Advertisement

যত্নে বাড়ে মোটরসাইকেলের আয়ু, কমে খরচ

প্রথম আলো

প্রকাশ: ২২ আগস্ট, ২০২৫

নিয়মিত যত্ন নিতে হবে মোটরসাইকেলেরফাইল ছবি
নিয়মিত যত্ন নিতে হবে মোটরসাইকেলেরফাইল ছবি

প্রায় আট বছর ধরে একটি স্বনামধন্য মোটরসাইকেল নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের বাইক চালাচ্ছেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার আহসান উল আলম। ‘যতনে রতন মেলে’ নীতিতে বিশ্বাস রেখে তিনি নিয়মিত কিছু নিয়মকানুন মেনে চলেন। ‘শখের বাহন যেন না হয় কষ্টের কারণ’—এ জন্য প্রতিবার মোটরসাইকেল চালানোর আগে ও পরে তিনি নিজের বাইকের যত্ন আত্তি করেন। এত বছর ব্যবহারের পরেও তাঁর বাইক এখনো নতুনের মতো চলছে। মোটরসাইকেল নিরাপদে ও নিশ্চিন্তে চালানোর পাশাপাশি নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করা হলে বছরের পর বছর, মাইলের পর মাইল পাড়ি দেওয়া যায়। খরচও হয় না তেমন একটা। এই প্রতিবেদনে জেনে নেওয়া যাক মোটরসাইকেলের যত্ন নেওয়ার সহজ কৌশল।

নিজেকে পরিপাটি রাখতে যেমন সবাই পছন্দ করে, তেমনি নিজের বাহনকেও পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন রাখলে চলাচলে স্বাচ্ছন্দ্য মেলে। মোটরসাইকেল নিয়ে বের হওয়ার আগে বাহনটি চালু করে ১ থেকে ২ মিনিট থ্রটল না বাড়িয়ে রাখা ভালো। এতে ইঞ্জিন অয়েল ঠিকমতো যন্ত্রাংশে পৌঁছাতে পারে। চালু করে বাইকটিকে একটি ফাইবার কাপড়ের সাহায্যে পরিষ্কার করা যায়। রং আছে এমন অংশগুলো না মুছে ঝেড়ে নিলে ছোট ছোট দাগ পড়া থেকে মুক্তি মেলে। এ ছাড়া আসন এবং লোহার তৈরি জিনিসগুলো মুছে ফেলতে হবে। ধুলাবালু লেগে থাকলে তা পরিষ্কার হয়ে বাইকটি চকচক করবে। মোটরসাইকেল চালানোর আগে ইলেকট্রনিকস যন্ত্রাংশ যেমন হর্ন, সিগন্যাল লাইট, হেডলাইট, টেইল লাইট, পাসিং লাইট, ব্রেকলাইটসহ টায়ারে হাওয়ার চাপ, চেইনে ঠিকমতো লুব্রিকেন্ট করা আছে কি না, দেখে নিতে হবে। চাকায় ঠিকমতো হাওয়া থাকলে বাইকের জ্বালানি কম খরচ হবে। চেইন শুষ্ক থাকলে খটখট আওয়াজ বা ইঞ্জিনের শক্তি বেশি খরচ হবে।

তরুণদের কাছে মোটরবাইক শুধু একটি যান নয়, বরং স্টাইল, স্বাধীনতা আর গতির প্রতীক। তবে এই স্বাধীনতা ও গতির সঙ্গীটিকে ঠিকভাবে রক্ষা না করলে সেটি হয়ে উঠতে পারে ঝামেলার কারণ। মোটরসাইকেল চালানো যেমন রোমাঞ্চকর, তেমনি এর যত্ন নেওয়াটাও জরুরি। তাই প্রতি মাসে অন্তত একবার মোটরসাইকেলটি ভালো করে ধুয়ে ফেলা উচিত। বর্ষাকালে অথবা কর্দমাক্ত রাস্তায় চালানো হলে ১৫ দিন পরপর ধুয়ে নিতে হবে। এ ছাড়া যদি সম্ভব হয়, ইঞ্জিন বা চাকার অংশগুলোয় নিয়মিত পানি দিয়ে পরিষ্কার করা যেতে পারে। মোটরচালিত মেশিনের মাধ্যমে ধোয়ার সময় মনে রাখতে হবে, পানির চাপ যেন অতিরিক্ত না হয়। এতে ইলেকট্রনিকস অংশে পানি প্রবেশের সুযোগ থাকে। বাইক ধুয়ে নেওয়ার পর পরিষ্কার কাপড় দিয়ে মুছে ফেলতে হবে। এতে ছোপ ছোপ দাগ পড়ার হাত থেকে রং ও ধাতব অংশগুলো রক্ষা পাবে। অনেক গ্যারেজে ১০০ থেকে ১৫০ টাকায় ফোম ওয়াশ করে মোটরবাইক ধোয়ানো যায়। ইঞ্জিন গরম থাকা অবস্থায় বাইক ধোয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।

