Advertisement

গাজায় ছয় বছরের ফিলিস্তিনি শিশু হিন্দ রজবের সঙ্গে সেদিন কী ঘটেছিল

প্রথম আলো

প্রকাশ: ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

24obnd

হিন্দ রজবের বয়স ছয় বছর। এই বয়সে তার আনন্দ, কোলাহলে মেতে থাকার কথা ছিল। দুরন্ত শিশুটির ছুটে চলার কথা ছিল। ডানা মেলে ওড়ার কথা ছিল। হাজারো স্বপ্ন নিয়ে রজবের বেঁচে থাকার কথা থাকলেও শিশুটি ভয়ার্ত স্বরে বেঁচে থাকার বায়নাও ধরেছিল। ঘণ্টা ধরে মুঠোফোনে একটাই আকুতি জানিয়েছিল, বেঁচে থাকার।

গত বছর ইসরায়েল সৈন্যদের হাত থেকে বাঁচতে পারেনি শিশুটি। সেই ছয় বছরের শিশুটিকে নৃশংসভাবে হত্যা করেন ইসরায়েলের সৈন্যরা। বাঁচার আকুতির সেই কণ্ঠস্বরগুলোর রেকর্ডিং স্মৃতি হয়ে রয়ে গেছে। সেই কণ্ঠস্বরের রেকর্ডিংগুলো দিয়ে নতুন করে বিশ্বব্যাপী মানুষের মধ্যে জেগে উঠল হিন্দ রজব। গত বছরের আলোচিত ঘটনা নিয়ে তৈরি হয়েছে সিনেমাটি। অনেকটা তথ্যচিত্রের মতো করেই এটি নির্মিত।
হিন্দ রজবকে নিয়ে চলতি বছর নির্মিত হয়েছে তিনটি সিনেমা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয় ‘দ্য ভয়েস অব হিন্দ রজব’ সিনেমাটি। ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শনী ও সমাপনী দিনে গ্র্যান্ড জুরি পুরস্কারের পর সিনেমাটি তুমুল আলোচিত হয়। ছয় বছরের রজবের কণ্ঠ যেন প্রতিবাদী হয়ে সামনে আসে। বার্তা দেয়, বিশ্বজুড়ে গণহত্যা বন্ধ হোক।

সিনেমায় হিন্দ রজবের কোনো উপস্থিতি ছিল না। তাকে কোনো ফ্রেমে দেখা যায়নি। সিনেমাজুড়ে ছিল শুধু তার কণ্ঠ, যা গত বছরই বিভিন্ন সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছিল। সেই কণ্ঠই শত শত দর্শক–সমালোচককে কাঁদিয়েছে।

সিনেমায় হিন্দ রজবের কোনো উপস্থিতি ছিল না। তাকে কোনো ফ্রেমে দেখা যায়নি। সিনেমাজুড়ে ছিল শুধু তার কণ্ঠ, যা গত বছরই বিভিন্ন সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছিল। সেই কণ্ঠই শত শত দর্শক–সমালোচককে কাঁদিয়েছে। বিবিসিতে সিনেমাটির সমালোচনায় নিকোলাস বার্বার লিখেছেন, ‘সিনেমাটি সাংবাদিক, ইন্ডাস্ট্রির পেশাদারদের ভেনিস উৎসবে দেখানো হয়। সিনেমায় দূরের কণ্ঠস্বর শোনা গেছে। কাছে দেখেছি কান্না। কেউ কেউ ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন। কারও চোখ লাল হয়ে যায়। সবাই ছিল চুপচাপ, কথা বলার মতো অবস্থায় ছিলেন না কেউই।’

