প্রকাশ: ২৫ আগস্ট, ২০২৫

ঢাকার কালেক্টর ১৭৯০ সালে উল্লেখ করেন, সে সময় শহরে আসা একদল সৈন্য চালু করেছিল ভাড়াটে ঘোড়ার গাড়ি। সম্ভবত তখনকার সেনাবাহিনীর থাকার জায়গা তেজগাঁওয়ের বেগুনবাড়ি থেকে মূল শহরের মালামাল টানার জন্য ঘোড়ার গাড়ির সার্ভিস চালু হয়েছিল। তবে সে সার্ভিস বেশি দিন চলেনি। আর সে জন্য দায়ী ছিল ঢাকার রাস্তাঘাট। সোজা কথায়, ঢাকায় তখন ‘মোগলাই’ রোমান্টিকতা ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। অযত্ন-অবহেলায় ঢাকাকে গ্রাস করছিল জঙ্গল। ঢাকার দৈর্ঘ্য এসে দাঁড়িয়েছিল প্রায় পাঁচ মাইলের মধ্যে। এমন শহরের রাস্তাঘাটের কথাও বলাই বাহুল্য।
তবে ব্যক্তিগত ঘোড়ার গাড়ির কথা আমরা জানতে পারি। উনিশ শতকের প্রথম দিকে ঢাকায় একটি হলেও ঘোড়ার গাড়ি ছিল। ১৮২৪ সালে ঢাকায় ভ্রমণে কলকাতার বিশপ হেবার জানাচ্ছেন, ঢাকার নায়েব নাজিম শামসউদ্দৌলার চার ঘোড়ায় টানা একটি পুরোনো ল্যান্ডো গাড়ি ব্যবহার করতেন। তবে আসল পাবলিক ট্রান্সপোর্টের জন্য ঢাকাবাসীকে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হয়েছে। আর এটির পুরো কৃতিত্ব দিতেই হবে আর্মানি ব্যবসায়ী সিরকোরসকে। এই ভদ্রলোক ১৮৫৬ সালের দিকে ঢাকায় চালু করে বসলেন ‘ঠিকা গাড়ি’। সিরকোরসের ‘হ্যামনি ক্যারিজ’ বা ঘোড়ার গাড়ির ব্যবসা এতটাই লাভজনক হয়ে ওঠে যে ঢাকার অন্য ব্যবসায়ীরাও কোমর বেঁধে নেমে পড়লেন সে ব্যবসায়। ১৮৬৭ সালে ঢাকায় যেখানে ৬০টি ঘোড়ার গাড়ি ভাড়ায় খাটত, সেখানে ১৮৭৮ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩০০-তে। ১২ বছর পর সে সংখ্যা হয়ে যায় দ্বিগুণ।
কলকাতাকে অনুসরণ করে যেমন ঢাকায় শুরু হয়েছিল ঘোড়ার গাড়ির প্রচলন, ঠিক তেমনি ঢাকায় মোটরগাড়ির শুরুটা কিন্তু হয়েছিল সেই কলকাতাতেই। রাধারমণ মিত্রের কলকাতা দর্পণ থেকে জানা যায়, ১৮৯৬ সালে কলকাতায় প্রথম যাত্রীবাহী মোটরগাড়ি দেখা যায়। যদিও এটা নিয়ে খানিকটা বিতর্ক আছে। অন্য একটি তথ্য জানাচ্ছে, ১৮৯৭ সালে নাকি কলকাতায় প্রথম মোটরগাড়ি আসে। কলকাতার বুকে ব্রিটিশ আমলে চলা এই গাড়ি ছিল ডেনিস নামের এক ফরাসি কোম্পানির। ‘দেদিওঁ’ মডেলের সেই গাড়ি কলকাতায় প্রথম আনেন কলকাতারই এক বাসিন্দা এইচ এইচ রেনল্ডস। আর বাঙালিদের মধ্যে প্রথম মোটরগাড়ি কেনেন সি বসাক।
এবার প্রশ্ন জাগতে পারে, ঢাকায় প্রথম মোটরগাড়ি বা অটোমোবাইলের চাকা কবে ঘুরেছিল? কলকাতায় চালুর কত বছর পরই–বা ঢাকায় হাজির হয়েছিল মোটরগাড়ি? সেটা কি ১৯০৪ সালে? কেননা, ওই বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি ভারতের ভাইসরয় লর্ড কার্জন কলকাতা থেকে ঢাকায় আসেন সস্ত্রীক। তাঁদের আগমন উপলক্ষে মনোরমভাবে সাজানো হলো নবাবদের শাহবাগের বাগানবাড়ি। আর তড়িঘড়ি করে নবাব খাজা সলিমুল্লাহ বেশ কয়েকটি গাড়ি কিনে আনলেন কলকাতা থেকে। সেই গাড়িবহরের একটি গাড়িতে লেডি মেরি কার্জন গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে বসেছিলেন, লর্ড কার্জন দাঁড়ালেন তাঁর পাশে আর চারটি গাড়ি সারিবদ্ধভাবে বাড়ির সামনের চত্বরে দাঁড় করানো।
