এক পাহাড়ি গ্রাম থেকে রেডফোর্ড যেভাবে সিনেমার ইতিহাস বদলে দিলেন
প্রকাশ: ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

রবার্ট রেডফোর্ডকে অনেকভাবেই মনে রাখবেন চলচ্চিত্রপ্রেমীরা, তবে স্বাধীন চলচ্চিত্রের অন্যতম প্রধান আসর সানড্যান্স ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের মাধ্যমে চলচ্চিত্রের মনে তিনি আলাদাভাবে জায়গা করে নিয়েছেন।
হলিউড তারকা থেকে স্বপ্নদ্রষ্টা
‘দ্য স্টিং’ ও ‘আউট অব আফ্রিকা’র মতো সিনেমায় অভিনয় করে যেমন তিনি অমর হয়েছেন, তেমনি পরিচালক হিসেবেও রেখেছেন ছাপ। কিন্তু রেডফোর্ডের সবচেয়ে বড় অবদান—১৯৮০-এর দশকে প্রতিষ্ঠিত সানড্যান্স ইনস্টিটিউট, যার মাধ্যমে জন্ম নেয় সানড্যান্স ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল। স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতাদের স্বপ্নপূরণের সেই মঞ্চই এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় ইনডিপেনডেন্ট ফিল্ম উৎসব।
ষাটের দশকের শেষভাগে টেলিভিশনের দাপটে যখন হলিউড দিশাহারা, তখনই আবির্ভূত হন রেডফোর্ড। ‘অল দ্য প্রেসিডেন্টস মেন’, ‘দ্য ন্যাচারাল’ কিংবা ‘দ্য গ্রেট গ্যাটসবাই’—প্রতিটি ছবিতে তিনি হয়ে উঠেছিলেন নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধি। পর্দায় তাঁর রসবোধ, সেই ‘চোখের চাউনিতে মজার ইঙ্গিত’ তাঁকে আলাদা করে তুলেছিল আগের দিনের নায়ক-নায়িকাদের থেকে।
১৯৬৯ সালের ‘বুচ ক্যাসিডি অ্যান্ড দ্য সানড্যান্স কিড’ তাঁকে তারকা বানালেও সানড্যান্স ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল তাঁকে ইতিহাসের পাতায় অমর করে তোলে। কারণ, এখানেই শুরু স্বাধীন চলচ্চিত্রের নবযুগ।
এক পাহাড়ি গ্রামে শুরু
ক্যালিফোর্নিয়ার সান্তা মনিকায় জন্ম নেওয়া রেডফোর্ড নগরায়ণ ও দূষণে বিরক্ত হয়ে আশ্রয় নেন ইউটাহর অরণ্যে। ১৯৬১ সালেই সেখানে বানান নিজের কেবিন। সেই অরণ্যেই পরে গড়ে ওঠে সানড্যান্সের আসর। প্রথম দিকে নাম ছিল ‘ইউটাহ/ইউএস ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’। পরে রেডফোর্ডের চরিত্র ‘সানড্যান্স কিড’-এর নামেই পরিচিতি পায় উৎসবটি।
শুরুর দিকে শখের মতো যাত্রা শুরু হলেও সানড্যান্স হয়ে উঠেছিল স্বাধীন সিনেমার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আসর। এখানে আসতেন হলিউড এজেন্টরা, প্রযোজকেরা—প্রথমে স্কি করতে, পরে নতুন চলচ্চিত্র কিনতে। তরুণ নির্মাতারা ভিসা কার্ড সর্বস্ব দিয়ে বানাতেন স্বপ্নের ছবি। আশা করতেন, সানড্যান্সে জায়গা পেলে হয়তো জীবন বদলে যাবে। অনেকে ব্যর্থ হয়েছেন, অনেকে আবার পেয়েছেন বিশ্বজোড়া খ্যাতি।
প্রতিবছরের জানুয়ারিতে পার্ক সিটিতে অনুষ্ঠিত এ উৎসব এখন শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী চলচ্চিত্র আসর। সানড্যান্স ইনস্টিটিউটের ভাষায়, ‘স্বাধীন কণ্ঠের জন্য যে প্ল্যাটফর্ম তিনি তৈরি করেছিলেন, তা এখন চার দশক ধরে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করছে, সিনেমাকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করছে।
সমালোচক রজার ইবার্ট ১৯৮১ সালে লিখেছিলেন, রেডফোর্ড চেয়েছিলেন এটি হোক মূলধারার বাইরে থাকা চলচ্চিত্রকারদের জন্য এক কেন্দ্র। প্রথম বছরেই ১০টি স্বল্প বাজেটের ছবি নির্বাচিত হয়েছিল ল্যাব প্রোগ্রামের জন্য, যেখানে অভিজ্ঞ পেশাদারদের সঙ্গে কাজের সুযোগ পেয়েছিলেন তরুণ নির্মাতারা।
