প্রকাশ: ২৬ আগস্ট, ২০২৫

গানের জগতে তাঁকে বলা হতো ‘ব্ল্যাক ডায়মন্ড’। সেই ব্ল্যাক ডায়মন্ড বাংলাদেশের সংগীতজগৎ থেকে কয়েক বছর দূরে ছিলেন। মাঝেমধ্যে নতুন গান প্রকাশ করলেও বিনোদন অঙ্গনের কোনো আড্ডায়ও উপস্থিতি নেই তাঁর। বেবী নাজনীনকে শ্রোতারা তাঁর গানের মতো করেই সারা বাংলায় খুঁজে বেড়াতেন। এখন আবার তাঁকে সবাই পাচ্ছেন।
দীর্ঘদিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে থাকলেও গত বছরে বাংলাদেশ আসেন বেবী নাজনীন। রাজনীতি এবং সংগীতচর্চা দুই–ই চলছে এখন ঠিকঠাক। মাত্র সাত বছর বয়স থেকে মঞ্চে গান গাওয়া শুরু বেবী নাজনীনের। সেই যে শুরু, চলেছে টানা ২০০৮ পর্যন্ত। এরপর তাঁর স্টেজ শো কমতে থাকে। এই কমে যাওয়ার প্রধান কারণ, তাঁর রাজনৈতিক পরিচয়। ২০১৪ সাল থেকে বাংলাদেশের কোনো স্টেজ শোতে দেখা যায়নি এই শিল্পীকে। দেশের মঞ্চে গাইতে না পারলেও ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন মঞ্চে গানের অনুষ্ঠান করে গেছেন। গত বছর ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের পর দেশে ফেরার পর, এখন আবার দেশের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গাইছেন।
বেবী নাজনীনের গানের হাতেখড়ি বাবা মনসুর সরকারের কাছে। তারপর জীবনের দীর্ঘ চলার পথে সংগীতের নানা দীক্ষা এবং সাধনায় নিজেই নিজেকে গড়ে তুলেছেন তিনি। ১৯৮০ সালে প্রথম সিনেমার গানে কণ্ঠ দেন তিনি। এহতেশামের ‘লাগাম’ সিনেমার গানটির সুর ও সংগীত করেন আজাদ রহমান। ১৯৮৭ সালে মকসুদ জামিল মিন্টুর সংগীত পরিচালনায় প্রকাশিত প্রথম অ্যালবাম ‘পত্রমিতা’। এটিই তাঁর সংগীতজীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
১৯৬৫ সালের ২৩ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন বেবী নাজনীন। আজকের এই দিনটি বন্ধু, শুভাকাঙ্ক্ষী, স্বজন ও পারিবারিক আবহে কাটছে। কোনো রকম হইহুল্লোড় বা জমকালো আনুষ্ঠানিকতা এই দিনটিতে তাই রাখেননি। কখনো রাখতেও চান না। তাঁর মতে, সাদামাদা জীবনটাই বেশি সুন্দর।
ষাটের দশকের মাঝামাঝি জন্মগ্রহণ করা বেবী নাজনীন একটা সময় দেশের অপরিহার্য শিল্পীদের একজন হয়ে ওঠেন। তাঁর ঝুলিতে জমতে থাকে শ্রোতাপ্রিয় সব গান। প্রথম অ্যালবাম ‘পত্রমিতা’র পর ‘নিঃশব্দ সুর’, ‘কাল সারা রাত’, ‘প্রেম করিলেও দায়’, ‘দুচোখে ঘুম আসে না’ অ্যালবামগুলো আধুনিক গানে বেবী নাজনীনের অবস্থান শক্ত করে। ‘ওই রংধনু থেকে’, ‘কাল সারা রাত ছিল স্বপনের রাত’, ‘এলোমেলো বাতাসে উড়িয়েছি শাড়ির আঁচল’, ‘দুচোখে ঘুম আসে না তোমাকে দেখার পর’, ‘আমার ঘুম ভাঙ্গাইয়া গেল রে মরার কোকিলে’, ‘মানুষ নিষ্পাপ পৃথিবীতে আসে’, ‘কই গেলা নিঠুর বন্ধু রে সারা বাংলা খুঁজি তোমারে’, ‘পূবালী বাতাসে’, ‘ও বন্ধু তুমি কই কই রে...’, এমন অনেক জনপ্রিয় গান আজও দেশের মানুষের মুখে ফিরে। তাঁর সর্বশেষ একক অ্যালবাম ‘ব্ল্যাক ডায়মন্ড বেবী নাজনীন’। ২০০৩ সালে শ্রেষ্ঠ নারী নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। সঙ্গে সিজেএফবিসহ অসংখ্য পুরস্কার অর্জন করেন।
