাধারণ গাইতে পারতেন। শিল্পীদের তখন ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে গাইতে হতো। সেটা নজরুল দারুণভাবে পারতেন।’
ধ্রুবর চিত্রগ্রহণ করেন টি মার্কিনি। নজরুল ছাড়াও জয়নারায়ণ মুখার্জি, মাস্টার প্রবোধ, মিস ভায়োলেট, পারুলবালা, তুলসী চক্রবর্তী, আঙ্গুরবালা, নিত্যানন্দ ঘটকসহ আরও অনেকে অভিনয় করেছেন।
‘ধ্রুব’ সিনেমাটি সত্যজিৎ রায়েরও নজর কেড়েছিল। ১৯৫৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘অপুর সংসার’ চলচ্চিত্রে ‘ধ্রুব’ সিনেমার অংশবিশেষ ব্যবহার করেছেন সত্যজিৎ রায়।
সিনেমাটি সত্যজিৎ রায়েরও নজর কেড়েছিল। ১৯৫৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘অপুর সংসার’ চলচ্চিত্রে ‘ধ্রুব’ সিনেমার অংশবিশেষ ব্যবহার করেছেন সত্যজিৎ রায়। ‘অপুর সংসার’ সিনেমার একটি দৃশ্যে দেখা গেছে, অপু (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়) ও অপর্ণা (শর্মিলা ঠাকুর) প্রেক্ষাগৃহে সিনেমা দেখতে গেছে। সেই ছবিই ছিল ‘ধ্রুব’। প্রেক্ষাগৃহের পর্দায় ‘ধ্রুব’ চলচ্চিত্রের অংশবিশেষ দেখানো হয়েছে।
সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘আদি সবাক বাংলা সিনেমার হিসেবে ধ্রুব সিনেমাটি দেখিয়েছেন সত্যজিৎ রায়।’
বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভে ছবিটির একটি রিল (১০ মিনিট) রয়েছে।
ছবিটি কোথায়?
সিনেমাটির খোঁজখবর জানতে কাজী নজরুল ইসলামের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রথম আলো। নজরুলের দৌহিত্রী ও সংগীতশিল্পী খিলখিল কাজী জানান, সিনেমাটি তাঁদের সংগ্রহে নেই।
ঢাকার কবি নজরুল ইনস্টিটিউট জানিয়েছে, ধ্রুবসহ কাজী নজরুলের কোনো ছবিই প্রতিষ্ঠানটির সংগ্রহে নেই।
মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন কর্মকর্তারা সিনেমাটির মর্ম বুঝতে পারেননি। মন্ত্রণালয় থেকে টাকা না পাওয়ায় রিলগুলো আর কেনা যায়নি।’অনুপম হায়াৎ, চলচ্চিত্র গবেষক
বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভে ছবিটির একটি রিল (১০ মিনিট) রয়েছে। রিলটি কীভাবে ফিল্ম আর্কাইভে এল? মীর শামছুল আলম জানান, ফিল্ম আর্কাইভ প্রতিষ্ঠার পর কিউরেটর এ কে এম আবদুর রউফ কলকাতায় ১৯ রিলের চলচ্চিত্রের খোঁজ পান। তবে সংগ্রাহক টাকা ছাড়া রিলগুলো দিতে চাননি, এর মধ্যে একটি রিল সংগ্রহ করেন আবদুর রউফ। ঢাকায় আসার পর তথ্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেও কোনো টাকা পাননি তিনি, ফলে চলচ্চিত্রটি বাংলাদেশে আসেনি।
অনুপম হায়াৎ বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন কর্মকর্তারা সিনেমাটির মর্ম বুঝতে পারেননি। মন্ত্রণালয় থেকে টাকা না পাওয়ায় রিলগুলো আর কেনা যায়নি।’
অনলাইনে সাদা–কালো সিনেমাটির দুয়েকটি ‘ক্লিপ’ পাওয়া যায়; তবে পুরো পাওয়া যায়নি।
চলচ্চিত্রটি একসময় ন্যাশনাল ফিল্ম আর্কাইভ অব ইন্ডিয়ার সংরক্ষণের তালিকায় ছিল। তবে এখন আর ওয়েবসাইটে সংরক্ষণের তথ্য নেই।
গবেষকেরা বলছেন, ছবিটির সংরক্ষণ করা জরুরি। তাঁদের ধারণা, এখনো খুঁজলে চলচ্চিত্রটি উদ্ধার করা সম্ভব।
২০২০ সালে প্রকাশিত টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে জানা যায়, ধ্রুব সিনেমার নেগেটিভ কলকাতার এনটিওয়ান স্টুডিওতে রয়েছে। তবে লকডাউনের মধ্যে পর্যাপ্ত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে স্পুলগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। এনটিওয়ানের পরিচালক সৌগত নন্দী সে সময় টাইমস অব ইন্ডিয়াকে বলেছিলেন, ছবিটি দুর্লভ। ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনা করে ছবিটির স্বত্ব তাঁরা নিয়েছিলেন।
পাঁচ বছর পর নেগেটিভগুলো কী অবস্থায় আছে, জানতে প্রথম আলোর তরফ থেকে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও সাড়া মেলেনি।
অনলাইনে সাদা–কালো সিনেমাটির দুয়েকটি ‘ক্লিপ’ পাওয়া যায়; তবে পুরো পাওয়া যায়নি।