২০০২ সালের অস্কার মঞ্চে সম্মানসূচক পুরস্কার গ্রহণ করতে গিয়ে রেডফোর্ড বলেছিলেন, ‘ব্যক্তিগত কাজ আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ, তবে একই সঙ্গে এই শিল্প আমাকে যা দিয়েছে, তার কিছু ফিরিয়ে দেওয়াটাও আমার দায়িত্ব। সানড্যান্স তারই প্রতিফলন।’
তারকাদের আসর, দর্শকের উৎসব
১৯৮৯ সালে স্টিভেন সোডারবার্গের ‘সেক্স, লাইস অ্যান্ড ভিডিওটেপ’ সানড্যান্স থেকে দর্শক পুরস্কার জেতার পরই বদলে যায় উৎসবের চেহারা। বড় বড় স্টুডিও আসতে শুরু করে, যুক্ত হন তারকারা। এর পর থেকেই ‘রিজার্ভয়ার ডগস’, ‘ক্লার্কস’, ‘ডনি ডার্কো’, ‘লিটল মিস সানশাইন’ কিংবা সাম্প্রতিক অস্কারজয়ী ‘কোডা’র মতো অসংখ্য চলচ্চিত্র প্রথম দর্শক খুঁজে পায় সানড্যান্সে।
তথ্যচিত্র ও প্রামাণ্যচিত্র ধারার ছবিও সানড্যান্স থেকেই মূলধারায় পৌঁছায়—‘প্যারিস ইজ বার্নিং’, ‘ম্যান অন ওয়ার’ বা ‘গড গ্রু টায়ার্ড অব আস’-এর মতো কাজগুলো তার প্রমাণ।
রোমান্স, রাজনীতি ও প্রতিবাদ
রেডফোর্ড ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। ‘দ্য ক্যান্ডিডেট’-এ তিনি যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ব্যঙ্গচিত্র আঁকলেন; ‘অল দ্য প্রেসিডেন্টস মেন’-এ হয়ে উঠলেন ওয়াশিংটন পোস্টের সাংবাদিক বব উডওয়ার্ড, যখন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বাস হারাচ্ছিল রাজনীতির প্রতি। অন্যদিকে ‘জেরেমিয়া জনসন’-এ ছিলেন প্রকৃতির সন্তান, ‘দ্য স্টিং’-এ চিরচেনা মোহনীয় প্রতারক।
সিডনি পোলাকের সঙ্গে রেডফোর্ডের জুটি তৈরি করেছে ‘দ্য ওয়ে উই ওয়ার’, ‘থ্রি ডেজ অব দ্য কনডর’, ‘আউট অব আফ্রিকা’র মতো ছবিকে। বলা হয়, পোলাকই সবচেয়ে ভালো বুঝতে পেরেছিলেন রেডফোর্ডের সম্ভাবনা।
পরিবেশ ও প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর
সিনেমার বাইরে রেডফোর্ড ছিলেন প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর। পরিবেশ রক্ষার পক্ষে তাঁর নিরলস প্রচেষ্টা চলেছে কয়েক দশক। পরবর্তীকালে ‘অ্যান ইনকনভিনিয়েন্ট ট্রুথ বা দ্য কোভ’-এর মতো পরিবেশবিষয়ক ছবিও জায়গা করে নেয় সানড্যান্সে।
সানড্যান্সের উত্তরাধিকার
শুরুর দিকে শখের মতো যাত্রা শুরু হলেও সানড্যান্স হয়ে উঠেছিল স্বাধীন সিনেমার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আসর। এখানে আসতেন হলিউড এজেন্টরা, প্রযোজকেরা—প্রথমে স্কি করতে, পরে নতুন চলচ্চিত্র কিনতে। তরুণ নির্মাতারা ভিসা কার্ড সর্বস্ব দিয়ে বানাতেন স্বপ্নের ছবি। আশা করতেন, সানড্যান্সে জায়গা পেলে হয়তো জীবন বদলে যাবে। অনেকে ব্যর্থ হয়েছেন, অনেকে আবার পেয়েছেন বিশ্বজোড়া খ্যাতি।
প্রতিবছরের জানুয়ারিতে পার্ক সিটিতে অনুষ্ঠিত এ উৎসব এখন শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী চলচ্চিত্র আসর। সানড্যান্স ইনস্টিটিউটের ভাষায়, ‘স্বাধীন কণ্ঠের জন্য যে প্ল্যাটফর্ম তিনি তৈরি করেছিলেন, তা এখন চার দশক ধরে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করছে, সিনেমাকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করছে।’
২০০৫ সালে রেডফোর্ড বলেছিলেন, ‘এর জন্য আমি জীবনের এতটা সময় দিয়েছি; কারণ, এটি আমার কাছে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।’ সানড্যান্স উৎসব যে কত গুরুত্বপূর্ণ, সেটা এত দিনে ভালোভাবেই বুঝে গেছেন চলচ্চিত্রপ্রেমীরা।
তথ্যসূত্র: পিপল ডটকম ও ভ্যারাইটি