আধুনিক সংগীতের সর্বাধিক সংখ্যক একক, দ্বৈত ও মিশ্র অডিও অ্যালবামের শিল্পী বেবী নাজনীন। সংগীতজীবনের শুরু থেকেই অডিও মাধ্যম, বেতার, টেলিভিশন, চলচ্চিত্র এবং দেশ-বিদেশের মঞ্চ মাধ্যম মাতিয়ে চলেছেন সমানতালে। দেশ-বিদেশের মঞ্চে নিয়মিত হলেও লম্বা সময় নতুন গানে নেই বেবী নাজনীন। সে বিষয়ে প্রশ্ন তুলতেই একবুক হতাশা ব্যক্ত করেন এই শিল্পী। নতুন গান কবে পাওয়া যাবে, এমন প্রশ্নে প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘নতুন গানের কাজ চলছে। তবে একটু সময় লাগবে। কারণ, দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দরকার। দেশ যদি রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল না হয়, দেশে সুখের কর্মকাণ্ডও হয় না। গান তো একটা সংবেদনশীল বিষয়, যা মানুষ ভেতরে ধারণ করে। মনমানসিকতাকে সঠিক পথে পরিচালিত করে। সেই জায়গা থেকে শিল্পীদের কাছে দেশের পরিবেশ–পরিস্থিতি ভালো থাকা গুরুত্বপূর্ণ। আমি পৃথিবীর অনেক দেশে গিয়েছি, অনেক দেশের মানুষের সঙ্গে মিশেছি, শিল্পীদের সঙ্গে দেখা–সাক্ষাৎ হয়েছে—সেখানকার অনেক শিল্পী, সাহিত্যিক ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শ ধারণ করেন। দেশে রাজনৈতিক সংকটও তৈরি হয়। কিন্তু শিল্পীদের নিয়ে আমাদের এখানকার মতো সংকট তৈরি হয় না। সবাইকে একটা সিস্টেমের মধ্য দিয়ে চলতে হয়। সিষ্টেম কখনোই সংস্কৃতিতে ডমিনেন্ট না করে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলেও শিল্প–সংস্কৃতিতে তার প্রভাব পড়ে না। একে ব্ল্যাক লিস্ট করো, ওকে বের করে দাও—এসব নেই। এসব হীনম্মন্যতা। উন্নত সব দেশে এসব নেই। রাষ্ট্রের দুটি দলের মধ্যে হয়তো আদর্শ নিয়ে দ্বন্দ্ব হচ্ছে, তা হতেই পারে; কিন্তু সেখানে দেশের প্রতিভাবানদের যুক্ত করে, তাদের কোণঠাসা করবে, এমনটা কোথাও নেই।
টানা ৮ বছর পর যুক্তরাষ্ট্রে থাকার পর গত বছরের ১০ নভেম্বর দেশে ফিরছেন বেবী নাজনীন। প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আগামীর বাংলাদেশ প্রসঙ্গে তাঁর উত্তর, ‘রাজনৈতিক সংস্কৃতির সৌন্দর্য হচ্ছে যেকোনো শ্রেণি, পেশা, ধর্ম–বর্ণের মানুষ রাজনীতি করবে। শিল্পীদের ক্ষেত্রে বলব, শিল্পীর জায়গায় শিল্পী, রাজনীতির জায়গায় রাজনীতি। কোনো শিল্পীর উচিত না রাজনৈতিক প্রভাব সংস্কৃতিতে খাটাবে। রাজনীতি দিয়ে কেন শিল্পীকে মূল্যায়ন করবে। শিল্পী তাঁর শিল্পকর্ম দিয়ে মূল্যায়িত হবে। আবার শিল্পীদেরও উচিত হবে না, রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার পর এমন কিছু না করা, যা তাঁর শিল্পী–জীবনকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। সংস্কৃতিতে রাজনীতি ঢুকিয়ে দেওয়া মানে দেশের অবকাঠামোকে ধ্বংস করে দেওয়া। আজকে যদি শিল্পী কলাকুশলী না থাকে, সংস্কৃতির বিকাশ হবে কীভাবে।’