তবে ইংরেজ গাড়ি ব্যবসায়ী মন্টাগো গ্রাহাম হোয়াইটের আত্মজীবনী অ্যাট দ্য হুইল অ্যাশোর অ্যান্ড অ্যাফ্লোট: রেমিনিসেন্সেস অব মোটরিং, ইয়টিং অ্যান্ড ট্রাভেল ওভার আ পিরিয়ড অব ফোর্টি ইয়ারস-এ পাওয়া যায় অন্য এক তথ্য। ১৯০৩ সালের জানুয়ারিতে দিল্লি দরবারে যোগ দিতে যান নবাব সলিমুল্লাহ। সেখানে মন্টাগো গ্রাহাম হোয়াইটের সঙ্গে পরিচয়ের পর নবাব সিদ্বান্ত নেন গাড়ি কেনার। ওই বছরের শেষ নাগাদ নওয়াব সলিমুল্লাহর কেনা তিনটি গাড়ি পৌঁছে গেল আহসান মঞ্জিলে। ১৯৪৩ সালে প্রকাশিত দ্য মোটর ম্যাগাজিনের পাওয়া তথ্যমতে, সেই গাড়িগুলোর মধ্যে দুটি ছিল ১০ হর্স পাওয়ার এবং ১৫ হর্স পাওয়ারের মর্স গাড়ি আর একটি ৮ হর্স পাওয়ারের রেনোঁ। মন্টাগোর দেওয়া তথ্যমতে, তাঁর নিয়ে আসা মর্সই কলকাতার প্রথম পেট্রলচালিত গাড়ি।
মন্টাগো গ্রাহাম ঢাকা শহরে আসার আগে মনে করেছিলেন, কলকাতার চেয়ে পুরোনো শহরটি বোধ হয় বেশ পরিকল্পিত আর বিশাল হবে। কিন্তু শহরে নেমে তাঁর ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়। ঢাকার অপ্রশস্ত রাস্তায় মোটরগাড়ি চালানোটা দারুণ ঝক্কির কাজ মনে হয়েছিল তাঁর। মন্টাগোর গাড়ি ইসলামপুর রোডে অবস্থিত নবাববাড়ির প্রধান ফটক দিয়ে প্রবেশ করে আহসান মঞ্জিলে। চমৎকার বাগানঘেরা পথে গাড়ি এসে দাঁড়ায় উত্তরের গাড়ি বারান্দায়।
এবার আসা যাক গাড়িগুলো কিনতে কত খরচ করতে হয়েছিল, সে বিষয়ে। তেমন কিছু জানা না গেলেও কলকাতায় পত্র–পত্রিকায় প্রকাশিত কিছু মোটরগাড়ি–সংক্রান্ত বিজ্ঞাপন থেকে কিছু ধারণা অন্তত আমরা পেতে পারি। ১৯০০ সালের ২৩ এপ্রিল কলকাতায় প্রথম মোটরগাড়ি বিক্রি–সংক্রান্ত বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়। সে সময়ের গাড়ি বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো গাড়ি বিক্রির পাশাপাশি গাড়ি চালানোও শেখাত। এমনকি পেট্রলের গাড়ি হলে জ্বালানির জোগান দিত তারাই। ১৯০৪ সালে প্রতি গ্যালন পেট্রলের দাম ছিল ১ টাকা। নতুন গাড়ির পাশাপাশি সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি বিক্রির ব্যবস্থাও ছিল। ওই বছর বিক্রি হওয়া কয়েকটি গাড়ির দরদাম ছিল এমন—ওয়াগনেট (১২ হর্স পাওয়ার) (৬ জন যাত্রীর উপযোগী) ৯ হাজার টাকা, ওয়াগনেট (৪ জন যাত্রীর উপযোগী) ৫ হাজার ৭৫০ টাকা, ওয়াগনেট (৪ জন যাত্রীর উপযোগী) সেকেন্ড হ্যান্ড ৪ হাজার ৫০০ টাকা, লোকো-সারে (সেকেন্ড হ্যান্ড) ২ হাজার ৮০০ টাকা।
আগেই যেমনটা বলেছিলাম, ১৯০৪ সালে শাহবাগের বাগানবাড়িতে কয়েক মাস আগে কিনে আনা নিজের মোটরগাড়িগুলো প্রদর্শন করেছিলেন নবাব খাজা সলিমুল্লাহ। এমন গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তের ছবি তুললেন সে সময়ের বিখ্যাত জার্মান ফটোগ্রাফার ফ্রিৎস কাপ। আর তাতেই ঢাকার ইতিহাসের দারুণ একটি মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে গেল ঢাকার প্রথম মোটরগাড়িগুলো।
ভারত উপমহাদেশের অন্যান্য ধনাঢ্য ব্যক্তি ও জমিদারের মতো পূর্ববঙ্গের ধনী ব্যক্তিরাও নিজেদের আভিজাত্য দেখানোর নতুন কৌশল হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন অটোমোবাইলকেই। বিশ শতকের প্রথম থেকেই ঢাকার ধনাঢ্য ব্যক্তি ও জমিদারেরা তাঁদের ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য গাড়ি কেনা শুরু করেছিলেন।
ল্যাঞ্চেস্টার, ফোর্ড প্রভৃতি গাড়ির চাহিদা তুঙ্গে ওঠে। তথ্য অনুযায়ী, ১৯১৫-১৬ সাল নাগাদ পুরো বাংলায় গাড়ির সংখ্যা এক হাজারের গণ্ডি ছাড়িয়ে যায়। গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো বিজ্ঞাপনের জন্য বিভিন্ন রোড শো, হ্যান্ডবিল বিতরণ ইত্যাদি শুরু করে। ধীরে ধীরে গাড়ির এই চাহিদা দেশের অন্যত্রও ছড়িয়ে পড়তে থাকে।