৮৯ মিনিটের সিনেমাটিতে কী রয়েছে
ফিলিস্তিনি রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির (পিআরসিএস) জরুরি নম্বরে হঠাৎ একটি ফোনকল আসে। ছয় বছরের একটি শিশু গাড়ির মধ্যে আটকা পড়েছে। শিশুটি ফোন করে তাকে বাঁচানোর আকুতি জানিয়েছিল। ভয়ার্ত কণ্ঠে শিশুটি জানায়, গাড়িটি তখনো আগুনে জ্বলছে। সেই গাড়ির মধ্যে সে। শুধু তা–ই নয়, গাড়িতে থাকা মানুষেরাও মারা গেছে। রেড ক্রিসেন্ট থেকে ৫২ মাইল দূরে আটকে পড়া শিশুটিকে উদ্ধারের গল্পটি বিশ্বব্যাপী আলোচনায় আসে। ভ্যারাইটি থেকে জানা যায়, সিনেমায় শিশুটির ফোন করে বাঁচতে চাওয়ার আকুতির কণ্ঠস্বর অরিজিনাল ফোনকল রেকর্ডিং।

ঘটনার সূত্রপাত
কী ঘটেছিল—এ নিয়ে আল–জাজিরা সিনেমাটির রিভিউতে লিখেছে, চাচা-চাচি আর চার চাচাতো ভাইবোনের সঙ্গে গাজা সিটি থেকে পালিয়ে পার্শ্ববর্তী তাল আল-হাওয়া শহরের দিকে যাচ্ছিল তারা। পথে রজবদের বহনকারী গাড়িটি ইসরায়েলি ট্যাংকের মুখে পড়ে। পাশ থেকে গোলাগুলির শব্দও শোনা যেতে থাকে। কী হতে পারে, ঘটনা আঁচ করতে পেরে হিন্দের চাচা সঙ্গে সঙ্গে ফোন করেন জার্মানির এক আত্মীয়কে। তাঁকে জানান, তাঁরা বিপদে রয়েছেন। পরে ঘটনাটা ক্রিসেন্ট সোসাইটি জানানো হয়। দ্রুত তারা এই বিপদে থাকা পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে থাকে। কিন্তু পিআরসিএস কল কিছুটা বাধাগ্রস্ত হয়। ততক্ষণে গাড়িতে হামলা করা হয়েছে। তখন হিন্দ ও তার ১৫ বছর বয়সী চাচাতো বোন লিয়ান বেঁচে ছিল।

হিন্দ রজবের কাজিন লিয়ানের সঙ্গে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির সদস্যদের কথা হয়। লিয়ান পিআরসিএসকে ফোন দিয়ে জানায়, তাদের গাড়ির কাছেই ইসরায়েলের কয়েকটি ট্যাংক। ১৫ বছরের লিয়ানের পরবর্তী সময়ে প্রকাশ পাওয়া সেই অডিওতে ভয় আর কান্নার স্বরে লিয়ান বলতে থাকে, ‘আমি আর হিন্দ বেঁচে আছি। আমার মা-বাবা, আমার বোনেরা সবাই মারা গেছে।’ লিয়ান বলে, ‘তারা আমাদের ওপর গুলি করছে। ট্যাংকটি আমার পাশে দাঁড়িয়ে। সেখানে ফিলিস্তিনিরা। তারা আমাদের গাড়ির দিকে এগিয়ে আসছে।’

শিশুটি গাড়িতে একাই আটকে রয়েছে। ছয়জন মৃত মানুষের পাশে একটা ছয় বছরের জীবিত শিশু। হিন্দকে ফোনে পাওয়া যায়। সে ভয়ে কথা বলতে পারছিল না। ভয়ে আর আতঙ্কে একসময় বলতে থাকে, ‘প্লিজ এখানে আসো, আমাকে বাঁচাও।’