চাকার ওপর ভর করেই মোটরসাইকেল এগিয়ে যায়। স্বাচ্ছন্দ্যে বাইক চালাতে হাওয়ার মাপ ঠিক থাকা চাই। বাইকের চেইন গার্ডের ওপরে অথবা চাকার আশপাশে নির্ধারিত হাওয়ার মাপ উল্লেখ করা থাকে। বেশির ভাগ সময় আরোহীসহ বাইক চালালে হাওয়ার চাপ কিছুটা বেশি রাখতে হয়। স্বাভাবিকভাবে পেছনের চাকার তুলনায় সামনের চাকায় হাওয়ার চাপ কম রাখতে হয়। অতিরিক্ত হাওয়ার চাপের কারণে চলার সময় বাইক লাফাতে পারে।

সাধারণত সামনের চাকায় ২৮–৩০ পিএসআই (পাউন্ড পার স্কয়ার ইঞ্চ) এবং পেছনের চাকায় ৩৩–৩৭ পিএসআই হাওয়া দিতে হবে। কম হাওয়ায় নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয় এবং ইঞ্জিনকে বেশি শক্তি প্রদান করতে হয়। এখন পোর্টেবল হাওয়ার মেশিন পাওয়া যায়। গ্যারেজে না গিয়েও এই মেশিনের মাধ্যমে চাকায় হাওয়ার চাপ প্রদানের পাশাপাশি সঠিক মাপে হাওয়া প্রবেশ করালে মিলবে নিরাপদ যাত্রা। এ ধরনের হাওয়ার মেশিনের দাম এক থেকে তিন হাজার টাকার মধ্যে হয়ে থাকে।

বেশির ভাগ বাইকারকে চেইনে লুব্রিকেন্ট করার ক্ষেত্রে পোড়া ইঞ্জিন অয়েল বা সাধারণ ইঞ্জিন অয়েল ব্যবহার করতে দেখা যায়। এ ধরনের ইঞ্জিন অয়েল ব্যবহারে চেইন ভেজা থাকলেও ধুলাবালু বেশি জমার সম্ভাবনা থাকে। অবশ্যই চেইনে চেইনলুব ব্যবহার করা উচিত। ১৫০ থেকে শুরু করে ৫০০ টাকার মধ্যে চেইনলুব পাওয়া যায়। একটি চেইনলুব দিয়ে ২০ থেকে ২৫ বার চেইনকে ভেজানো যায়। লুব ব্যবহারের ফলে চেইন দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং স্পোকেটগুলো ভালো থাকে।

মোটরসাইকেল সাধারণত দুই প্রকারের হয়ে থাকে। এয়ার কুলড ও অয়েল কুলড। এয়ার কুলড ইঞ্জিন বাতাসেই স্বাভাবিক তাপমাত্রায় চলে আসতে পারে। অয়েল কুলড ইঞ্জিনের ক্ষেত্রে মোটরসাইকেল নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের নির্দেশনা অনুসারে নিয়মিত পরিবর্তন করতে হবে। ইঞ্জিনের তাপমাত্রা ঠিক থাকলে নৈপুণ্য বৃদ্ধি পাবে।

