Advertisement

দেশে দেশে ইন্টারনেট বন্ধের ঘটনা, কোটি কোটি ডলার ক্ষতি হয় যে কারণে

প্রথম আলো

প্রকাশ: ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

নানা কারণে বিভিন্ন দেশের সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়ছবি: আনওয়ানটেড উইটনেস
নানা কারণে বিভিন্ন দেশের সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়ছবি: আনওয়ানটেড উইটনেস

সম্প্রতি নেপালে ফেসবুক, এক্স (সাবেক টুইটার), ইউটিউবসহ বেশির ভাগ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করতে চেষ্টা করে নেপাল সরকার। এসব প্রতিষ্ঠান সরকার নির্ধারিত নিবন্ধনপ্রক্রিয়ায় অংশ নেয়নি বলে বন্ধ করার কথা বলা হয়। যদিও সেন্সরশিপ আরোপ ও অনলাইনে সরকারের সমালোচকদের দমনের হাতিয়ার হিসেবে এমন কাজ করা হয় বলে সমালোচনা রয়েছে।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সরকার মাঝেমধ্যেই ইন্টারনেট বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করে দেয়। কখনো দেশের ভেতরে রাজনৈতিক অস্থিরতা, কখনো নিরাপত্তা ইস্যু, আবার কখনো বিদেশি প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর জন্য এমন পদক্ষেপ নেওয়া হয়। ২৫ বছর ধরে বিশ্বজুড়ে এমন বন্ধ বা নিষেধাজ্ঞা একটি সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ইন্টারনেট শাটডাউন বা ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়ার ঘটনা শুধু ছোট বা উন্নয়নশীল দেশেই সীমাবদ্ধ নয়। গণতান্ত্রিক দেশ থেকে শুরু করে একনায়কতান্ত্রিক দেশের মতো সব জায়গায়ই এমন ঘটনা ঘটছে।

আন্তর্জাতিক সংস্থা অ্যাকসেস নাউর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬ সাল থেকে সারা বিশ্বে এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৭৫৪ বার ইন্টারনেট শাটডাউনের ঘটনা জানা যায়। ২০২২ সালে ৬৭টি দেশে ১৮৭ বার ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে ভারত ছিল সবচেয়ে এগিয়ে, যেখানে ৮৪ বার ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়। রাজনৈতিক বিক্ষোভ, নির্বাচন বা পরীক্ষার সময় নকল ঠেকানোর মতো বিভিন্ন কারণে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়। ২০২৪ সালে ৫৪টি দেশে ২৯৬ বার ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়। ২০২৩ সালে ২৮৩ বার। ২০২৫ সালে এখন পর্যন্ত ৪৭ বার ইন্টারনেট বন্ধের ঘটনা দেখা গেছে। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত ও পাকিস্তানে এমন আচরণ অনেকবার দেখা যায় বলে বিভিন্ন তথ্যে জানা যায়।

শুধু দেশজুড়ে ইন্টারনেট বন্ধ করা হয় না বরং নির্দিষ্ট কিছু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকেও লক্ষ্যবস্তু করা হয়। যেমন তুরস্কে নির্বাচনের সময় টুইটার (বর্তমান এক্স) বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। সরকারবিরোধী প্রচার ঠেকানোর জন্য তা করা হয়। সেনেগালের মতো দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপের মতো মেসেজিং প্ল্যাটফর্মগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়, যেন বিক্ষোভকারীরা সংগঠিত হতে না পারে। বিশ্বের সবচেয়ে কঠোর ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণের উদাহরণ হলো চীন। গ্রেট ফায়ারওয়াল অব চায়না নামে পরিচিত তাদের এই ব্যবস্থা ফেসবুক, গুগল, ইউটিউব এবং এক্সের মতো পশ্চিমা মাধ্যমগুলোকে চীনে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। এর পরিবর্তে চীন নিজস্ব প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোকে উৎসাহিত করে। চীনা সরকার পশ্চিমা প্রযুক্তির মাধ্যমে তথ্যপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ ও নাগরিকদের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে এমন নিয়ন্ত্রণ করে।