একা শিশুটির বেঁচে থাকার সংগ্রাম
এমন সময় অডিওতে প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়। বাধাগ্রস্ত হয় ফোনকল। একসময় শুধু শোনা যায় শিশুটির চিৎকার। একাধিক গোলাগুলির পর চিৎকারও বন্ধ হয়ে যায়। ফোনটি কেটে গেলে রেড ক্রিসেন্টের সদস্য ওমর একই নম্বরে সঙ্গে সঙ্গে কল ব্যাক করে। সে সময়ই রেড ক্রিসেন্টের সদস্যরা জানতে পারেন, গাড়িতে থাকে সবাই মারা গেছে। জীবিত শুধু ছয় বছরের শিশু হিন্দ। শিশুটি গাড়িতে একাই আটকে রয়েছে। ছয়জন মৃত মানুষের পাশে একটা ছয় বছরের জীবিত শিশু। হিন্দকে ফোনে পাওয়া যায়। সে ভয়ে কথা বলতে পারছিল না। ভয়ে আর আতঙ্কে একসময় বলতে থাকে, ‘প্লিজ এখানে আসো, আমাকে বাঁচাও।’

শিশুটি তখনো ট্যাংকের থেকে গুলির শব্দ শুনছিল। সেটা শিশুটির একদমই পেছনে ছিল। একসময় ট্যাংক এগিয়ে এলে শিশুটি চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। রেড ক্রিসেন্টের সেই ফোনকলটি আবার কেটে যায়। তখন তারা ধারণা করেছিল, হয়তো এবার শিশুটি আর বেঁচে নেই। পরে তাকে আবার ফোনে পাওয়া যায়। শিশুটি এবার জানায়, চারপাশে অন্ধকার। তার ভয় লাগছে। কিন্তু ভালো করে কোনো কিছুই তখনো শোনা যাচ্ছিল না। সে সময় ওই এলাকায় ইন্টারনেটের সমস্যা দেখা দেয়। একসময় কারও কোনো কথাই বোঝা যায় না। তবে রেড ক্রিসেন্টের সদস্যরা তখন হঠাৎ ড্রোনের শব্দ শুনতে পান। তেমন কিছু বোঝা না গেলেও তাঁরা শিশুটির উদ্দেশে বলেন গাড়িতে থাকতে। বাইরে বের হলে তার সঙ্গে খারাপ কিছু হতে পারে। তাকে লাঞ্ছিতও করতে পারে ফিলিস্তিনিরা।

কিছুটা সময় নেটওয়ার্কের সিগনাল পাওয়া যায় না। কোনোভাবেই যোগাযোগ করা যাচ্ছিল না। এদিকে অ্যাম্বুলেন্স তৈরি হচ্ছে যাওয়ার জন্য। তারা শিশুটির ফোনকলের অপেক্ষা করে। ধরেও নেয়, শিশুটিকে হয়তো আর পাওয়া যাবে না। তারাও আতঙ্কের মধ্যে সময় কাটায়। পরে শিশুটিকে ফোনে পাওয়া যায়। তখন রেড ক্রিসেন্টের এক সদস্য ও শিশুটি একসঙ্গে সুরা ইখলাস পাঠ করেন। শিশুটি রেড ক্রিসেন্টের সদস্যের সঙ্গে ভয়ে ভয়ে পাঠ করে, ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম...।’ পরে শিশুটি সাহায্যের জন্য বারবার অনুরোধ করে। এ ঘটনা রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের কাঁদিয়েছিল।

অ্যাম্বুলেন্স পাঠানো কঠিন হয়ে যায়
কিন্তু একদমই যুদ্ধের মধ্যে অ্যাম্বুলেন্স পাঠানো অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। তারা নানাভাবে শিশুটিকে সহায়তার চেষ্টা করে। তারা আগে থেকেই জানত, ইসরায়েল সেখানে অ্যাম্বুলেন্স প্রবেশে বাধা দিতে থাকে। তবু চেষ্টা চলতে থাকে। গত বছর রেড ক্রিসেন্টের সদস্যরা জানিয়েছিলেন, এমন পরিস্থিতিতে গত চার মাসের মধ্যে তাঁরা পড়েননি। পরে অ্যাম্বুলেন্স পাঠানো হয়। এদিকে হিন্দকে ফোনে নানাভাবে সান্ত্বনা দেওয়া হয়, যেন ভেঙে না পড়ে। যেন ভয় না পায়। কারণ, তখনো মনে করা হচ্ছিল, হিন্দ রজবকে উদ্ধার করা সম্ভব। এরই মধ্যে বোমা বিস্ফোরণের শব্দ হয়। সঙ্গে সঙ্গে রেড ক্রিসেন্টের সদস্যদের সঙ্গে হিন্দের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। কেটে যায় ফোনকলটি। তাহলে হিন্দের কী হলো?