মোটরবাইকে গতির পাশাপাশি নিয়ন্ত্রণ ঠিক রাখার জন্য ব্রেকের দিকে নজর দেওয়া জরুরি। দুই ধরনের ব্রেক মোটরসাইকেলে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ডিস্ক ও ড্রাম ব্রেক। ব্রেকের কার্যক্ষমতা কমে গেলে ব্রেকের রেসপন্স কমে যায়। ডিস্কের ব্রেকপ্যাড ক্ষয় হয়ে গেলে ধাতব অংশটি ডিস্কে লেগে ক্ষতির কারণ হতে পারে। ড্রাম ব্রেকের ক্ষেত্রে ব্রেক লিভারের শেষে স্ক্রু দিয়ে স্প্রিং আটকানো থাকে। যদি টাইট দিতে দিতে আর টাইট দেওয়ার জায়গা না থাকে, সে ক্ষেত্রে ড্রাম ব্রেক পরিবর্তন করা জরুরি।

মোটরসাইকেলের সাথে যে টায়ার থাকে, সেগুলো সর্বোচ্চ ছয় বছর পর্যন্ত ব্যবহার করা যায়। তবে অতিরিক্ত মোটরসাইকেল চালানো হলে আরও আগে টায়ার পরিবর্তন করতে হয়। চাকার যে অংশ মাটির সাথে লাগে, সে স্থানে টায়ারের খাঁজ কাটা থাকে। এই গ্যাপ যদি কমে যায়, তাহলে টায়ারের গ্রিপ কমে যাবে এবং টায়ার স্লিপ করবে। এমন অবস্থায় আসার আগেই টায়ার পরিবর্তন করা জরুরি। রাস্তায় পাংচারর ঝামেলা এড়াতে বেশির ভাগ টায়ার এখন টিউবলেস হয়ে থাকে। এসব টায়ারে টায়ার সিলেন্ট ব্যবহার করে নিশ্চিন্তে পথ পাড়ি দেওয়া যেতে পারে।

বাইকে ব্যাটারি দুর্বল হলে হর্ন ঠিকমতো কাজ করে না। সেলফ মোটর দিয়ে বাইক চালু করার সময় যদি বারবার বোতাম চাপার পরও বাইক স্টার্ট না নেয়, তাহলে ব্যাটারি দুর্বল হয়েছে বলে ধরে নিতে হবে। তবে হর্ন ঠিকমতো কাজ করলে আর সেলফ স্টার্ট কাজ না করলে স্টার্টার মোটরেও সমস্যা হতে পারে। এখনকার ব্যাটারিগুলো সাধারণত মেইনটেন্যান্স–ফ্রি বা ড্রাই সেলের হয়ে থাকে। তাই আলাদা করে এসব ব্যাটারিতে পানি ভরতে হয় না। নতুন ব্যাটারিতে তিন থেকে ছয় মাসের বিক্রয়োত্তর সেবা মেলে।

বেশির ভাগ মোটরসাইকেলচালকেরা মনে করেন, দুই থেকে তিন হাজার কিমি এর বেশি একটি ইঞ্জিন অয়েল ব্যবহার করা ঠিক না। ইঞ্জিন অয়েলের তিনটি ভাগ রয়েছে। মিনারেল,সেমি সিনথ্যাটিক এবং সিনথ্যাটিক। মিনারেল ইঞ্জিন অয়েল দ্রুত পরিবর্তন করতে হয়। সেমি সিনথ্যাটিক ইঞ্জিন অয়েলগুলো ২ থেকে ৩ হাজার কিমি পর্যন্ত চালানো যায়। আর সিনথ্যাটিক এর ক্ষেত্রে ৩ থেকে ৭ হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত অনায়াসে একটি ইঞ্জিন অয়েল দিয়ে বাইক চালানো যায়। ইঞ্জিন অয়েলের বোতলে কত কিলোমিটারের জন্য নির্মাতা প্রতিষ্ঠান রিকমেন্ড করেছে তা উল্লেখ থাকে। দীর্ঘদিন ইঞ্জিন অয়েল ব্যবহার করে পরিবর্তন করলে ইঞ্জিন অয়েলের পাশাপাশি অয়েল ফিল্টারও পরিবর্তন করে নেওয়া ভালো।