সাম্প্রতিক সময়ে রাশিয়াও একই পথ অনুসরণ করছে। ইউক্রেন যুদ্ধের পর রাশিয়া ফেসবুক ও এক্স নিষিদ্ধ করে। রাশিয়ার অভিযোগ, এই সব মাধ্যম ভুল তথ্য ছড়াচ্ছে। রাশিয়ার এই পদক্ষেপের ফলে দেশটির নাগরিকদের জন্য তথ্য পাওয়ার সুযোগ সীমিত হয়ে যায়।

জম্মু ও কাশ্মীরকে বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করার পর ভারত সরকার ২০১৯ সালের আগস্টে সেখানে ইন্টারনেট ও মোবাইল সেবা বন্ধ করে দেয়। এই শাটডাউন ছিল ইতিহাসের দীর্ঘতম ইন্টারনেট নিষেধাজ্ঞার একটি। এটি প্রায় ১৮ মাস ধরে চলেছিল। সরকারের যুক্তি ছিল, ইন্টারনেট বন্ধ সেখানে নিরাপত্তার জন্য জরুরি ছিল। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সামরিক অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকার দেশব্যাপী ইন্টারনেট এবং ফেসবুক, এক্স ও ইনস্টাগ্রামের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করে দেয়। হিজাব আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে মাসা আমিনির মৃত্যুর পর ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে ইরানজুড়ে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়। এই বিক্ষোভ দমন করতে সরকার ইন্টারনেট ও বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বিশেষ করে ইনস্টাগ্রাম ও হোয়াটসঅ্যাপের মতো অ্যাপ বন্ধ করে দেয়।

এর আগে চীনের জিনজিয়াং প্রদেশে উইঘুর মুসলিমদের ওপর চীনা সরকারের দমন-পীড়ন চলাকালীন ২০০৯ সালে ইন্টারনেট ব্যবস্থা প্রায় পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়। সংঘাত সম্পর্কিত খবর বাইরে যাওয়া ঠেকানো ও তথ্যপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা হয়। আরব বসন্তের সময় হোসনি মুবারকের শাসনের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হলে ২০১১ সালে মিসর সরকার দেশব্যাপী ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়। বিক্ষোভকারীদের সংগঠিত হওয়া থেকে বিরত রাখতে ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে তাদের কার্যক্রমের খবর ঠেকানোর জন্য এমনটি করা হয়।

২০১৬ সালে তুরস্কে সামরিক অভ্যুত্থানের চেষ্টার সময় তুর্কি সরকার তাৎক্ষণিকভাবে টুইটার, ফেসবুক ও ইউটিউব বন্ধ করে দেয়। ২০২৩ সালের জুনে সেনেগালে রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হলে সরকার ফেসবুক, টুইটার ও টিকটকের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ২০২১ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে ও পরে উগান্ডা সরকার ফেসবুক, টুইটার এবং হোয়াটসঅ্যাপের মতো প্ল্যাটফর্মগুলো বন্ধ করে দেয়। ২০২৪ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশ সরকার ফেসবুক ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের জন্য ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয় বলে অভিযোগ রয়েছে। টানা কয়েক দিন দেশে ব্রডব্যান্ড ও মোবাইলভিত্তিক ইন্টারনেট সেবা বন্ধ ছিল। পরবর্তী সময়ে ফেসবুক ও ইউটিউবে বিশেষ সরকারি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে ইন্টারনেট চালু করা হয়।

ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়ার অর্থনৈতিক ক্ষতিও ব্যাপক। ইন্টারনেট শাটডাউনের কারণে দেশগুলোর অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধাক্কা লাগে। ই-কমার্স, অনলাইন সেবা ও বিভিন্ন স্টার্টআপের কার্যক্রম সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে যায়। ২০২৪ সালে ইন্টারনেট শাটডাউনের কারণে বৈশ্বিক আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৭৬৯ কোটি মার্কিন ডলার। ২০২০ সালে এই ক্ষতির পরিমাণ ছিল ৪০১ কোটি ডলার।

সূত্র: অ্যাকসেস নাউ, ইন্টারনিউজ, স্ট্যাটিস্টা

Lading . . .