রেড ক্রিসেন্টের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলার বেশ কিছু অডিও গত বছর বিশ্বব্যাপী ভাইরাল হয়। সেই অরিজিনাল অডিও সংগ্রহ করেন পরিচালক। সেটা দিয়েই নির্মিত সিনেমা ‘দ্য ভয়েস অব হিন্দ রজব’ ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে প্রিমিয়ারের পর ২৩ মিনিট করতালি পায়। এমন ঘটনা খুবই কম ঘটে। একই সঙ্গে সিনেমাটি দেখে আপ্লুত হন দর্শক, সমালোচকেরা। দর্শকেরা হিন্দের ভয়েস শুনে ইমোশনাল হয়ে যান। শেষ সময়েও শিশুটি বারবার বাঁচার আকুতি জানিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত আর ছয় বছরের শিশুটি বাঁচতে পারেনি।

১২ দিন পর মেলে শিশুর লাশ
এই উদ্ধারের সঙ্গে যুক্ত রেড ক্রিসেন্টের সব সদস্যের কাছে এটা ছিল জীবনের ভিন্ন এক অভিজ্ঞতা। তাদের কেউ এক থেকে দেড় যুগ কাজ করেও এমন ঘটনার মুখোমুখি হননি। সেদিন হিন্দের সঙ্গে অ্যাম্বুলেন্সের দুজন উদ্ধারকর্মীও নিখোঁজ হন। তাঁদের লাশ খুঁজে পেতেও দীর্ঘ সময় লেগে যায়। ১২ দিন পরে মিলেছিল শিশুটির লাশ। ইসরায়েলি সৈন্যরা শিশুটিকে হত্যা করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট, আল–জাজিরাসহ একাধিক গণমাধ্যমে খবরটি আলোচিত হয়।

‘সিনেমা হিন্দকে ফিরিয়ে আনতে পারবে না। এমনকি এটি তার ওপর সংঘটিত নৃশংসতা মুছে ফেলতে পারে না। যা–ই ঘটুক, কোনো কিছু কখনো পুনরুদ্ধার করতে পারা যায় না। কিন্তু সিনেমা পারে কণ্ঠকে ধরে রাখতে, সিনেমা পারে সীমানাজুড়ে প্রতিধ্বনি ছড়িয়ে দিতে। তার কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত হতে থাকবে যতক্ষণ না জবাবদিহি বাস্তবায়িত না হয়, যতক্ষণ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা না হয়।’
পুরস্কার হাতে নিয়ে পরিচালক কাওথের বেন হানিয়া বলেন,

আলোচিত শিশুর বেঁচে থাকার আকুতির গল্পটি ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে এবার গ্র্যান্ড জুরি পুরস্কার পেয়েছে। ‘দ্য ভয়েস অব হিন্দ রজব’ সিনেমার পুরস্কার হাতে নিয়ে পরিচালক কাওথের বেন হানিয়া বলেন, ‘সিনেমা হিন্দকে ফিরিয়ে আনতে পারবে না। এমনকি এটি তার ওপর সংঘটিত নৃশংসতা মুছে ফেলতে পারে না। যা–ই ঘটুক, কোনো কিছু কখনো পুনরুদ্ধার করতে পারা যায় না। কিন্তু সিনেমা পারে কণ্ঠকে ধরে রাখতে, সিনেমা পারে সীমানাজুড়ে প্রতিধ্বনি ছড়িয়ে দিতে। তার কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত হতে থাকবে যতক্ষণ না জবাবদিহি বাস্তবায়িত না হয়, যতক্ষণ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা না হয়।’

Lading . . .