যে ফিল্টারের মাধ্যমে ইঞ্জিনে বাতাস প্রবেশ করে, সেটি হলো এয়ার ফিল্টার। এয়ার ফিল্টার অনেকটা নাকের মতো কাজ করে। তাই দুই সপ্তাহ পরপর এয়ার ফিল্টার পরিষ্কার করে নেওয়া ভালো। ১০ হাজার কিলোমিটার পরপর এয়ার ফিল্টার পরিবর্তন করলে বাইকের শব্দ শ্রুতিমধুর থাকে।

মোটরসাইকেলের ক্ষেত্রে চালকের ধরন অনুসারে যত্ন–আত্তি ভিন্ন হয়। যাঁরা অফিস, বাসা, আড্ডায় যাওয়ার জন্য মোটরসাইকেল ব্যবহার করেন, তাঁদের রক্ষণাবেক্ষণ অনেকাংশে কম লাগে। এ ছাড়া বাইকটি কী ধরনের, কত দিন পরপর, কোন ধরনের কাজে এবং কীভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, তা জেনে বাইকের যত্ন করতে হয়। এ ছাড়া বছরে একবার পুরো বাইকের সার্ভিসিং করানো দরকার। এতে মোটরসাইকেলের ফ্রেমের যেসব অংশে গ্রিজ লাগে, সেগুলোয় গ্রিজ দেওয়া হয়। কানে লাগে এমন শব্দ থেকে নিয়মিত সার্ভিসিংয়ের মাধ্যমে মুক্তি মেলে।

মোটরসাইকেল চালানো অবস্থায় বাইকের আওয়াজ কেমন শোনাচ্ছে, সেদিকে খেয়াল রাখা উচিত। ক্লিক করে আওয়াজ, ঠুং বা ঠকঠক যেকোনো অস্বাভাবিক শব্দ কিংবা কোনো কিছু বন্ধ হয়ে গেলে তৎক্ষণাৎ নিরাপদ জায়গায় বাইক থামিয়ে তদন্ত করে দেখা জরুরি। বাইকের যত জায়গায় কিছু ঘোরানো যায় (যেমন কিকস্ট্যান্ড, সুইং আর্ম ও বিয়ারিং), সেই সব জায়গায় পরীক্ষা করে করে লুব দিতে হবে। যাবতীয় নাট, বল্টু, স্ক্রু ইত্যাদি মাঝেমধ্যে পরীক্ষা করে দেখা প্রয়োজন। কেননা দিনের পর দিন মোটরসাইকেলের ভাইব্রেশনের কারণে অনেক কিছু ঢিলে হয়ে যেতে পারে। সবকিছু শক্তভাবে আটকানো কি না, তা মাসে অন্তত একবার পরীক্ষা করে নেওয়া উত্তম।
এ ছাড়া বছরে একবার ক্যাম চেইনের রক্ষণাবেক্ষণ, জ্বালানি ফিল্টার পরিষ্কার করা, ফুয়েল ইনজেকশন (এফআই) ইঞ্জিনের ক্ষেত্রে ইনজেকটরের কর্মক্ষমতা, ভাল্ব অ্যাডজাস্টমেন্ট, ফর্ক অয়েল ও সিল লিক হয়েছে কি না, সেগুলো দেখা এবং স্পার্ক প্লাগ পরিবর্তন করা জরুরি। মনে রাখতে হবে যে ছোটখাটো সমস্যাগুলো সময়মতো সমাধান না করা হলে পরবর্তী সময়ে বিকট আকার ধারণ করে এবং অন্যান্য যন্ত্রাংশ নষ্ট হওয়ার কারণ হয়। হঠাৎ মোটরসাইকেল বন্ধ হয়ে গেলে জ্বালানি আছে কি না, বাতাস ঠিকমতো প্রবেশ করছে কি না, স্পার্ক ও কমপ্রেশন কাজ করছে কি না, পরীক্ষা করে দেখতে হবে। নিয়মিত মোটরসাইকেলের যত্ন নিলে বাইক চালানোর সময় আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি ছোটখাটো জিনিসের জন্য বারবার মেকানিকের কাছে দৌড়াদৌড়ি করতে হবে না এবং জরুরি পরিস্থিতিতেও মাথা ঠান্ডা রেখে কাজ করা যাবে।

Lading . . .